দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজার দরপতনের শেষ কোথায়, আর কত প্রণোদণা দরকার। এ কথা এখন ২৮ লাখ বিনিয়োগকারীদের মুখে মুখে। দেশের পুঁজিবাজার কোন প্রণোদনাই মাথা তুলে দাঁড়াতেই পারছে না। টানা দরপতনে বিনিয়োগকারীদের মুল পুঁজি দিনের পর দিন নি:স্ব হতে চলছে। এমন অবস্থা চলছে যে পুঁজিবাজার অবিভাবকহীন। বিনিয়োগকারীদের প্রশ্ন আর কতদিন এ ভাবে চলবে। টানা দরতনের শেষ কোথায়। এ ভাবে চলতে থাকলে বাজার বিমুখ হয়ে পড়বে বিনিয়োগকারীরা।

আর অর্থনীতির অভিবাবক অর্থমন্ত্রী বাজেটের পর নিরব ভুমিকা পালন করছেন। বর্তমান অর্থমন্ত্রীর প্রতি সাধারন বিনিয়োগকারীদের অনেক প্রত্যাশা ছিল। কারন তিনি পুঁজিবাজার বুঝতেন। আর পুঁজিবাজার তিনি বুঝে নিরব ভুমিকা পালন করছেন। বিনিয়োহকারীদের প্রশ্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাজ কি? ডিএসই নিরব কেন? এ রকম নানা প্রশ্নের বেড়াজালে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা। অন্যদিকে পুঁজিবাজারে গতি ফেরাতে ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশকে (আইসিবি) নিরব ভুমিকায়। আইসিবির নানামুখী কর্মকান্ডে বিনিয়োগকারীদের মাঝে ক্ষোভ বিরাজ করছে।

এদিকে পুঁজিবাজারকে অস্থিতিশীল করতে একটি চক্র কাজ করছে মন্তব্য করে বাজার বিশ্লেষকরা। তারা বলেন,বাজেটের পর পুঁজিবাজারে নানা গুজব ছড়িয়ে পুঁজিবাজারকে আরো অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টা চলছে। এগুলো সার্ভিলেন্সের মাধ্যমে চিহ্নিত করার দাবি জানিয়েছে তারা।

বর্তমান পুঁজিবাজার তেলেসমাতি কারবার অব্যাহত রয়েছে। এখানে যারা দিনরাত কারসাজি করে চলেছেন, তাদের অব্যাহতভাবে তা করার সুযোগ দিয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সর্বস্বান্ত করা হচ্ছে; আর এ বিষয়ে ডিএসই, বিএসইসি বসে বসে তামাশা দেখছে।

কারণ পুঁজিবাজার লুটপাটের রাঘববোয়ালদের ধরার মতো শক্তি, সাহস, যোগ্যতা, দক্ষতা, ক্ষমতা কোনো কিছুই তাদের আছে বলে মনে হয় না। কারসাজিকারীদের ধরা, আজেবাজে কোম্পানির লিস্টিং ঠেকানো, ভুয়া অডিট রিপোর্ট দাখিল করে অতিরিক্ত প্রিমিয়ামসহ বাজার থেকে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে উপরোক্ত প্রতিষ্ঠান দুটির ভূমিকা যে একেবারেই গৌণ সে কথাটি বলাই বাহুল্য।

অন্যথায় যেসব কোম্পানি ২০-২৫ বছরে তাদের উৎপাদন যোগ্যতা হারিয়ে রুগ্ন প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে, জংধরা কলকব্জা নিয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরছে, সেসব কোম্পানিকেও প্রিমিয়ামসহ বাজারে আসার সুযোগ করে দেয়া হতো না! এক্ষেত্রে এমন অনেক কোম্পানির নাম এখানে উল্লেখ করা যেত, যারা দশ টাকা অভিহিত মূল্যের সঙ্গে আরও ৭০-৮০ টাকা বা কমপক্ষে ৩০-৩৫ টাকা প্রিমিয়াম আদায় করে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে।

কারণ সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ডিএসই ও বিএসইসিকে বিশ্বাস করে ওইসব কোম্পানির শেয়ার ক্রয় করেছেন। অথচ ডিএসই বা বিএসইসি ওইসব কোম্পানির সবকিছু তদন্ত বা যাচাই-বাছাই না করে অথবা যথাযথ পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করেই অনুমোদন দিয়েছে।

এ অবস্থায় কেউ যদি বলেন, ডিএসই বা বিএসইসিতে কায়েমি স্বার্থবাদীরা আসন গেড়ে বসে আছেন, তাহলে সে কথাও ফেলে দেয়ার মতো নয়। কারণ ওইসব ব্যক্তির কারণেই সরকারের সদিচ্ছা সত্ত্বেও পুঁজিবাজার স্থিতিশীল হতে পারছে না।

অন্যদিকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে অল্প কয়েকদিন ভাল অবস্থানে থাকলেও বিগত ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকে এসে নেতিবাচক প্রবণতায় নেমে আসে দেশের পুঁজিবাজার। যা ধারাবাহিকভাবে জুলাই পর্যন্ত এসে ঠেকেছে। আলোচ্য সময়ে বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে বিভিন্ন ধরনের আলোচনা-সমালোচনা ও পরামর্শ আসতে থাকে। এসবের প্রায় অধিকাংশই ছিল চলতি অর্থবছরের (২০১৮-১৯) বাজেটকেন্দ্রিক।

সকলের ধারণা ছিল বাজেট পাসের পর পুঁজিবাজারের চলমান নেতিবাচক অবস্থা কেঁটে যাবে এবং জাতীয় অর্থনীতিতে পুঁজিবাজারের অবদান দৃশ্যমান হতে থাকবে। কারণ, বাজেট পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টদের বেশ কিছু দাবি-দাওয়া ছিল; যেগুলোর মধ্যে বেশ গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটিই পূরণ করা হয়েছে।

এসবের মধ্যে: কর্পোরেট ট্যাক্স কমিয়ে আনা, বিনিয়োগকারীদের ডিভিডেন্ডমুক্ত আয় ২৫ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৫০ টাকায় উন্নীত করা, বহুজাতিক কোম্পানি থেকে দ্বৈতকর প্রত্যাহার, ক্যাশ ডিভিডেন্ডের প্রতি উদ্যোক্তাদের মনোযোগ বাড়াতে স্টক ডিভিডেন্ড ও রিটেইনড আর্নিসয়ের ওপর ১০ শতাংশ করারোপ অন্যতম।

এছাড়া পুঁজিবাজারে প্রাইভেট প্লেসমেন্ট নিয়ে সৃষ্ট নৈরাজ্যতা দূরীকরণে নেওয়া পদক্ষেপ, ঘোষণা ছাড়া পরিচালকদের শেয়ার বিক্রিসহ কতিপয় সিকিউরিটিজ আইনের সংশোধনী, নিম্নমানের প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) আনা বন্ধ রাখতে বিএসইসি কর্তৃক নতুন আইপিও অনুমোদন বন্ধ রাখা, ব্যাংকের বিনিয়োগ সীমা নিয়ে কেন্দ্রিয় ব্যাংকের অবস্থান স্পষ্টিকরণ, রাষ্টায়ত্ত বিনিয়োগ সংস্থা ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে ৮৫৪কোটি টাকার প্রণোদনা দেওয়াসহ নানা বিষয়ের সমাধান।

পাশাপাশি, পুঁজিবাজারে সচ্ছতা ও জবাবদিহীতা প্রতিষ্ঠিত করতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নেওয়া বিনিয়োগ শিক্ষা কার্যক্রম সম্প্রসারণ, বাজারে বৈচিত্র আনতে নতুন পণ্য হিসেবে-স্মল ক্যাপিটাল প্লাটফর্ম চালু, ডেরিভেটিভস, শর্ট সেল ও ইনভেস্টমেন্ট সূকুকু আইন প্রণয়নের ব্যবস্থাসহ নানা পদক্ষেপ, জাতীয় সংসদে পুঁজিবাজার নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও অর্থমন্ত্রী আহম মুস্তাফা কামালের গঠনমুখি ও অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্যসহ সাম্প্রতিক নানা পদেক্ষেপের প্রায় সবকিছুই পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতার ইঙ্গিত বহন করে।

কিন্তু দু:খের বিষয় হলো এসব পদক্ষেপের ফলেও সাম্প্রতিক সময়ে পুঁজিবাজারে চরম নেতিবাচক প্রবণতা বিরাজ করছে। আলোচ্য সময়ের মধ্যে পুঁজিবাজারে সূচক-লেনদেন ব্যাপকহারে কমে গেছে। একইসঙ্গে শেয়ারের বাজারমূল্য কমে যাওয়া, বাজার মূলধন কমে যাওয়াসহ নানা নেতিবাচক অবস্থা দেখা দিয়েছে।

বিশ্লেষকদের মনে তাই প্রশ্ন জাগছে, আর কতো প্রণোদনা দিলে ঠিক হবে পুঁজিবাজার? কে দূর করবে পুঁজিবাজারের লাখ লাখ বিনিয়োগকারীর হতাশা? আর কবেইবা জাতীয় উন্নয়নের মূলধারায় ফিরবে দেশের পুঁজিবাজার?

ফাতিমা জাহান, যুগ্ন সম্পাদক, দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণ।