মিজানুর রহমান, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতার স্বার্থে সরকারের নানামুখী উদ্যোগের পরও ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না । ফলে সকলের মাঝে বাজার পরিস্থিতি নিয়ে অজানা আতঙ্ক বিরাজ করছে। তাছাড়া বর্তমান বাজারে অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ারের বিনিয়োগ অনুকূল পরিবেশ থাকলেও প্রায় প্রতিদিনই নিম্নমুখী হচ্ছে বাজার। সেই সঙ্গে প্রায় প্রতিদিনই কমছে বাজার মূলধন।

বিষয়টি যেমন সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ভাবিয়ে তুলছে, ঠিক তেমনি বাজার সংশ্লিষ্টদের কাছে এর প্রকৃত কারণ অজানাই রয়ে গেছে। আর এ কারনে লাখ লাখ বিনিয়োগকারী উৎকন্ঠায় দিন কাটাচ্ছেন। এ পরিস্থিতিতে বাজারের ভারসাম্য ধরে রাখতে ইনভেষ্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশসহ (আইসিবি) সহ সকল প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা নিস্ক্রিয় ভূমিকা পালন করছে।

পোর্টফলিও ম্যানেজারসহ বেশিরভাগ বিনিয়োগকারী বর্তমানে সাইডলাইনে থেকে বাজার পর্যবেক্ষণে বেশি ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। অতীত থেকে শিক্ষা নেয়া, বিনিয়োগকৃত অর্থের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা না পাওয়ায় নতুন করে বিনিয়োগে আসছেন না বেশিরভাগ বিনিয়োগকারী।

বিনিয়োগকারীদের প্রশ্ন পুঁজিবাজার দরপতনের শেষ কোথায়, আর কত প্রণোদণা দরকার। এ কথা এখন ২৮ লাখ বিনিয়োগকারীদের মুখে মুখে। দেশের পুঁজিবাজার কোন প্রণোদনাই মাথা তুলে দাঁড়াতেই পারছে না। টানা দরপতনে বিনিয়োগকারীদের মুল পুঁজি দিনের পর দিন নি:স্ব হতে চলছে। এমন অবস্থা চলছে যে পুঁজিবাজার অবিভাবকহীন। বিনিয়োগকারীদের প্রশ্ন আর কতদিন এ ভাবে চলবে। টানা দরতনের শেষ কোথায়। এ ভাবে চলতে থাকলে বাজার বিমুখ হয়ে পড়বে বিনিয়োগকারীরা।

আর অর্থনীতির অভিবাবক অর্থমন্ত্রী বাজেটের পর নিরব ভুমিকা পালন করছেন। বর্তমান অর্থমন্ত্রীর প্রতি সাধারন বিনিয়োগকারীদের অনেক প্রত্যাশা ছিল। কারন তিনি পুঁজিবাজার বুঝতেন। আর পুঁজিবাজার তিনি বুঝে নিরব ভুমিকা পালন করছেন। বিনিয়োহকারীদের প্রশ্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাজ কি? ডিএসই নিরব কেন? এ রকম নানা প্রশ্নের বেড়াজালে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা।

অন্যদিকে ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে পুঁজিবাজারের উন্নয়নে পাঁচ দফা প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশা ছিল বাজেট ঘোষণার পর পুঁজিবাজার চাঙা হবে। কিন্তু বাজেট ঘোষণার পর থেকেই দেশের দুই পুঁজিবাজারে চলছে অব্যাহত টানা দরপতন। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে পুঁজিবাজারের জন্য কিছু ‘প্রণোদনা’র ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত ৯ জুলাই নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী পুঁজিবাজার উন্নয়নে সব ধরনের সহায়তা অব্যাহত রাখার আশ্বাস দেন। কিন্তু এর পরও কিছুতেই পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করা যাচ্ছে না।

পুঁজিবাজার হঠাৎ দরপতন হওয়ার পেছনে প্রধানত চার কারণ বিদ্যমান বলে দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণ ও দেশ প্রতিক্ষণ ডটকমের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। দেশের শীর্ষ অর্থনীতিবিদ, দুই স্টক এক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষ এবং বড় ও ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের কথায় এ চারটি কারণ উঠে এসেছে।

রোববার সপ্তাহের শুরুর দিনটিও শেষ হয়েছে পতনের সংবাদ দিয়ে। ফলে অব্যাহত দরপতনের মধ্যে বড় ধরনের বিপদের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। কারণ গত এপ্রিল-মে মাসেও প্রায় একই অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে বিনিয়োগকারীদের। গত বছরের একই সময়ে টানা দরপতনে মাত্র ২৫ দিনেই বাজার থেকে উধাও হয়ে গিয়েছিল প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকা।

এ শঙ্কায় নিজেদের বিনিয়োগের নিরাপত্তা চেয়ে বিক্ষোভ করছেন দিশাহারা সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। অব্যাহত দরপতনে আজও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সামনে বিক্ষোভ করেছেন বিনিয়োগকারীরা। বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের ব্যানারে আয়োজিত এ বিক্ষোভ থেকে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এম খায়রুল হোসেনের পদত্যাগ দাবি করেছেন।

বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মিজান উর রশিদ চৌধুরী  বলেন, দরপতনের প্রতিবাদে আমরা রোজার ঈদের আগেও মানববন্ধন এবং বিক্ষোভ করেছি। প্রতীকী গণঅনশন করেছি। শেয়ারবাজারের জন্য বেশকিছু সুপারিশ তুলে ধরেছি। কিন্তু পতন ঠেকাতে কেউ কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। আমরা যে দাবিগুলো জানিয়েছি তা বাস্তবায়ন করতে হবে। না হলে লাগাতার কঠোর আন্দোলনে যেতে বাধ্য হব।

এদিকে ২০১০ সালের ভয়াবহ দরপতনে পর আবার নতুন করে পথে বসার উপক্রম হয় বিনিয়োগকারীদের। বাজেটে প্রণোদনা বাড়লে বা নিয়ন্ত্রক সংস্থা আন্তরিক হলে পুঁজিবাজারের চেহারা ফিরব এ আশায় বসে ছিলেন বিনিয়োগকারীরা। কিন্তু বাজেটের পর উল্টো নিম্নগামী হয়েছে বাজারের সূচক। ফলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। শেয়ার বাজারে প্রতিদিনই মূলধন পতনের পরিমাণ বাড়ছে। শুধু ছোট মূলধনী কোম্পানি নয়, বৃহৎ কোম্পানির শেয়ার কিনেও ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বলে জানিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। তাদের দাবি এসব চলে যাচ্ছে সিন্ডিকেটের পকেটে। বিশ্লেষকরা বলছেন, কারসাজিকারীদের হাতে বাজার ছেড়ে দেওয়ার কারণে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

বাজার বিশ্লেষক ও ডিএসই ব্রোকার্স এসোসিয়েশনের (ডিবিএ) সভাপতি শাকিল রিজভী  বলছেন, নতুন বাজেটে পুঁজিবাজারে জন্য কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সবার প্রত্যাশা ছিল বাজেট পাসের পর বাজার ভালো হবে। কিন্তু সেটা না হয়ে উল্টো বাজারে দরপতন চলছেই। পুঁজিবাজার দরপতনের  কারন হচ্ছে, গ্রামীণফোন এবং পিপলস লিজিংয়ের শেয়ারের দর অস্বাভাবিক কমে যাওয়া, ব্যাংকগুলোর কাছে টাকা না থাকা, গ্যাসের দাম বাড়ানোয় কোম্পানিগুলোর মুনাফা কমে যাওয়ার শঙ্কায় এই দরপতন চলছে বলে মনে করেন ডিবিএ সভাপতি।

শাকিল রিজভী বলেন, ‘গ্রামীণফোনের শেয়ারের দামের কিন্তু একটা বড় প্রভাব আছে আমাদের পুঁজিবাজারের সূচকের ওপর। এই শেয়ারের দাম কমে গেলে সূচক বড়ভাবে কমে যায়। আর বাড়লে বেশ বেড়ে যায়। উদাহরণ দিয়ে বলেন, চলতি বছরের জানুয়ারিতে গ্রামীণফোনের শেয়ারের দর ছিল ৪১০ টাকা। এখন তা ৩৪০ টাকায় নেমে এসেছে। এ সময়ে ৬০ টাকা দর হারিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এর একটা বড় প্রভাব পড়েছে পুঁজিবাজারে। এ ছাড়া ব্যাংকগুলোর কাছে টাকা নেই।

সরকারের শীর্ষ মহল থেকে বার বার তাগাদা দেওয়ার পরও ব্যাংক ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামেনি। সবমিলিয়ে তারল্য সংকটে বাজারে লেনদেন বাড়ছে না।’ গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধিকেও নতুন সমস্যা আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, গ্যাসের দাম বাড়ায় কোম্পানিগুলোর মুনাফা কমতে পারে বলে ধারণা করছে বিনিয়োগকারীরা। যার প্রভাব পড়েছে বাজারে।

প্রথমত, ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট পাসের পর থেকে আবারও নগদ লভ্যাংশ দেওয়ার পরিবর্তে কোম্পানিগুলো আগামীতে ‘নো ডিভিডেন্ট’ ঘোষণা করবে এমন গুজব এবং ব্যাংক ও আর্থিক খাতের দুরাবস্থার খবরে হতাশা বিরাজ করছে পুঁজিবাজারে। পাশাপাশি সুশাসনের অভাবে বাজারে পুঁজিবাজারে দরপতন অব্যাহত রয়েছে বলে অভিযোগ বিনিয়োগকারীদের।

এছাড়াও গ্রামীণফোনের দেনা-পাওনা নিয়ে বিটিআরসি’র সঙ্গে দ্বন্ধ এবং পিপলস লিজিং কোম্পানির অবসায়ন ঘোষণায় নতুন করে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা ও তারল্য সংকট তৈরি হয়েছে। পুঁজি ফিরে পাওয়ার পরিবর্তে নতুন করে পৌনে ২৮ লাখ বিনিয়োগকারীদের সাড়ে ১৭ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। ফলে নতুন অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে। নতুন করে সৃষ্ট দরপতনের ফলে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আবারও বাড়ছে হাহাকার বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।

বাজেটে বলা হয়, নগদের পরিবর্তে বোনাস শেয়ার বিতরণের প্রবণতা কোম্পানিসমূহের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। এতে বিনিয়োগকারীরা তাদের প্রত্যাশিত লভ্যাংশ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এ জন্য বাজেটে বোনাস লভ্যাংশের ওপর কোম্পানিগুলোর জন্য ১০ শতাংশ কর ধার্য করা হয়েছে। এতে বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ প্রদানে নিরুৎসাহিত হবে।

দ্বিতীয়ত, বাজারে একাধারে তারল্য ও আস্থার সংকট চলছে। ব্যাংকিং খাতের বিশৃঙ্খলা, বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ ও মুদ্রা পাচারের কারণে বেশির ভাগ ব্যাংকে নগদ টাকার তীব্র অভাব চলছে। ব্যাংকে তারল্য তথা নগদ টাকার সংকট থাকায় পুঁজিবাজারেও তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে বাজেটের পর বাজারে কোনো গতির আভাস দেখা না যাওয়ায় বিনিয়োগকারীদের আস্থায় টান পড়েছে।

এর মধ্যেই ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’-এর মতো খবর এসেছে বড় বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ‘পিপলস লিজিং’ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। পরিচালকদের অনিয়ম, বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ ও আমানতকারীদের পাওনা পরিশোধে ব্যর্থতার কারণে কোম্পানিটিকে অবসায়িত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পিপলস লিজিংয়ের ঘটনার পর বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নতুন উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।

তৃতীয়ত, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর পুঁজিবাজার অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে কোনো কোনো মহল। তারা বিনিয়োগ থেকে বিরত থাকতে বা বিনিয়োগ উঠিয়ে ফেলার জন্য গুজব ছড়াচ্ছে যে, সামনে শেয়ারের দাম আরও কমবে। এগুজবের সাথে ডিএসই বড় বড় ব্রোকারেজ হাউজ ও মার্চেন্ট ব্যাংক জড়িত। এরা সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে পুঁজিবাজার ইস্যুতে নানা ষড়যন্ত্র করছে। এ ব্যাপারে বিএসইসি’র সজাগ থাকা উচিত। তা না হলে বড় ক্ষতির মুখে পড়বে বিনিয়োগকারীরা।

চতুর্থত, সার্বিকভাবে দেশ উন্নয়নে দিকে এগিয়ে যাচেছ। গত কয়েক বছরে সব সূচকের উন্নতির সঙ্গে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) দ্বিগুণ হয়েছে। বেড়েছ মোট জাতীয় আয়ও (জিএনআই)। তবে জিডিপির উন্নয়নের সঙ্গে সমানতালে এগোয়নি পুঁজিবাজার। অর্থনীতির আকার বাড়লেও অনেকটা পেছন পানে হাঁটছে ২৬ লাখের বেশি বিনিয়োগকারীর পুঁজিবাজার।

অনেকে পুঁজিবাজার থেকে মুখও ফিরিয়ে নিচ্ছে। অনেক সময় শেয়ারবাজার ইতিবাচক ধারায় ফেরার চেষ্টা করলে এই বিনিয়োগকারীরা ফিরে এসে কয়েক দিনের মধ্যে আবার হতাশ হয়ে ফিরে যায়। এই আস্থার অভাবেই পুঁজিবাজার অস্থিরতার নেপথ্যে কারন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

পঞ্চমত, বাজেটে শেয়ারবাজারের জন্য বেশকিছু প্রণোদনা দেওয়ার কথা বলা হলেও বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকট এমন জায়াগায় পৌঁছেছে যে, সে প্রণোদনাও এখন কাজ দিচ্ছে না। কারণ শেয়ারবাজারে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট কারসাজির মাধ্যমে বারবারই লুটে নিয়ে গেছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের টাকা। সরকার বা নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) সিন্ডিকেটের কারসাজি ঠেকাতে পারেনি। গত এপ্রিল-মে মাসে টানা দরপতনে মাত্র ২৫ দিনের ব্যবধানে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) মূলধন থেকে উধাও হয়ে যায় ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকা।