দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর তার প্রিয় সন্তান এরিক এরশাদকে কেন্দ্র করে রাজনীতির অভিযোগ উঠেছে। এরশাদের সাবেক স্ত্রী বিদিশা এরশাদ বলেছেন, তার সঙ্গে সন্তানকে দেখা করতে দেওয়া হচ্ছে না, এমনকি কথাও বলতে দেওয়া হচ্ছে না।

এদিকে এরশাদের মৃত্যুর পর বিদিশা জাপার রাজনীতিতে আবারও সক্রিয় হবেন বলে গুঞ্জন উঠেছে। দলের একটা অংশসহ রংপুর অঞ্চলের অনেক নেতাকর্মী তার সঙ্গে নিয়মিত যোগযোগ রাখছেন।

এমনকি এরশাদের ঘাঁটি রংপুর-৩ আসনে বিদিশাকে প্রার্থী হিসেবে দেখতে চান তার সমর্থকরা। বিদিশা বলছেন, ‘জাপার একটা প্রভাবশালী অংশ আমার জনপ্রিয়তাকে ভয় পায়। এ জন্য তারা এরিককে আমার থেকে দূরে রাখার মাধ্যমে জাপার সঙ্গে আমার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে চায়।’

এছাড়া সম্প্রতি বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিদিশা জাপার রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বিদিশা জাপার রাজনীতিতে সক্রিয় হলে তা দলের জন্য ইতিবাচক হবে। কারণ স্মার্ট ও ক্যারিশম্যাটিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহলে বিদিশার গ্রহণযোগ্যতা আছে। তাছাড়া দলেও তাকে ঘিরে নতুন করে উন্মাদনা শুরু হবে। তবে দলে সক্রিয় হতে গেলে তাকে কঠোর বাধার মুখে পড়তে হবে।

কারণ ইতোমধ্যেই এরিককে দূরে সরিয়ে রাখার মাধ্যমে সে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। কারণ এরশাদের সবচেয়ে আদরের সন্তান এরিকের মা হিসেবে রংপুরবাসীর মনে বিদিশার জন্য এক ধরনের সহানুভূতি রয়েছে। ফলে দলে প্রভাবশালী হয়ে উঠতে পারেন বিদিশা। রাজনৈতিক ঝুঁকির কথা বিবেচনা করে একটা প্রভাবশালী অংশ চায় না তিনি জাপায় ফিরুন।

জাপা সূত্র জানিয়েছে, এখনই বিদিশাকে নিয়ে কিছু ভাবছেন না দলের হাইকমান্ড। গত ১৪ জুলাই এরশাদের মৃত্যুর পরদিন ভারত থেকে দেশে ফিরে প্রেসিডেন্ট পার্কে যান বিদিশা। কিন্তু সেখানে তাকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। এ সময় ফেসবুক স্ট্যাটাসে তিনি লেখেন- ‘বাবার মৃত্যুতে আমার ছেলে এরিকের কান্নায় দেশবাসীও কেঁদেছে।

আমি পাগলের মতো ছুটে চলে এসেছি দেশে। কিন্তু দেশে এসেও বাধার শিকার। কোথায় স্বামীর লাশ? কোথায় ছেলে? আমার সঙ্গে এরিককে কথাও বলতে দেওয়া হচ্ছে না। বাবাকে হারিয়ে এরিকের অবস্থা ভালো না। সে ভালো নেই। সে একা রয়েছে। কান্নাকাটি করছে। আমি কিছুই চাই না, আমার সন্তানকে চাই।’

এরপর দলের সিনিয়র নেতারা যখন এরশাদকে ঢাকায় দাফনের কথা জানান তখন বিদিশা রংপুরে পল্লী নিবাসে দাফনের জন্য সওয়াল করেন। সেখানে দাফন হওয়ায় বিদিশা স্বস্তি প্রকাশ করেন। এরপরও এরিকের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন বিদিশা। এরশাদ জীবিত থাকতে এরিকের সঙ্গে নিয়মিত দেখা করার সুযোগ ছিল বিদিশার।

তবে এরশাদের মৃত্যুর পর তৈরি হয়েছে জটিলতা। তার অভিযোগ, ‘সম্পত্তি বা রাজনীতির কারণে তার সন্তানকে নিয়ে চক্রান্ত চলছে।’ এরপর বিদিশা অভিযোগ করেন, তার ছেলেকে বাবার কবরে একমুঠো মাটিও দিতে দেওয়া হয়নি।

এদিকে জানা গেছে, এরিক এরশাদকে নিজের জিম্মায় পেতে আইনি লড়াইয়ে নামছেন বিদিশা। আইনজীবীদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছেন তিনি। বাবার মৃত্যুর পর এরিকের জীবন সংশয়ে রয়েছে বলেও জানান বিদিশা।

জাপা সূত্রে জানা গেছে, বিদিশা ফের জাপার রাজনীতিতে সক্রিয় হতে ইচ্ছুক। বিচ্ছেদের পরও এরশাদের সঙ্গে তার প্রীতিপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। শেষদিকে বিদিশার সঙ্গে এরশাদের রাজনীতি নিয়েও নানা কথা হতো। ওই সময় থেকেই জাপা নেতাদের সঙ্গে তার নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। বিশেষ করে রংপুর অঞ্চলের নেতাকর্মীদের একটা অংশ বিদিশার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন। দলের খবরাখবরও পৌঁছে দেন।

জাপার এক সিনিয়র প্রেসিডিয়াম সদস্য নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, স্থানীয় কর্মী-সমর্থকদের একটা অংশ চায় রংপুর-৩ আসনে বিদিশা প্রার্থী হোন। বিদিশাও এ বিষয়ে আগ্রহী। কারণ এ আসনেই এরশাদের বাড়ি পল্লী নিবাস। এখানেই তার কবর। আর বাড়িটি এরিককে লিখে দিয়ে গেছেন এরশাদ। ফলে শিকড় হিসেবে এ আসনের সঙ্গে সংযোগ রাখতে চান বিদিশা।

স্থানীয় অনেক নেতাকর্মী বিদিশার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন নিয়মিত। এ আসন থেকে বিজয়ী হয়ে সংসদে গেলে এরিকের মা হিসেবে জাপায় বিদিশার উত্তরাধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত হবে। তবে দলের সিনিয়র নেতাদের বড় একটা অংশ বিদিশাকে দলে ফেরাতে নারাজ। এক্ষেত্রে দলে ক্রমশ বিদিশার প্রভাব বাড়বে এই শঙ্কায় তাকে সুযোগ দিতে নারাজ এ অংশটি।

জাপার ঘনিষ্ঠ কয়েকটি সূত্র জানিয়েছে, জি এম কাদের সদ্য দলের চেয়ারম্যান হয়েছেন। এখনো বিরোধীদলীয় নেতার পদ নির্ধারণ করা হয়নি। বিভিন্ন সময়ে এরশাদের স্ত্রী রওশনের সঙ্গে জি এম কাদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কথা প্রকাশ হয়েছে। ফলে এই মুহূর্তে বিদিশাকে দলে ফেরানোর ঝুঁকি নিতে ইচ্ছুক নন জি এম কাদের। তবে জাপার সিনিয়র অনেক প্রেসিডিয়াম সদস্য বিদিশাকে ধৈর্য ধরে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের পরামর্শ দিয়েছেন।

জানা গেছে, শিগগিরই এরশাদের কবর জিয়ারত করতে যাবেন তিনি। এ বিষয়ে বিদিশা বলেন, এরিককে নিয়ে যে নোংরা রাজনীতি শুরু হয়ে গেছে। তার বাবা এতদিন তাকে প্রটেকশান দিয়ে গেছেন। যারা কোনো দিন এরিককে একটা চকলেটও কিনে দেয়নি আজকে তারাই বিশাল আত্মীয়, গার্ডিয়ান, দাবিদার সাজছে। প্রেসিডেন্ট পার্ক, পল্লী নিবাস এরিককে দিয়ে গেছেন। তিনি ট্রাস্টের সবকিছু এরিককে দিয়ে গেছেন।

বিদিশা আরও বলেন, ‘নোংরা রাজনীতির কারণে আমাদের সংসার টেকেনি। আজ সেই নোংরা রাজনীতির কারণে মার কাছ থেকে সন্তানকে আলাদা করা হচ্ছে। এর কারণ কি এরিকের সম্পদ নাকি আমার জনপ্রিয়তাকে ভয়? আমি পল্টনের ময়দানে গেলে মানুষ জায়গা দিতে পারবে না। সবাই বলে রাজনীতিতে আসেন। রংপুরের মানুষের সঙ্গে আমার যোগাযোগ অনেক গভীর। এরশাদ সাহেব বলে গেছেন, আমি না থাকলে তুমি যাবা। নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা হয়।’

তিনি বলেন, আমি প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলাম, এখনো আছি। আমাকে বহিষ্কার করতে পারেনি। এরশাদের আসনে এলাকার মানুষ আমার নাম বলছে। আমি কি করবো বলেন? রংপুর চায়। তারা যদি মনে করে, আমার ছেলেকে আটকে রেখে আমাকে আটকে দেবে তা বোকামি। প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করব, এরিককে নিয়ে যেন কোনো নোংরা রাজনীতি না হয়। আমার ছেলে আমি ফেরত চাই। রংপুরের সঙ্গে আমার আত্মার সম্পর্ক। রংপুরবাসী এরশাদের ছায়া এরিকের মধ্যে পায়। তারা ভাবে, এরিকের মা আমাদের জন্য ভালো। এ জন্য একটা গোষ্ঠী চায় না আমি জাপায় ফিরি।

শাহতা জারাব এরিক (১৮) এরশাদ ও বিদিশার একমাত্র সন্তান। ২০০৫ সালে এরশাদ ও বিদিশার বিয়ে বিচ্ছেদ হয়। এরপর আদালতের নির্দেশে এরশাদ বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন সন্তান এরিকের দেখভালের দায়িত্ব পান।