দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: আজ দেশের উভয় পুঁজিবাজারে মূল্য সূচকের ব্যাপক দরপতন হয়েছে। হঠাৎ এ দরপতন বাজার সংশ্লিষ্টদের ভাবিয়ে তুলেছে। কারণ অর্থনীতির চারপাশেই সুখবর। সরকারও পুঁজিবাজারের উন্নয়নে বেশ মনোযোগি। তারপরও বাজার এভাবে ১০০ সূচকের বড় পতনের মুখে পড়বে এটি কেউ ভাবেনি। আজ সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবসে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) সূচকের ব্যাপক পতনে লেনদেন শেষ হয়েছে। এদিন ৯৬ পয়েন্ট সূচকের পতনে ডিএসই’র গেল আড়াই বছরের সর্বনিম্নে অবস্থানে নেমে এসেছে। লেনদেনের শুরু থেকেই সেল প্রেসারে টানা নামতে সূচক।

রোববার লেনদেন শেষে সূচকের পাশাপাশি কমেছে বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ার দর। আর টাকার অংকেও লেনদেন আগের দিনের তুলনায় কিছুটা কমেছে। আজ দিন শেষে ডিএসইতে লেনদেন হয়েছে ৩৬৮ কোটি ৬৪ লাখ ১৮ হাজার টাকা। এর আগে ২০১৬ সালের ২৮ ডিসেম্বর ডিএসই’র সূচক ছিলো ৫ হাজার ২৭ পয়েন্ট।

সংশ্লিষ্টরা জানান, দরপতনই শেয়ারবাজারের নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর ধস নামার পর মাঝে কিছুদিন ঊর্ধ্বমুখী থাকলেও কখনও স্বস্তিতে ছিলেন না বিনিয়োগকারীরা। আওয়ামী লীগ সরকার নতুন মেয়াদে দায়িত্ব নেওয়ার পর অর্থমন্ত্রীর ঘোষণায় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়।

বিশেষত জানুয়ারির পর টানা কয়েক মাসের দরপতনের প্রেক্ষাপটে তিনি বাজেটে প্রণোদনা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। ওই ঘোষণায় অনেক বিনিয়োগকারী আশ্বস্ত ছিলেন। কিন্তু বাজেট ঘোষণার পর হতাশ হয়েছেন তারা। ফলে ফের দরপতন শুরু হয়েছে। বাজেট পাসের পর দরপতনের মাত্রা বেড়েছে।

বাজার সংশ্লিষ্টরা, পুঁজিবাজারে বড় দরপতনের পেছনে কিছু কারণ সনাক্ত করেছেন। এর মধ্যে প্রথম কারনটি হলো নানা গড়মিল থাকা সত্ত্বেও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) তালিকাভুক্ত হতে যাচ্ছে বহুল আলোচিত কপারটেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। আর এমন ইস্যু মেনে নিতে পারছেন না বিনিয়োগকারীরা। সে জন্যই আজ ডিএসইতে প্রায় ১০০ পয়েন্টের মতো সূচক পড়েছে বলে ধারনা করেছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।

দরপতনের আরেকটি কারন বলে অভিজ্ঞ বিনিয়োগকারীরা বলেন, পুঁজিবাজারে দরপতনের প্রধান কারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের অভাব। আর বিনিয়োগকারীরা এই আত্মবিশ্বাস হারিয়েছে আর্থিক খাতের বিপর্যয়ে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক পিপলস লিজিংয়ের অবসায়নের ঘোষণায় পুরো আর্থিক খাতে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। যার প্রভাব পড়েছে পুঁজিবাজারে। এছাড়াও ব্যাংক খাতের তারল্য সংকট এবং খেলাপিঋণ বেড়ে যাওয়ায় পুঁজিবাজারে বড় ধরনের অস্থিরতা দেখা দিয়েছে।

বাজারের এমন পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে ব্র্যাক ইপিএল স্টক ব্রোকারেজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শরীফ এমএ রহমান দেশ প্রতিক্ষণকে বলেন, পুঁজিবাজারে ভালো শেয়ার কেনার লোক নেই। সবাই বসে আছে আরও কত কমে শেয়ার কেনা যায়। এই প্রবণতা এখন প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের মাঝে প্রকট হয়েছে। বিদেশিরা ভালো মৌলভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানির শেয়ার বিক্রি করছে; যা স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা কিনছেন না। এতে বাজার ইনডেক্স প্রভাব পড়ছে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. মির্জা আজিজুল ইসলাম দেশ প্রতিক্ষণকে বলেন, পুঁজিবাজারে এ মুহূর্তে যা ঘটছে তা চরম আস্থাহীনতার বহিঃপ্রকাশ। বিগত বেশ কিছুদিন থেকে যেভাবে বাজার চলছে তাতে মনে হয় অর্থনীতির প্রধান এ খাতটির যেন কোনো অভিভাবকই নেই। বাজেট ঘোষণার বেশ কিছু দিন আগে থেকেই বলা হচ্ছিল বাজেটে পুঁজিবাজারের জন্য অনেক প্রণোদনা থাকবে। এর ফলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে যে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল বাজেট ঘোষণার পর তা তাদেরকে হতাশ করে। এরই মধ্যে আবার বোনাস লভ্যাংশ ও রিজার্ভের করারোপসহ কিছু কিছু বিষয় বাজারে উল্টো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। যার প্রকাশ ঘটছে বাজারের সাম্প্রতিক আচরণে।

মির্জা আজিজ আরো বলেন, এ মুহূর্তে বাজারে ভালো শেয়ারের প্রচণ্ড অভাব রয়েছে। ভালো কোম্পানির তালিকাভুক্তির বিষয়ে সরকার বা নিয়ন্ত্রক সংস্থার কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। ভালো কোম্পানি না হলে কিসে মানুষ বিনিয়োগ করবে? বাজারে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি করতে হবে। আর ভালো শেয়ার না পেলে কেনইবা কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বড় অঙ্কের দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ করবে? আর প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ ছাড়া শুধু ব্যক্তি বিনিয়োগ দ্বারা পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতা ধরে রাখা সম্ভব নয়।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ প্রফেসর আবু আহমেদ দেশ প্রতিক্ষণকে বলেন, দীর্ঘ দিন পুঁজিবাজারে মন্দা চলতে থাকায় বাজেটে পুঁজিবাজারের প্রণোদনা নিয়ে বিনিয়োগকারীদের বড় ধরনের প্রত্যাশা ছিল যা বাজেট ঘোষণার পর তাদের হতাশ করে। এ ছাড়া আর্থিক খাতের একটি কোম্পানির অবসায়ন বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থাহীনতার মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেয়। পুরো ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এর ফলে টানা দরপতনের মধ্য দিয়েই পার করছে যার প্রভাব পড়ছে বাজার সূচকে। আর বাজার যখন ধারাবাহিক পতনের মধ্য দিয়ে যায় তখন বিনিয়োগকারীদের মাঝে আতঙ্ক তৈরি হয়।