দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: প্রশ্নবিদ্ধ আর্থিক প্রতিবেদন দিয়ে আইপিও অনুমোদন নেওয়ার পর ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) কপারটেক ইন্ডাস্ট্রিজকে তালিকাভুক্তি না করার সিদ্ধান্ত নিলেও নানামুখী চাপে এখন পিছু হটছে। আর্থিক হিসাবে ‘গরমিল’ করে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ উত্তোলন করায় কোম্পানিটির তালিকাভুক্তি আটকে দিয়েছিল ডিএসই।

অব্যাহত দরপতনে হতাশ বিনিয়োগকারীরা প্রশ্ন তুলেছেন তাহলে কপারটেক ইন্ডাস্ট্রিজ কর্তৃপক্ষ ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ থেকেও শক্তিশালী! ইতোমধ্যে ডিএসই’র পরিচালনা পর্ষদ কপারটেক ইন্ডাস্ট্রিজকে তালিকাভুক্ত করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

এ বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে ব্যবস্থাপনা পর্ষদকে (ম্যানেজমেন্ট) দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এমন উদ্যোগ নেওয়া হলেও ডিএসইর তালিকাভুক্তির নীতিমালা অনুযায়ী কোম্পানিটির তালিকাভুক্তির যোগ্যতা নেই। ডিএসই’র তালিকাভুক্তির নীতিমালা অনুযায়ী, কোনো কোম্পানি প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে টাকা উত্তোলন করলে ওই কোম্পানির আইপিও সাবস্ক্রিপশন (আইপিও আবেদন গ্রহণ) শেষ হওয়ার ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে তালিকাভুক্ত হতে হবে।

নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) গত বছরের ডিসেম্বর ১০ টাকা অভিহিত মূল্যে দুই কোটি সাধারণ শেয়ার ছেড়ে পুঁজিবাজার থেকে কপারটেক ইন্ডাস্ট্রিজকে ২০ কোটি টাকা উত্তোলনের অনুমোদন দেয়। বিএসইসির অনুমোদন নিয়ে চলতি বছরের ৩১ মার্চ থেকে ৯ এপ্রিল পর্যন্ত আইপিও আবেদন গ্রহণ করে কোম্পানিটি।

বাজার সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আইপিও আবেদন গ্রহণের ফলে চলতি বছরের ২৬ মে’র মধ্যে কোম্পানিটি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্তির বাধ্যবাধকতা ছিল। কিন্তু ডিএসই পর্ষদ অনুমোদন না দেয়ায় কোম্পানিটির তালিকাভুক্তি আটকে যায়। এরপর ডিএসই’র পর্ষদ কোম্পানিটিকে তালিকাভুক্তির জন্য ২৩ জুন পর্যন্ত সময় দিয়ে বিএসইসির কাছে দিকনির্দেশনা চেয়ে চিঠি দেয়। তবে বিএসইসি ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে কোনো দিকনির্দেশনা বা পরামর্শ দেওয়া থেকে বিরত থাকে।

বিএসইসি নীরব থাকলেও কপারটেকের আর্থিক প্রতিবেদন খতিয়ে দেখতে উদ্যোগ নেয় ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল (এফআরসি)। ফলে ডিএসই’র পর্ষদ কপারটেক ইন্ডাস্ট্রিজকে তালিকাভুক্ত না করার সিদ্ধান্তে অনড় থাকে। এর মধ্যেই ২৩ জুন (শেষদিন) চলে যাওয়ায় নিয়মতান্ত্রিক তালিকাভুক্তির যোগ্যতা হারিয়েছে কোম্পানিটি।

তবে কপারটেক ইন্ডাস্ট্রিজ নিয়মতান্ত্রিকভবে তালিকাভুক্ত হওয়ার যোগ্যতা হারানোর পর হঠাৎ করেই পিছু হটার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ডিএসই পর্ষদ। অদৃশ্য কারণে প্রধান পুঁজিবাজারের পরিচালনা পর্ষদ এখন কোম্পানিটিকে তালিকাভুক্তির পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।

হঠাৎ এমন ইউটার্ন নেয়ার বিষয়ে ডিএসই’র পরিচালনা পর্ষদের এক সদস্য বলেন, নানামুখী চাপে কপারটেক ইন্ডাস্ট্রিজকে তালিকাভুক্তির পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে। কোথা থেকে, কীভাবে এসব চাপ আসছে তা আপনিও জানেন, আমিও জানি। কিন্তু কিছু বলার উপায় নেই।

এ ব্যাপারে ডিএসই’র পরিচালক শরিফ আতাউর রহমান বলেন, কপারটেক তালিকাভুক্তির বিষয়ে ম্যানেজমেন্টকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। কোম্পানিটিকে তালিকাভুক্ত না করলে কী লাভ হবে? তালিকাভুক্ত হলে বাজারে কিছু টাকা আসবে। এসব বিষয় বিবেচনা করে পর্ষদ সভার মাধ্যমে কপারটেকের তালিকাভুক্তির পদক্ষেপ নিতে ম্যানেজমেন্টকে বলা হয়েছে। তবে ডিএসই’র অপর পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বলেন, আমরা কপারটেককে তালিকাভুক্তির অনুমোদন দেইনি। কোম্পানিটিকে তালিকাভুক্তির বিষয়ে আমি একমত নই।

তিনি বলেন, ২৬ মে ও ২৩ জুন পার হওয়ার পর তালিকাভুক্তির জন্য আইনগত কোনো সমস্যা আছে কি-না, তা দেখতে ম্যানেজমেন্টকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এখন আইনগত বিষয়টি ম্যানেজমেন্ট দেখবে। তিনি আরও বলেন, কপারটেক ইন্ডাস্ট্রিজকে তালিকাভুক্ত করা পুঁজিবাজারের জন্য একটা খারাপ উদাহরণ হয়ে থাকবে। বিষয়টি আমাদের জন্য বিব্রতকর এবং এ জাতীয় ইস্যু আমাদের জন্য নতুন। আমরা চাই, এমন পরিস্থিতি ভবিষ্যতে যাতে আর না হয়।

এ বিষয় যোগাযোগ করা হলে কপারটেক ইন্ডাস্ট্রিজের ইস্যু ম্যানেজার এমটিবি ক্যাপিটালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খায়রুল বাশার বলেন, নিয়মতান্ত্রিকভাবে তালিকাভুক্তির সময় পার হয়ে যাওয়ায় বিশেষ ব্যবস্থায় কপারটেক ইন্ডাস্ট্রিজকে তালিকাভুক্ত করা হবে। এর আগেও এমন ঘটনা ঘটেছে। বিষয়টি স্টক এক্সচেঞ্জ ও কমিশনের (বিএসইসি) এখতিয়ার।

কপারটেক ইস্যুতে নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান আহমেদ অ্যান্ড আক্তারের লাইসেন্স হারানোর বিষয়ে তিনি বলেন, আহমেদ অ্যান্ড আক্তার শুধু কপারটেকের কারণে লাইসেন্স হারিয়েছে, বিষয়টি এমন নয়। আইসিএবির কাছে আহমেদ অ্যান্ড আক্তারের বিষয়ে অতীতেও অনেক অভিযোগ আছে।

ডিএসইতে কপারটেক ইন্ডাস্ট্রিজ তালিকাভুক্তির জন্য বিভিন্ন ভাবে চাপ দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে খায়রুল বাশার বলেন, আমি সামান্য মানুষ। নরমাল একটি চাকরি করি। সরকারের কোনো মন্ত্রী, ক্ষমধর কোনো রাজনীতিবিদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক নেই। বিএসইসি’র অনুমোদন নিয়ে আইপিওর মাধ্যমে ২০ কোটি টাকা উত্তোলন করেছে কপারটেক ইন্ডাস্ট্রিজ।

কোম্পানিটিকে আইপিওতে আনতে ইস্যু ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেছে এমটিবি ক্যাপিটাল। আর্থিক প্রতিবেদন নিরীক্ষা করে আহমেদ অ্যান্ড আক্তার। বিএসইসি’র অনুমোদন নিয়ে আইপিও আবেদন গ্রহণের পর তালিকাভুক্তির জন্য ডিএসইতে আবেদন করে কোম্পানিটি। তবে আর্থিক প্রতিবেদনে অস্বচ্ছতার অভিযোগ ওঠায় ডিএসই থেকে কপারটেক ইন্ডাস্ট্রিজের তালিকাভুক্ত আটকে দেয়া হয়।

পাশাপাশি ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিলে (এফআরসি) অভিযোগ করা হয়। কপারটেকের আর্থিক প্রতিবেদন খতিয়ে দেখতে এফআরসি থেকে দ্য ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএবি) কে দায়িত্ব দেয়া হয়।

এর ভিত্তিতে আইসিএবি তদন্তে নামলে তাতে অসহযোগিতা করে কপারটেকের নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান আহমেদ অ্যান্ড আক্তার। ফলে প্রাথমিক নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে আইসিএবি নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানটির লাইসেন্স নবায়ন না করার সিদ্ধান্ত নেয়। এর আগে দেশের ইতিহাসে এমন ঘটনা ঘটেনি।

অবশ্য আইসিএবি’র তদন্ত চলাকালে কপারটেক ইন্ডাস্ট্রিজকে তালিকাভুক্তির অনুমোদন দেয় অপর পুঁজিবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই)। এরপর ডিএসই’র কাছে থাকা এলিজিবল ইনভেস্টরদের (ইআই) আইপিও সাবস্ক্রিপশনের টাকা কোম্পানিটির ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পাঠানোর জন্য বিএসইসি থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়।

বিএসইসি’র ওই নির্দেশনার পর আইসিএবি থেকে কপারটেকের নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান আহমেদ অ্যান্ড আক্তারের লাইসেন্স নবায়ন না করার সিদ্ধান্ত আসে। ফলে বিএসইসি নির্দেশ দিলেও কপারটেকের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে এলিজিবল ইনভেস্টরদের আইপিও সাবস্ক্রিপশনের টাকা পাঠানো থেকে বিরত থাকে ডিএসই।