এফ জাহান,দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত মিউচুয়াল ফান্ড বিপথে পরিচালিত হচ্ছে। বাইরের দেশে মিউচুয়াল ফান্ড শেয়ারবাজারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যারা শেয়ারবাজার ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করে বিনিয়োগ করতে পারেন না, তারা সাধারণত মিউচুয়াল ফান্ডের মাধ্যমে বিনিয়োগ করেন।

কিন্তু বাংলাদেশে মিউচুয়াল ফান্ডগুলোর চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। তালিকাভুক্ত অধিকাংশ মিউচুয়াল ফান্ডই রয়েছে দুরবস্থার মধ্যে। ফলে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহের শেষে রয়েছে এসব ফান্ড। এর ফলে নতুন বা সাধারণ বিনিয়োগকারীরা প্রতিনিয়ত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

এদিকে মন্দাবাজারে বিনিয়োগকারীদের নতুন করে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে মিউচুয়াল ফান্ড। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা নিজেদের মধ্যে যোগসাজশ করে একেকটি ফান্ডের মূল্য চারগুণ করে ফেললেও নিয়ন্ত্রক সংস্থা নিশ্চুপ রয়েছে আজানা কারণে।

এমনকি প্রাথমিক রেগুলেটর হিসেবে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জও কোন পদক্ষেপ নেয়নি। আরও বাড়তে পারে এমন আশাবাদে সর্বস্ব হারানো বিনিয়োগকারী হাতের শেয়ার লোকসানে বিক্রি করে নতুন করে ফান্ড কিনছেন।

কিন্তু লভ্যাংশ হিসেবে তারা ইউনিটের বিপরীতে পাবে সামান্যই। কোন কারণে ক্রেতা সরে গেলে দীর্ঘমেয়াদে নিঃস্ব হয়ে যাবেন বিনিয়োগকারীরা। এমন একটি ফান্ডের নাম এসইএমএল এফবিএলএস গ্রোথ ফান্ড। গত ১৭ কার্যদিবসে ফান্ডটির দর বেড়েছে ৩০.৪০ টাকা। অর্থাৎ আগের চেয়ে প্রায় ৩০০ গুণের বেশি। কিন্তু ডিএসইর কোন হেলদোল নেই।

বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, চলতি মাসের ২ তারিখে ফান্ডটির মূল্য ছিল ১০ টাকা। গতকাল বুধবারে লেনদেন শেষে ফান্ডটির প্রতিটির মূল্য দাঁড়িয়েছে ৪০.৪০ টাকা। এই দিনে ফান্ডটির মোট ১ লাখ ৭ হাজার ৫২৫টি ইউনিটের লেনদেন হয়েছে। গত ১৫ জুলাই ফান্ডটির মোট ১ লাখ ৬০ হাজার ইউনিটের লেনদেন হয়েছে। ১০ জুলাই ফান্ডটির ৩ লাখ ৪০ হাজার ইউনিটের লেনদেন হয়েছে, যা গত দুই বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

এদিকে ফান্ডটির দর ১৭ কার্যদিবসে ৩শ’ শতাংশের ওপর বাড়লেও নিশ্চুপ ডিএসই। অন্য কোম্পানির দর ১০ শতাংশ বাড়লেই ডিএসইর পক্ষ থেকে ব্রোকারেজ হাউসগুলোকে চিঠি পাঠিয়ে বিনিয়োগকারীর তথ্য চাওয়া হয়। কিন্তু এই ফান্ডের বিষয়ে উদাসীন ডিএসই কর্তৃপক্ষ।

ডিএসইর ওয়েবসাইট সূত্রে জানা গেছে, ফান্ডটি পরিশোধিত মূলধন ৭২ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৫১.৪১ শতাংশ উদ্যোক্তা পরিচালকদের কাছে, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে ৪৮.৪৪ শতাংশ ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে দশমিক ১৫ শতাংশ ইউনিট রয়েছে।

এদিকে ওপরের ফান্ডটির অস্বাভাবিক দর বাড়ার কারণে এই সম্পদ ব্যবস্থাপনা স্ট্র্যাস্টেজিক বাংলাদেশের অন্য দুই ফান্ডেরও বিক্রেতাশূন্য অবস্থায় লেনদেন হয়েছে। শুধু তাই নয়, বুধবারে শেয়ারের মোট ১০টির বেশি ফান্ডের বিক্রেতাশূন্য অবস্থায় লেনদেন হয়েছে।

বিশ্লেষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিনিয়োগকারীদের কাছে ইউনিট না থাকার কারণে মন্দাবাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের একটি অংশ অশুভ খেলায় মেতেছে। লোভে পড়ে বিনিয়োগকারীরা এসব ফান্ডে বিনিয়োগ শুরু করলে আস্তে আস্তে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা বিক্রি করে বের হয়ে যাবেন। দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতির শিকার হবে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। তাই তাদের মৌলভিত্তি বিবেচনার শেয়ার কেনা উচিত।

এসইএমএল এফবিএলএসএল গ্রোথ ফান্ডের ইউনিট এখন কেনাবেচা হচ্ছে তার সম্পদ মূল্যের প্রায় আড়াই গুণ দামে। শুধু সম্পদ মূল্য নয়, ফান্ডটির ইউনিট তার আয়ের তুলনায়ও এর ইউনিটের দাম সব স্বাভাবিকতাকে ছাড়িয়ে গেছে। তবে শুধু এসইএমএল এফবিএলএসএল ফান্ডই নয়, তালিকাভুক্ত অন্যান্য ফান্ডের ইউনিটের দামও যৌক্তিক পর্যায় ছাড়িয়ে গেছে, যা এসব ইউনিটের বিনিয়োগকে ঝুঁকির দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

বাজার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স¤প্রতি বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) মিউচুয়াল ফান্ডে রি-ইনভেস্টমেন্ট ইউনিট (আরআইইউ) নিষিদ্ধ করার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাতেই হুজুগে মেতেছে অনেক বিনিয়োগকারী। আরআইইউ বন্ধ করায় ফান্ডগুলোকে এখন থেকে নগদ লভ্যাংশ দিতে হবে।

বিনিয়োগকারীদের অতি আগ্রহকে ব্যবহার করে মিউচুয়াল ফান্ডের ইউনিটের দাম নিয়ে কারসাজিও করে থাকতে পারে অসাধু কোনো গোষ্ঠি। উল্লেখ, বিশ্বব্যাপি মিউচুয়াল ফান্ডের ইউনিট সাধারণত তার এনএভির ১০ শতাংশ বেশি থেকে ১০ শতাংশ কম-এই ব্যান্ডে কেনাবেচা হয়ে থাকে। এর কম-বেশি হলেই তাকে অস্বাভাবিক মনে করা হয়।

বাজার বিশ্লেষকদের মতে, মিউচুয়াল ফান্ডসহ পুঁজিবাজারের সব ইন্সট্রæমেন্টে বিনিয়োগের বিষয়টি যুক্তির সঙ্গে দেখতে হবে। বিএসইসির সিদ্ধান্তের কারণে মিউচুয়াল ফান্ডগুলো নগদ লভ্যাংশ দিতে বাধ্য হলেও কত শতাংশ লভ্যাংশ দেবে তা নির্ভর করবে ফান্ডের আয়ের উপর। পুঁজিবাজারে টানা মন্দাবস্থার কারণে বেশিরভাগ ফান্ডের ইউনিটের আয় মোটেও সন্তুষজনক নয়।

আলোচিত ফান্ডটির ইউনিট প্রতি আয় ছিল মাত্র ৩ পয়সা। হিসাববছরের সর্বশেষ প্রান্তিকেও আহামরি কোনো আয়ের সুযোগ ছিল না। তাই খুব আকর্ষণীয় লভ্যাংশ আসবে এমন সম্ভাবনাও নেই। তাই বিনিয়োগকারীরা সতর্ক ও সংযত না হলে তাদেরকে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হতে পারে।