দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: অনিয়ম-দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনায় নাজুক দেশের ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো (এনবিএফআই)। এ খাতের ৯ কোম্পানি এখন সবচেয়ে নাজুক পরিস্থিতিতে অর্থাৎ ‘রেড জোনে’অবস্থান করছে। চাপ সহনশীল (স্ট্রেস টেস্টিং) প্রতিবেদনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠানগুলোকে এ জোনে ফেলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তালিকায় ‘রেড জোনে’ থাকা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো হলো: বিআইএফসি, পিপলস লিজিং, ফার্স্ট ফাইন্যান্স, প্রিমিয়ার লিজিং, ফারইস্ট ফাইন্যান্স, প্রাইম ফাইন্যান্স, মাইডাস ফাইন্যান্সিং, জিএসপি ফাইন্যান্স ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্স।

আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা জানার জন্য কয়েকটি সূচকের ওপর বিশেষ পদ্ধতিতে নিরীক্ষা চালায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে প্রতিষ্ঠানগুলোর সুদহার বৃদ্ধিজনিত ঝুঁকি, ঋণঝুঁকি, সম্পত্তির (ইকুইটি) মূল্যজনিত ঝুঁকি ও তারল্য অভিঘাত এ চার ঝুঁকি বিবেচনায় নেয়া হয়।

নিরীক্ষার ভিত্তিতে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। ভালোগুলোকে ‘গ্রিন’ জোন, ভালোর চেয়ে একটু খারাপ অবস্থায় থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো ‘ইয়েলো’ জোনে এবং চরম খারাপ অবস্থায় থাকাগুলোকে ‘রেড’ জোনে ভাগ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এছাড়া অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কারণে চরম সংকটে পড়া পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই কারণে বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানির (বিআইএফসি) অবসায়ন চেয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে মন্ত্রণালয়ের মতামত এখনও পাওয়া যায়নি।

ব্যাংকবহির্ভূত এই দুই আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বাইরে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়েও ফার্স্ট ফাইন্যান্সের উন্নতি করতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। লিজিং কোম্পানি নামে পরিচিত আরও নয়টি প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ রয়েছে দুই অঙ্কের ঘরে। এর মধ্যে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান অনেক ক্ষেত্রে আমানতকারীর জমানো টাকা ফেরত দিতে পারছে না। নাজুক অবস্থায় থাকা এমন ৯ আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে রেড জোন বা লাল তালিকাভুক্ত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

লুটপাট, অনিয়ম-দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনায় ধুঁকছে দেশের ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই)। নামে-বেনামে নিচ্ছে ঋণ। আমানতের টাকা নিয়ে চলছে হরিলুট। লাগামহীন বাড়ছে খেলাপি ঋণ। সম্পদও খেয়ে ফেলছে অনেক প্রতিষ্ঠান। তারল্য সংকটে ধারদেনা করে চলছে। আর্থিক দুরবস্থায় আমানতের টাকাও ফেরত দিতে হিমশিম খাচ্ছে অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান।

বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে লাইসেন্স নিয়ে বর্তমানে দেশে ৩৪টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম চালছে। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ও তারল্য সংকটে রয়েছে বেশকিছু প্রতিষ্ঠান। ইতোমধ্যে চরম সংকটে থাকা পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (পিএলএফএসএল)- এর অবসায়ন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নড়বড়ে অবস্থায় রয়েছে আরও তিন আর্থিক প্রতিষ্ঠান।

আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা জানার জন্য কয়েকটি সূচকের ওপর বিশেষ পদ্ধতিতে নিরীক্ষা চালায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে প্রতিষ্ঠানগুলোর সুদহার বৃদ্ধিজনিত ঝুঁকি, ঋণঝুঁকি, সম্পত্তির (ইকুইটি) মূল্যজনিত ঝুঁকি ও তারল্য অভিঘাত এ চার ঝুঁকি বিবেচনায় নেয়া হয়।

প্রতিষ্ঠানগুলোকে লাল, হলুদ ও সবুজ তালিকাভুক্ত করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর মধ্যে বর্তমানে খুব খারাপ অর্থাৎ লাল তালিকায় রয়েছে ১২টি প্রতিষ্ঠান। হলুদ তালিকায় রয়েছে ১৮টি প্রতিষ্ঠান। মাত্র চারটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে সবুজ বা সবচেয়ে ভালো তালিকায়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ‘রেড জোন’ বা লাল তালিকায় থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- বিআইএফসি, পিপলস লিজিং, ফার্স্ট ফাইন্যান্স, প্রিমিয়ার লিজিং, ফারইস্ট ফাইন্যান্স, প্রাইম ফাইন্যান্স, মাইডাস ফাইন্যান্সিং, জিএসপি ফাইন্যান্স ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্স।

পিপলস লিজিংয়ের মতো অন্যান্য যেসব আর্থিক প্রতিষ্ঠান সংকটে রয়েছে তাদের অবসায়ন করা হবে কি-না, জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক শাহ আলম জানান, আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষার দায়িত্ব আমাদের অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংকের। এজন্য যা যা করা দরকার আইন অনুযায়ী তা-ই করা হচ্ছে। আমরা আমানতকারী ও শেয়ারহোল্ডারদের আশ্বস্ত করতে চাই যে, তারা যেন কোনো বিপদে না পড়ে সেজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক সজাগ রয়েছে।

দুরবস্থায় শীর্ষে বিআইএফসি: আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে দুরবস্থায় শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি)। নানা অনিয়মে বিতরণ করা ঋণ ফেরত পাচ্ছে না প্রতিষ্ঠানটি। ফলে হচ্ছে খেলাপি। খোয়া যাচ্ছে মূলধন।

নানা সংকটে আমানতকারীদের অর্থও ফেরত দিতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটি। এসব অনিয়মের কারণে বিআইএফসি-কে অবসায়ন করতে চাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ইতোমধ্যে অবসায়নের মতামত চেয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়কে চিঠিও দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, পরিচালনা পর্ষদের অযাচিত হস্তক্ষেপে দেয়া হয়েছে ঋণ। এখন তা ফেরত আসছে না। ফলে বিআইএফসির মোট ঋণের ৯৬ শতাংশই খেলাপি। কোনো পরিচালন আয় না থাকায় প্রতি মাসে গড়ে সাড়ে ছয় কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটির।

ন্যূনতম ১০০ কোটি টাকার মূলধন রাখার বাধ্যবাধকতা থাকলেও বিআইএফসিতে রয়েছে মাত্র ২৩ কোটি টাকা। এ কারণে বিপাকে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটি। পর্ষদ ভেঙে দিয়েও কোনো ফল আসেনি। রাজনৈতিক প্রভাবে অনিয়ম করেও পার পাচ্ছেন সাবেক-বর্তমান পরিচালকগণ।

ফার্স্ট ফাইন্যান্সের পর্ষদ ভেঙেও কাজ হচ্ছে না: সংকটে থাকা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম হলো ফার্স্ট ফাইন্যান্স। পরিচালককে ঋণ প্রদানের অনুমোদনের ক্ষেত্রে অনিয়ম, লাগামহীন খেলাপি ঋণ এবং অর্থ সংকটে থাকা আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি এখন সময়মতো আমানতকারীদের অর্থও ফেরত দিতে পারছে না। নানা অনিয়মের অভিযোগে পর্ষদ ভেঙে দিয়ে পর্যবেক্ষক বসিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তারপরও কোনো লাভ হয়নি। এখন ধুঁকে ধুঁকে শেষ হচ্ছে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ফার্স্ট ফাইন্যান্স।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, প্রতিষ্ঠানটির খেলাপি ঋণ রয়েছে ৪৯ দশমিক ৬৫ শতাংশ। প্রয়োজনের তুলনায় প্রতিষ্ঠানটির মূলধন কম রয়েছে ২০ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটি এতটাই সংকটে পড়েছে যে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বিধিবদ্ধ জমা সংরক্ষণের (সিআরআর) মতো টাকা নেই। যে কারণে গত বছর এক কোটি টাকা জরিমানা দিতে হয়েছে।

সম্প্রতি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রকাশিত প্রতিষ্ঠানটির নিরীক্ষা প্রতিবেদন বলছে, তাদের এক পরিচালককে ঋণ দিতে অনিয়ম করা হয়েছে। নানা সমস্যায় জর্জরিত ফার্স্ট ফাইন্যান্স দীর্ঘদিন ধরে শেয়ারহোল্ডারদের কোনো লভ্যাংশ দিতে পারছে না। ফলে কোম্পানিটি এখন পঁচা বা ‘জেড’ গ্রুপের তালিকায় রয়েছে। লোকসানে থাকা প্রতিষ্ঠানটি ২০১৪ সাল থেকে কোনো লভ্যাংশ দিতে পারেনি।

নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ফার্স্ট ফাইন্যান্স কর্তৃপক্ষ শেয়ারহোল্ডারদের অনুমোদন ছাড়াই এক পরিচালককে ৭০ লাখ টাকা ঋণ প্রদানের অনুমোদন দেয়। তবে এ বিষয়ে আগামী বার্ষিক সাধারণ সভায় (এজিএম) শেয়ারহোল্ডারদের অনুমোদন নেয়া হবে বলে নিরীক্ষককে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ জানায়।

২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ক্যাশ রিজার্ভ রিকোয়ারমেন্ট (সিআরআর) ঘাটতির জন্য ফার্স্ট ফাইন্যান্স-কে ২০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। জুলাই মাসে ফের সিআরআর ঘাটতির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক কোম্পানিটিকে ৬২ লাখ ৩৮ হাজার টাকা জরিমানা করে। তবে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ ওই জরিমানা মওকুফের জন্য আবেদন করেছে এবং শাস্তির বিপরীতে ১০ লাখ টাকা সঞ্চিতি গঠন করেছে।

প্রিমিয়ার লিজিংয়ের মূলধন ঘাটতি ১৭ কোটি: নানা সংকটের কারণে সমস্যায় পড়েছে প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স লিমিটেড। ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির মোট ঋণের ২৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। এর মূলধন ঘাটতি রয়েছে প্রায় ১৭ কোটি টাকা।

সর্বশেষ হিসাব বছরে ৫ শতাংশ লভ্যাংশ দেয়া পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানটি ‘এ’ ক্যাটাগরি থেকে ‘বি’ ক্যাটাগরিতে নেমে গেছে। সময়মতো আমানতকারীদের অর্থও ফেরত দিতে পারছে না তারা।

এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, দেশের আর্থিক খাত নানা সমস্যায় ভুগছে। এর মূল কারণ প্রতিষ্ঠানগুলোর পর্ষদই ঋণ অনিয়মে জড়িয়ে পড়ছে। উচ্চপর্যায়ের লোকেরা যখন অনিয়ম করে তার পরিণতি হয় ভয়াবহ।

তিনি বলেন, গ্রাহককে প্রলোভন দেখিয়ে উচ্চ সুদে আমানত সংগ্রহ করছে, আবার ঋণ বিতরণে কোনো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে না। এতে ঋণ ফেরতও আসছে না। খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া নগদ অর্থ সংকট তো রয়েছে। সঠিক সময়ে আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে না পারাই বড় সমস্যা- উল্লেখ করে প্রবীণ এ অর্থনীতিবিদ বলেন, এটি চলতে থাকলে গ্রাহক আর আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আমানত রাখবে না।

যা আগামীতে ভয়ঙ্কর অবস্থা সৃষ্টি করবে। একটি প্রতিষ্ঠানকে অবসায়ন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এটি আরও আগে নেয়া প্রয়োজন ছিল। এছাড়া যারা খারাপ অবস্থায় রয়েছে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া দরকার।