মোবারক হোসেন, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধিতে এরই মধ্যে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত সিমেন্ট খাতের বহুজাতিক সিমেন্ট কোম্পানি হাইডেলবার্গ সিমেন্ট বাংলাদেশ লিমিটেড দ্বিতীয় প্রান্তিকে লোকসানে পড়েছে। উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় দেশের শীর্ষস্থানীয় সিমেন্ট উৎপাদনকারী এ কোম্পানিটি চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে ৪ কোটি টাকা নিট লোকসানে পড়েছে। হাইডেলবার্গ সিমেন্টের অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় এমন তথ্য মিলেছে।

কাঁচামাল, জ¦ালানি ও পরিবহন ব্যয় বাড়ার কারণে আড়াই বছর ধরে সংকটে রয়েছে দেশের সিমেন্ট শিল্প। উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে এ খাতের বেশিরভাগ কোম্পানির নিট মুনাফা কমে গেছে। পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০১৬ সালের পর থেকে সিমেন্টের প্রধান কাঁচামাল ক্লিংকারের মূল্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বেড়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ। একই সময়ে জ¦ালানি ও গ্যাসের মূল্যও উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। ট্রাক পরিবহনে এক্সেল লোড নীতিমালা কার্যকরের কারণে এ শিল্পের ব্যয় আরও বাড়িয়ে তুলেছে।

সব মিলিয়ে উৎপাদন ব্যয় বাড়ার কারণে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে দেশের সিমেন্ট শিল্প। কমে গেছে সিমেন্ট কোম্পানিগুলোর নিট মুনাফা। কোনো কোনো কোম্পানি পড়েছে লোকসানে। উৎপাদন ব্যয় বাড়লেও দেশে সিমেন্টের বিক্রয়মূল্য না বাড়ায় লোকসানে পড়েছে হাইডেলবার্গ সিমেন্ট। চলতি দ্বিতীয় প্রান্তিকে কোম্পানিটির সিমেন্ট বিক্রি বেড়েছে ৪ শতাংশ। কিন্তু একই সময়ে পণ্য উৎপাদনে ব্যয় বেড়েছে সাড়ে ১২ শতাংশ।

পর্যালোচনায় দেখা যায়, চলতি দ্বিতীয় প্রান্তিকে সিমেন্ট বিক্রি থেকে হাইডেলবার্গের আয় হয় ২৮৬ কোটি ৩৮ লাখ টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ২৭৮ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। তবে বিক্রির তুলনায় উৎপাদন ব্যয় আনুপাতিক হারে বেশি বেড়েছে। ২০১৮ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) কোম্পানির পণ্য বিক্রিতে উৎপাদন ব্যয় ছিল ৮২ দশমিক ৩৫ শতাংশ। আর চলতি প্রথম প্রান্তিকে উৎপাদন ব্যয় দাঁড়ায় মোট বিক্রির ৯২ দশমিক ৬৫ শতাংশে। এর ফলে কোম্পানির মোট মুনাফা কমে গেছে।

জানা গেছে, উৎপাদন ব্যয় বাড়লেও বিক্রয়মূল্য বাড়ছে না সিমেন্টের। চাহিদার তুলনায় উৎপাদন সক্ষমতা বেশি থাকায় তীব্র প্রতিযোগিতার কারণে বিক্রয়মূল্য বাড়ছে না বলে জানিয়েছেন খাত-সংশ্লিষ্টরা। বর্তমানে দেশের সিমেন্ট শিল্পের উৎপাদন ক্ষমতা হচ্ছে সাড়ে ৫ কোটি মেট্রিক টন। আর চাহিদা রয়েছে প্রায় ৩ কোটি মেট্রিক টনের।

দেশে চাহিদার তুলনায় সিমেন্টের উৎপাদন সক্ষমতা বেশি থাকায় তীব্র প্রতিযোগিতাও রয়েছে। এর ফলে এক বছরে বস্তাপ্রতি সিমেন্টে প্রায় ৫৫ টাকা ব্যয় বাড়লেও বিক্রির ক্ষেত্রে একই হারে দাম বাড়াতে পারেনি সব কোম্পানি। চলতি দ্বিতীয় প্রান্তিকে হাইডেলবার্গ সিমেন্টের মোট মুনাফা হয় ২১ কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৫৭ শতাংশ কম। চলতি দ্বিতীয় প্রান্তিকে বিক্রয় ও বিপণন ব্যয় হয় ৮ কোটি টাকা।

এছাড়া প্রশাসনিক ব্যয় হয় ১১ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। এতে কোম্পানির পরিচালন মুনাফা দাঁড়ায় ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৯৫ শতাংশ কম। চলতি বছর কোম্পানির সুদ আয়ও কমে গেছে। চলতি দ্বিতীয় প্রান্তিকে কোম্পানির সুদ আয় হয়েছে ২ কোটি ১৪ লাখ টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৭ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। কাঁচপুরে কোম্পানির নতুন প্ল্যান্ট নির্মাণে মূলধনী ব্যয়ের কারণে কোম্পানির সুদ আয় ৬৩ শতাংশ কমেছে বলে কোম্পানি জানিয়েছে।

চলতি দ্বিতীয় প্রান্তিকে হাইডেলবার্গ সিমেন্টের করপূর্ববর্তী মুনাফা দাঁড়িয়েছে ৩ কোটি ৫২ লাখ টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৮৯ দশমিক ৫ শতাংশ কম। কর ও ন্যূনতম অগ্রিম আয়কর বাবদ কোম্পানিটিকে দ্বিতীয় প্রান্তিকে ৭ কোটি ৬১ লাখ টাকা পরিশোধের পরও কোম্পানিটি লোকসানে পড়েছে। এ সময় হাইডেলবার্গের লোকসান হয় ৪ কোটি ৯ লাখ টাকা।

যদিও আগের বছরের একই সময়ে কোম্পানিটি ২৩ কোটি ৭৭ লাখ টাকা নিট মুনাফায় ছিল। এদিকে প্রথম প্রান্তিকের কারণে অর্ধবার্ষিকে (জানুয়ারি-জুন) হাইডেলবার্গ এখনো নিট মুনাফায় রয়েছে। চলতি দ্বিতীয় প্রান্তিকে লোকসান সমন্বয়ের অর্ধবার্ষিকে কোম্পানির নিট মুনাফা দাঁড়িয়েছে ১৫ কোটি ২০ লাখ টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৫৩ কোটি ৯৫ লাখ টাকা।

পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, উৎপাদন ব্যয় বাড়ার কারণে ২০১৬ সাল থেকেই কোম্পানিটির নিট মুনাফা কমছে। ২০১৬ সালে এ কোম্পানির নিট মুনাফা ছিল ১৫০ কোটি টাকা, যা ২০১৮ সালে ৮০ কোটি টাকায় নেমে আসে। আর চলতি হিসাব বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে লোকসানের কারণে মুনাফা আরও কমতে দেখা গেছে। নিট মুনাফা কমে যাওয়ায় হাইডেলবার্গ সিমেন্টের শেয়ার দরেও বিরূপ প্রভাব পড়েছে। ফলে এ কোম্পানির দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগকারীরা পড়েছেন বড় অঙ্কের লোকসানে।

৩১ ডিসেম্বর সমাপ্ত ২০১৮ হিসাব বছরের জন্য শেয়ারহোল্ডারদের ৭৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে হাইডেলবার্গ সিমেন্ট। গেল হিসাব বছর কোম্পানিটির ইপিএস হয়েছে ১৪ টাকা ৩৩ পয়সা। ৩১ ডিসেম্বর এনএভিপিএস দাঁড়ায় ৮২ টাকা ৬৮ পয়সা। ২০১৭ হিসাব বছরে ইপিএস ছিল ১৪ টাকা ২১ পয়সা। এনএভিপিএস ছিল ৮৩ টাকা ১৭ পয়সা। সে বছর কোম্পানিটি ১৫০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছিল। এছাড়া ২০১৬ ও ২০১৫ হিসাব বছরে ৩০০ শতাংশ হারে নগদ লভ্যাংশ পেয়েছিলেন কোম্পানির শেয়ারহোল্ডাররা।

১৯৮৯ সালে দেশের শেয়ারবাজারে আসা বহুজাতিক কোম্পানিটির অনুমোদিত মূলধন ১০০ কোটি টাকা। পরিশোধিত মূলধন ৫৬ কোটি ৫০ লাখ ৪০ হাজার টাকা। মোট শেয়ারের ৬০ দশমিক ৬৭ শতাংশ রয়েছে উদ্যোক্তা পরিচালকদের কাছে। এছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে ২৫ দশমিক ৯৭ শতাংশ, বিদেশী বিনিয়োগকারীদের কাছে ১ দশমিক ১৫ ও সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের কাছে বাকি ১২ দশমিক ২১ শতাংশ শেয়ার রয়েছে।