এফ জাহান, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে দীর্ঘদিন পর ব্যাংক খাতের শেয়ারে সুবাতাস বইতে শুরু করছেন। দীর্ঘদিন পর ব্যাংক খাতের শেয়ারে দর বাড়ায় কিছুটা হলেও স্বস্তিতে রয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। তাছাড়া গতকাল সপ্তাহের দ্বিতীয় কার্যদিবসে বাজারে ব্যাংক খাতের শেয়ারের আধিপত্য বিস্তার ছিল। তেমনি ব্যাংকিং খাতের শেয়ারের প্রতি আস্থা ফিরতে শুরু করেছে পুঁজি হারানো বিনিয়োগকারীদের। দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংক খাতের শেয়ারের প্রতি যারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন তারা নতুন করে ব্যাংক খাতের শেয়ারের দিকে ঝুঁকছেন।

এছাড়া দীর্ঘদিন পর বাড়ছে ব্যাংকিং খাতের শেয়ার দর। সাধারনত তিন কারনে ব্যাংক খাতের শেয়ারের প্রতি ঝোঁক বাড়ছে বিনিয়োগকারীদের। এর মধ্যে পরিচালক মুনাফার খবরে ব্যাংক খাতের শেয়ারের প্রতি একটু বাড়তি আগ্রহ লক্ষ্য করা গেছে। গতকাল পুঁজিবাজার বিশ্লেষকরা এমনই মনোভাব ব্যক্ত করেছেন দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণের প্রতিবেদকের কাছে।

তারা বলেন, পুঁজিবাজারের গতি ত্বরান্বিত করতে ব্যাংকের খাতের শেয়ারের প্রতি কদর বাড়ছে। সামনে আরো বাড়বে। কারণ অধিকাংশ বিনিয়োগকারীর কাছে ব্যাংকিং খাতের শেয়ারের প্রতি রয়েছে ব্যাপক আস্থা। যদিও পুঁজিবাজারের মন্দা সময়ে এ খাতের প্রতি আস্থা কম ছিল। কিন্তু বর্তমানে আবার এ খাতের শেয়ারের প্রতি ঝুঁকছেন বিনিয়োগকারীরা।

বাজার বিশ্লেষকরা জানান, পুঁজিবাজারে দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার জন্য ব্যাংকিং খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। কারণ পুঁজিবাজার উন্নয়নের স্বাভাবিক গতি বাড়াতে ব্যাংকিং খাতের শেয়ারে বিনিয়োগের বিকল্প নেই। এ খাতের শেয়ার এখনো কিছুটা বিনিয়োগ ঝুঁকিমুক্ত। পাশাপাশি রয়েছে বিনিয়োগে সর্বোচ্চ আস্থাভাজন।

তাই পুঁজিবাজারের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে ব্যাংকিং খাতের শেয়ারের গুরুত্ব অপরিসীম। তারা আরো জানান, ব্যাংকিং খাতের কোম্পানিগুলোর পরিশোধিত মূলধন এবং শেয়ার সংখ্যা বেশি। যে কারণে বিনিয়োগকারীরা সাধারণত এ খাতকে বিনিয়োগ প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। আবার কোম্পানিগুলোর লেনদেন ও দর ওঠানামা অনেকটাই স্থিতিশীলতা বজায় থাকে। অন্যান্য কোম্পানির মতো ঢালাওভাবে এ খাতের শেয়ার দর উত্থান-পতন হয় না।

এদিকে পরিচালন মুনাফার খবরে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংক খাতের কোম্পানিগুলোতে দীর্ঘদিন পর সুবাতাস ফিরেছে। স¤প্রতি চাঙা হতে শুরু করেছে এ খাত। যে কারণে অন্যসব খাতের তুলনায় এ খাতের শেয়ারের প্রতি আগ্রহ বেড়েছে বিনিয়োগকারীদের। তবে প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালন মুনাফা বছরের শেষ পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে কি না তা নিয়ে দ্বিমত পোষণ করেছেন বাজারসংশ্লিষ্টরা।

বাজারসংশ্লিষ্টরা বলেন, বর্তমানে এ খাতের অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ারদর তুলনামূলক অনেক কম। সেই তুলনায় প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক অবস্থা এবং লভ্যাংশ প্রদানের হারও সন্তোষজনক। অন্যদিকে অধিকাংশ ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা বেড়েছে। মূলত সে কারণেই এসব কোম্পানির শেয়ারদর বাড়ছে। তবে শেষ পর্যন্ত ব্যাংকগুলো এ মুনাফা ধরে রাখতে পারবে কি না সেটা দেখার বিষয়।

কারণ পরিচালন মুনাফাই ব্যাংকের প্রকৃত মুনাফা নয়। এটি ব্যাংকের চূড়ান্ত হিসাব তথ্যও নয়। ব্যাংকের নিরীক্ষিত প্রতিবেদনে চূড়ান্ত হিসাব তথ্য পাওয়া যাবে। এর থেকে ব্যাংকের প্রয়োজন অনুযায়ী প্রভিশন বা নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ শেষে এবং করের টাকা পরিশোধের পর নিট মুনাফা বেরিয়ে আসে।

এ বিষয় ব্রোকারেজ হাউজ মালিকদের সংগঠন ডিবিএ’র সভাপতি শাকিল রিজভী বলেন, বিনিয়োগকারী সব সময় ভালো শেয়ারের সঙ্গে থাকতে চান। সার্বিক বিবেচনায় এখনও অধিকাংশ ব্যাংক শেয়ারে বিনিয়োগের অনুক‚ল পরিবেশ বিরাজ করছে। সা¤প্রতিক দরপতনে এসব শেয়ারের দর কমে গেছে। হয়তো সে কারণেই ব্যাংক শেয়ারের চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে।

ব্যাংকগুলোর অভ্যন্তরীণ সূত্রে পাওয়া পরিচালন মুনাফার তথ্যে দেখা যায়, মুনাফায় সবার ওপরে রয়েছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। চলতি ২০১৯ সালের প্রথম ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) ব্যাংকটি পরিচালন মুনাফা করেছে এক হাজার ২২৩ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের প্রথম ছয় মাসে এ ব্যাংকটির পরিচালন মুনাফা ছিল এক হাজার ২১ কোটি টাকা। এর পরেই সাউথইস্ট ব্যাংক লিমিটেড ৫০৫ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করেছে। এ ব্যাংকটির আগের বছরের ছয় মাসে পরিচালন মুনাফা ছিল ৪৫৫ কোটি টাকা। ব্যাংক এশিয়া আলোচ্য ছয় মাসে পরিচালন মুনাফা করেছে ৪৬৫ কোটি টাকা। আগের বছর প্রথম ছয় মাসে ব্যাংকটির পরিচালন মুনাফা ছিল ৪১৭ কোটি টাকা।

একইভাবে আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে পরিচালন মুনাফা করেছে ৪০৫ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ে ব্যাংকটির পরিচালন মুনাফা ছিল ২৬০ কোটি টাকা। সিটি ব্যাংক পরিচালন মুনাফা করেছে ৩৭০ কোটি টাকা। আগের বছর একই সময়ে ছিল ২৬৬ কোটি টাকা। ন্যাশনাল ক্রেডিট অ্যান্ড কমার্স (এনসিসি) ব্যাংক এ বছর প্রথম ছয় মাসে পরিচালন মুনাফা করেছে ৩৬২ কোটি টাকা। আগের বছর একই সময়ে ছিল ২৯৬ কোটি টাকা।

মার্কেন্টাইল ব্যাংক গত ছয় মাসে পরিচালন মুনাফা করেছে ৩৩১ কোটি টাকা। আগের বছর প্রথম ছয় মাসে ছিল ৩২৫ কোটি টাকা। এক্সিম ব্যাংক আলোচ্য ছয় মাসে পরিচালন মুনাফা করেছে ৩৩০ কোটি টাকা। আগের বছর এ ছয় মাসে ছিল ৩২৫ কোটি টাকা। এছাড়া তালিকাভুক্ত অধিকাংশ ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা বাড়তে দেখা গেছে। এদিকে ব্যাংক শেয়াররের মূল্য আয় অনুপাত বা পিই রেশিও এখনও ৯-এর নিচে অবস্থান করছে।

সংশ্লিষ্টদের মতে, যে কোনো খাত বা কোম্পানির ক্ষেত্রে এ রেশিও বিনিয়োগের উপযোগী। কোনো প্রতিষ্ঠানের পিই ২০-এর ওপরে চলে গেলে ধীরে ধীরে ওই প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। আর ৪০-এর বেশি পিই হলে ওই প্রতিষ্ঠান খুব বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। সে কারণে এ ধরনের কোম্পানির মার্জিন ঋণ সুবিধা বন্ধ থাকে।

এ বিষয় সাবেক তত্ত¡াবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবীদ এবি মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ব্যাংকগুলোর মুনাফায় এই উত্থান কিভাবে হয়েছে, সেটা আমার কাছে বোধগম্য না। কারন একদিকে ব্যাংকগুলো বলছে তাদের তারল্য সংকট ও খেলাপি ঋণের মাত্রা বেড়েছে। অন্যদিকে মুনাফা বাড়ছে। এখন দেখার বিষয় প্রভিশনিং ঘাটতি ও ট্যাক্স কম দেখানো হয়েছে কিনা। এ অবস্থায় বিনিয়োগকারীদেরকে শুধু মুনাফা না দেখে, অন্যান্য সূচক (ইন্ডিকেটর) যাছাই করে বিনিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বিশেষ করে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ও প্রভিশনিং ঘাটতি আছে কিনা, তা দেখতে হবে। শুধুমাত্র একটি ইন্ডিকেটর দেখে বিনিয়োগে যাওয়া উচিত না।