দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: ঝুঁকিপূর্ণ ঋণের প্রভিশন সংরক্ষণে ব্যর্থ পুঁজিবাজারের ৯ ব্যাংক। ব্যাংকগুলোর ঋণের ঝুঁকি বিবেচনা করে তার বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। কিন্তু প্রয়োজনীয় প্রভিশন রাখতে ব্যর্থ হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, রূপালী, বেসিক ও অগ্রণী ব্যাংক, আর বেসরকারী বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত নয়। আর পুঁজিবাজারের ৯ ব্যাংক হলো: এবি ব্যাংক, , ঢাকা ব্যাংক, মিউচুয়াল টাস্ট ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক এবং ট্রাস্ট ব্যাংক।

ব্যাংকিং খাতে লাগামহীনভাবে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। ঝুঁকিপূর্ণ এসব ঋণের বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) সংরক্ষণে বিধান থাকলেও, তা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে দেশের সরকারি ও বেসরকারি খাতের ১৩টি ব্যাংক। এসব ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ৮৯৭ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তৈরি করা জুন- ২০১৯ প্রান্তিকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানা গেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খেলাপি ঋণ বাড়ার কারণেই ব্যাংকিং খাতে বাড়ছে প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ। আর এ সময়ে যেসব ব্যাংক প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে, তাদের মূলধন ঘাটতিতে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের জুন শেষে ব্যাংক খাতে ঋণ বিতরণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯ লাখ ৬২ হাজার ৭৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ১২ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা। আর রাইটঅফ বা অবলোপন করা ঋণের পরিমাণ যোগ করা হলে খেলাপি ঋণ দেড় লাখ কোটি টাকা ছাড়াবে। এর আড়ে ২০১৮ সালের জুনে শেষে অবলোপন বাদে খেলাপি ঋণ ছিল ৯০ হাজার ৩৭২ কোটি টাকা। এ হিসাবে বিগত এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা। আগের প্রান্তিক চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ এই তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছিল প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা।

আলোচিত সময়ে ১৩ ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ৮৯৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকের মধ্যে সব চেয়ে বেশি প্রভিশন ঘাটতি বেসিক ব্যাংকের। জুন শেষে ব্যাংকটির ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৭৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এর পরই সোনালী ব্যাংকের ঘাটতির এক হাজার ৯৪২ কোটি ২০ লাখ, রূপালী ব্যাংকের ৯৮২ কোটি ৭৩ লাখ টাকা এবং অগ্রণী ব্যাংকের ৮৫২ কোটি ৮৮ লাখ টাকা।

বেসরকারি খাতের ৯ ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ৬ হাজার ৪৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে এবি ব্যাংকের তিন হাজার ৫৯৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ৫১১ কোটি ১১ লাখ, ঢাকা ব্যাংক ৩২৯ কোটি ৫৮ লাখ, মিউচুয়াল টাস্ট ব্যাংক ১২৬ কোটি ৪৫ লাখ, ন্যাশনাল ব্যাংক ৭২৭ কোটি ৮৩ লাখ, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ১০৩ কোটি ৩৪ লাখ, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের ৩৭০ কোটি টাকা, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের ১০০ কোটি ৩৩ লাখ এবং ট্রাস্ট ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ১৮৩ কোটি ৬১ লাখ টাকা।

এদিকে কোনো কোনো ব্যাংক প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত (উদ্বৃত্ত) অর্থ নিরাপত্তা সঞ্চিতি হিসেবে রাখায় সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতে ঘাটতির পরিমাণ কিছুটা কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, চলতি বছরের জুন শেষে ব্যাংকিং খাতে প্রভিশন সংরক্ষণের প্রয়োজন ছিল ৭১ হাজার ২৪৩ কোটি ৪ লাখ টাকা। এর বিপরীতে সংরক্ষণ করা হয়েছে ৬২ হাজার ২৩ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। ফলে সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতে মোট নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ২১৯ কোটি ৭০ লাখ টাকা।

এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, একদিকে খেলাপি ঋণ বেড়ে গেছে, অন্যদিকে বিশেষ সুবিধায় নিয়মিত ঋণগুলো ঠিকমত আদায় হচ্ছে না। ফলে প্রভিশন ঘাটতি বাড়ছে।

তিনি বলেন, ব্যাংক খাতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, ব্যাপক অনিয়মসহ নানা কারণে ধারাবাহিকভাবে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। সরকার খেলাপিদের একের পর এক সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে কিন্তু খেলাপি ঋণ কমাতে পারছে না। এর কারণ ব্যাংকগুলোতে জবাবদিহিতা নেই, সুশাসনের অভাব।

খেলাপি ঋণ কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যকর উদ্যোগ নেয়া ছাড়া কোনো পথ নেই উল্লেখ করে সালেহ উদ্দিন বলেন, আগামীতে খেলাপি যেন আর না বাড়ে সে জন্য ব্যাংকগুলোকে দেখেশুনে ঋণ দিতে হবে। অনৈতিকভাবে পুনঃতফসিল সুবিধা নিতে না পারে তা তদারকি করতে হবে। এছাড়া বিশেষ সুবিধায় পুনঃতফসিল, পুনর্গঠন করা ঋণ যেন আদায় হয় সেই বিষয়ে কঠোর হতে হবে। এছাড়া সরকারি ব্যাংকগুলোকে অযথা সার্পোট না দিয়ে ঋণ আদায়ের ওপর চাপ দিতে হবে। একই সঙ্গে যেসব বেসরকারি ব্যাংক প্রভিশন ঘাটতিতে রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারি জরুরি বলে মনে করেন সাবেক এ গভর্নর।

জানা গেছে, ব্যাংকগুলো প্রাহকদের যে পরিমাণ ঋণ বিতরণ করে তার বেশিরভাগই আমানতকারীদের অর্থ। তাদের অর্থ যেন কোনো প্রকার ঝুঁকির মুখে না পড়ে সে জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করা আছে। এর একটি হলো প্রভিশন সংরক্ষণ।

নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকের অশ্রেণিকৃত বা নিয়মিত ঋণের বিপরীতে দশমিক ২৫ থেকে পাঁচ শতাংশ হারে প্রভিশন রাখতে হয়। যথাসময়ে আদায় না হওয়া নিম্নমান বা সাব স্ট্যান্ডার্ড ঋণের বিপরীতে রাখতে হয় ২০ শতাংশ, সন্দেহজনক ঋণের বিপরীতে ৫০ শতাংশ এবং মন্দ বা কুঋণের বিপরীতে ১০০ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়।

ব্যাংকগুলোর মুনাফা থেকে অর্থ এনে এ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। খেলাপি ঋণ বাড়লে, আর সে অনুযায়ী ব্যাংকের আয় না হলে প্রভিশন ঘাটতি দেখা দেয়। ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, প্রভিশন ঘাটতি থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক শেয়ারহোল্ডাদের জন্য কোনো লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারে না।