দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: বাজার ধারণায় চাহিদা ও জোগানের ভিত্তিতে পণ্যের দাম নির্ধারিত হয়। পুঁজিবাজারেও শেয়ারের জোগান বাড়লে চাহিদা কমে আর চাহিদা কমলে শেয়ারের দাম কমে যায়। আবার জোগানের চেয়ে চাহিদা বাড়লে শেয়ারের দামও বেড়ে যায়। গত আট বছরে পুঁজিবাজারে শেয়ারের জোগান যেভাবে বেড়েছে, সেভাবে বাড়েনি বিনিয়োগকারী।

বরং আস্থাহীনতা ও হতাশায় উল্টো শেয়ার বিক্রি করে মূলধন তুলে নিয়ে বাজার ছেড়েছেন তাঁরা। যাতে দেশের পুঁজিবাজারে চাহিদা ও জোগানে ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হয়েছে। শেয়ারের জোগান বাড়লেও নানা কারণে চাহিদার দিক সংকুচিত হয়েছে বলে মনে করছেন পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা।

তাঁদের মতে, সেকেন্ডারি মার্কেটে বিনিয়োগকারীর তুলনায় শেয়ারের জোগান বেড়েছে। আইপিওর শেয়ারবাজারে আসার পর প্লেসমেন্টের শেয়ারও নির্দিষ্ট সময় পর লক-ইন ফ্রি হচ্ছে। মূলত প্লেসমেন্ট শেয়ারধারীরা লক-ইন সময় শেষ হলে বিক্রি করে মুনাফা নিয়ে বাজার থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন। উদ্যোক্তা-পরিচালকরাও ক্রমাগত শেয়ার বিক্রি করছেন। যাতে বাজারে শেয়ার বাড়লেও কিন্তু বিনিয়োগকারী কমছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিকল্প বিনিয়োগ হিসেবে লাভজনক মনে না করায় বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজার ছাড়ছেন। তালিকাভুক্ত কম্পানি থেকে আশানুরূপ লভ্যাংশ বা মুনাফা না পেয়ে হতাশা ও প্রাইমারি মার্কেটে আইপিওতে শেয়ার বরাদ্দ না পাওয়ায় আস্থাহীনতায় বিনিয়োগ তুলে নিচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা।

কেউ কেউ বলছেন, দীর্ঘ সময়েও পুঁজিবাজারে সুশাসন না আসায় পুঁজির অনিশ্চয়তা থেকে বাজার ছাড়ছেন বিনিয়োগকারীরা। ২০১০ সালে ধসের পর বিনিয়োগকারীদের একটি বড় অংশ পুঁজিবাজার ছেড়েছে। মাঝে ছাড়ার প্রবণতা কমে এলেও গত তিন বছরে ২০১৬ সাল থেকে ছয় লাখের বেশি বিনিয়োগকারী হিসাব বন্ধ করে পুঁজিবাজার ছেড়েছেন। মানুষ ভবিষ্যতের জন্য অর্থ জমায় কেউ ব্যাংকে আমানত হিসাবে, কেউ সঞ্চয়পত্র কিনে আবার কেউবা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেন।

কিন্তু তিনটি মাধ্যমের কোনোটিই এখন সঞ্চয়কারীর আনুক‚ল্যে নেই। পুঁজিবাজারে সাধারণত ভালো কম্পানি বিশেষ করে তালিকাভুক্ত ব্যাংকের শেয়ার কিনে রাখলে ১০ শতাংশের বেশি লভ্যাংশ পায়। আবার শেয়ারের দাম-বাড়া কমাতেও মুনাফা আসে। ২০১৮ সালে ব্যাংক ভালো মুনাফা করলেও শেয়ারহোল্ডারদের আশানুরূপ লভ্যাংশ দেয়নি। যাতে হতাশ হয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। আবার আর্থিক খাতে নানা সংকটের খবরেও কেউ কেউ মূলধন তুলে নিয়ে বিকল্প বিনিয়োগের পথে হাঁটছেন।

জানা যায়, ২০১১ থেকে ২০১৯ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত পুঁজিবাজারে ৭৪৭৪ কোটি টাকার শেয়ারের জোগান এসেছে। মিউচ্যুয়াল ফান্ড ও বন্ডকে এ হিসাবের বাইরে রাখা হয়েছে। কোনো কম্পানি ফেসভ্যালু ১০ টাকায় শেয়ার ইস্যু করে মূলধন উত্তোলন করেছে আবার কেউ ফেসভ্যালুর সঙ্গে প্রিমিয়াম নিয়ে মূলধন তুলেছে।

২০১১ সাল থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত ৮৬টি কম্পানি পুঁজিবাজারে এসেছে। যার মধ্যে ৫৮ কম্পানি সাধারণ শেয়ার ইস্যুতে আইপিওর পাশাপাশি প্রি-আইপিও বা প্রাইভেট প্লেসমেন্টের মাধ্যমে মূলধন উত্তোলন করেছে। এসব কম্পানির মাধ্যমে বাজারে ৫৫৬ কোটি ৭৪ লাখ শেয়ারের জোগান এসেছে।

আইপির মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক ও সাধারণ বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বরাদ্দ পেয়েছেন ১৪২ কোটি ৮২ লাখ ২৯ হাজার। প্লেসমেন্টের মাধ্যমে কম্পানির বাছাই করা বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বরাদ্দ পেয়েছেন ১৩৯ কোটি ২৭ লাখ পাঁচ হাজার। আর কম্পানির স্পন্সর ও পরিচালকদের হাতে এসেছে ২৭৪ কোটি ৬৩ লাখ আট হাজার শেয়ার।

ইলেকট্রনিক শেয়ার সংরক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশের (সিডিবিএল) তথ্যানুযায়ী, বিগত কয়েক বছর ধরে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীর হিসাব (বিও অ্যাকাউন্ট) কমছে। ২০১৬ সালের ২০ জুন পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ছিল ৩১ লাখ ৮৯ হাজার ৯৪৩। তিন বছর ব্যবধানে পুঁজিবাজার ছেড়েছেন ছয় লাখ ৪১ হাজার বিনিয়োগকারী।

বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, ‘বাজারে জোগান বাড়ছে ঠিকই কিন্তু শেয়ার কিনতে চাহিদা বাড়ছে না। অনেক বিনিয়োগকারী বিও হিসাব বন্ধ করেছেন, মূলধন তুলে বাজার ছেড়েছেন। আর তাঁদের বাজারে রাখার মতো পরিস্থিতিও আমরা তৈরি করতে পারিনি।’