দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: মন্দা পুঁজিবাজারে বিএসইসি’র হস্তক্ষেপে আতঙ্কিত হয়ে পড়ছেন বাজার সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলো। একদিকে বাজারে টানা দরপতন অন্যদিকে বিএসইসি’র অতিরঞ্জিত হস্তক্ষোপে বিনিয়োগকারীরা টালমাতাল পড়ে পড়ছেন। লোকসানের পর আবার নতুন করে লোকসানের মুখে পড়ছেন বিনিয়োগকারীরা। বিনিয়োগকারীরা ক্ষোভের সুরে বলেন, বিএসইসি ভাল বাজার ব্যবস্থা নিলে এর প্রভাব বাজারে পড়ে না, তেমনি মন্দা বাজারে কোম্পানিগুলোর ব্যবস্থা নেওয়ার এর প্রভাব পড়বে গোটা পুঁজিবাজারে।

বিশেষ করে আতঙ্কিত ব্রোকারেজ হাউজ, মার্চেন্ট ব্যাংক, অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি ও ভেঞ্চার ক্যাপিটাল প্রতিষ্ঠানগুলো। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), দুই স্টক এক্সচেঞ্জ ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) পর এবার যুক্ত হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংক পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানের সম্পদের হিসাব চেয়েছে। এতে আরো শঙ্কিত হয়ে পড়েছে পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো।

এদিকে মন্দা বাজারে বিএসইসি হঠাৎ করে আলহাজ্ব টেক্সটাইল ও মন্নু সিরামিকসকে স্পট মার্কেটে পাঠানোর ফলে বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। গতকাল আলহাজ্ব টেক্সটাইল ও মন্নু সিরামিক এবং মন্নু স্টার্ফলাসের ক্রেতা শুন্য ছিল। এর ফলে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ছেন বিনিয়োগকারীরা। তারা মুল পুঁজি ফেরত পাওয়া নিয়ে শঙ্কায় মধ্যে রয়েছেন।

অন্যদিকে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান আলহাজ্ব টেক্সটাইলের এক পরিচালকের সিকিউরিটিজ আইন লঙ্ঘন করার প্রমাণ পেয়েছে। যে কারণে ওই পরিচালককের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা না নেয়া পর্যন্ত কোম্পানিটিকে স্পট মার্কেটে পাঠানো হয়েছে। তাছাড়া মুন্নু সিরামিকসের আর্থিক প্রতিবেদনে অনিয়ম ও সিকিউরিটিজ আইন লঙ্ঘন করে মুন্নু ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন শেয়ার লেনদেন করেছে। এ কারণে মুন্নু সিরামিকসকেও স্পট মার্কেটে পাঠানো হয়েছে। এর ফলে গ্যাঁড়াকলে পড়েছে কোম্পানি দুটির সাধারণ শেয়ারহোল্ডারা।

বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, অপরাধ করবে কোম্পানি, আর ক্ষতির মুখে পড়বে বিনিয়োগকারীরা এ কেমন আইন। এ ধরনের সিদ্ধান্তের কারণে অনিয়মের দায় নিতে হচ্ছে কোম্পানির শেয়ারহোল্ডারদের। যা একেবারেই কাম্য নয় বলে মনে করছেন তারা।

তারা আরো বলেন, কোম্পানি দুটিকে স্পট মার্কেটে না পাঠিয়ে বিএসইসি সিকিউরিটিজ আইন লঙ্ঘনকারী আলহাজ্ব টেক্সটাইলের ওই পরিচালককে জরিমানা করতে পারতো। কিন্তু তা না করে এফফোর্সমেন্ট বিভাগে পাঠিয়ে কালক্ষেপণ করেছে কমিশন। একই অবস্থা মুন্নু সিরামিকসের। কোম্পানিটি দুটিকে স্পট মার্কেটে পাঠানোর ফলে এ শেয়ার লেনদেনে আগ্রহ হারাবে বিনিয়োগকারীরা। ফলে যাদের হাতে কোম্পানির শেয়ার রয়েছে তারা গ্যাঁড়াকলে পড়েছেন।

এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘আদার ফাইনান্সিয়াল করপোরেশনস (ওএফসি)’ এর গাইড লাইন অনুযায়ী এসব তথ্য চেয়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এক নির্দেশনা জারি করে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত সকল সম্পদের ফিরিস্তি জমা দিতে হবে। ওই নির্দেশনা অনুযায়ী ব্রোকারেজ হাউজ, মার্চেন্ট ব্যাংক, অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি ও ভেঞ্চার ক্যাপিটাল প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের ঋণ বিতরণের তথ্য, দেনা ও সম্পদের তথ্য দিতে হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই চিঠিতে সায় দিয়ে তথ্য প্রদানের জন্য বিএসইসি ও স্টক এক্সচেঞ্জগুলো তাগিদ দিচ্ছে। এদিকে গত ২৮ আগস্ট ছিল তথ্য দেয়ার শেষ সময়। কিন্তু স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে বিএসইসিকে জানানো হয়েছিল যে, বাংলাদেশ ব্যাংক চাইলেই সরাসরি এই তথ্য চাইতে পারে না। সেজন্য তারা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জমা দিতে পারেনি।

অন্যদিকে পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, বাংলাদেশ ব্যাংক যেসব তথ্য চেয়েছে, এগুলো বিএসইসিতে জমা দেয়া আছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি কোনো তথ্য নিতে চায়, বিএসইসি থেকেই নিতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানকে আলাদা আলাদা চিঠি দেয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না। এতে বাজারে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। এর আগে এনবিআর সব ব্রোকারেজ হাউজগুলোকে ছয় বছরের আর্থিক প্রতিবেদন জমা দেয়ার জন্য চিঠি দেয়। ভ্যাট ফাঁকি খতিয়ে দেখতে এনবিআর এসব তথ্য চায়। আর বিএসইসি ও স্টক এক্সচেঞ্জের নিয়মিত বিভিন্ন কমপ্ল্যায়েন্সের বিষয় তো আছেই।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘আদার ফাইনান্সিয়াল করপোরেশনস (ওএফসি)’-এর গাইড লাইন অনুযায়ী ব্রোকারেজ হাউজগুলো গ্রাহকদের কী ধরণের সুবিধা দিচ্ছে তা জানতে চেয়েছে। সাধারণত ব্রোকারেজ হাউজগুলোতে বিনিয়োগকারীদের শেয়ার কেনাবেচা হয়ে থাকে। এসব তথ্য আলাদাভাবে দেয়ার জন্য বলা হয়েছে।

এ বিষয়ে ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন (ডিবিএ) সভাপতি শাকিল রিজভী বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক তথ্য চেয়েছে। এ বিষয়ে ব্রোকারেজ হাউজগুলো কাজ করছে। অনেক তথ্য চাওয়ায় দিতে সময় লাগছে। বিএসইসি’র সঙ্গে কথা বলে যতটুকু জানা গেছে: বাংলাদেশ ব্যাংক হয়তো পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর সক্ষমতা যাচাই করতে চায়। সেজন্য তথ্য দিয়ে সবাই সহযোগিতা করছে।

তাছাড়া মিউচুয়াল ফান্ডগুলো সাধারণত বিনিয়োগকারীদের অর্থ দিয়ে বিভিন্ন শেয়ার ক্রয়-বিক্রয় করে থাকে। বিভিন্ন কোম্পানির বন্ড, মিউচুয়াল ফান্ড ও ইউনিট ফান্ডের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে। তাই তারাও এক ধরণের আর্থিক প্রতিষ্ঠান। সেই হিসেবে এসব তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে থাকা জরুরি বলে মনে করছে।

অন্যদিকে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোও সরাসরি কোনো বিনিয়োগ করে না। তারা নতুন কোম্পানি পুঁজিবাজারে নিয়ে আসা, কোম্পানি একীভূত করা ছাড়াও স্বল্পপরিসরে বিনিয়োগকারীদের ঋণ দিয়ে থাকে। যদিও তারা ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মতো অর্থ জমা (ডিপজিট) রাখতে পারে না। বর্তমানে ৬০টি মার্চেন্ট ব্যাংক কাজ করছে বলেও গাইড লাইনে উল্লেখ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে এএফসি ক্যাপিটাল লিমিটেড-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহবুব মজুমদার বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ঠিক কী কারণে তথ্য চেয়েছে এটি আমরা বলতে পারবো না। এটি বাংলাদেশ ব্যাংকই ভালো জানে। আমরা চাহিদা অনুযায়ী তথ্য দিয়ে দেবো। এর বাইরেও বর্তমানে ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানিগুলো বিভিন্ন কোম্পানিতে ইক্যুইটি হিসেবে অর্থায়ন করে থাকে। এসব প্রতিষ্ঠানগুলোতে কি পরিমাণ কর্মকর্তা রয়েছে, তাদের বার্ষিক আয় কত, ভেঞ্চার ক্যাপিটাল প্রতিষ্ঠান কি পরিমাণ বিনিয়োগ করছে সেটি বাংলাদেশ ব্যাংকের নখদর্পনে রাখতে চায়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ভেঞ্চার ক্যাপিটাল প্রতিষ্ঠান মসলিন ক্যাপিটালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওয়ালি উল মারূফ মতিন জানান, এ ধরণের একটি চিঠি তারা পেয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে তারা কাজ করছেন বলেও উল্লেখ করেন।

এ সম্পর্কে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, কোম্পানিগুলোর শেয়ার অতিমূল্যায়িত হওয়ার কারণে ভোগান্তিতে পড়ছে বিনিয়োগকারীরা। তবে আইন অনুযায়ী বিএসইসি যে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশনা এনফোর্সমেন্ট বিভাগকে দিয়েছে, তা ঠিকই করেছেন। অপরাধীর সাজা হওয়া উচিত।