দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: বর্তমান যুবলীগের প্রথম সারির নেতাদের কদর্য রূপ দেখল দেশবাসী। শুদ্ধি অভিযানে লন্ডভন্ড সংগঠনটি। কয়েকদিন আগেও আওয়ামী লীগের ভাতৃপ্রতীম সংগঠনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী সংগঠন হিসেবে পরিচিত ছিল বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ। কিন্তু আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত শুদ্ধি অভিযানে সবচেয়ে বড় ঝড়টা যাচ্ছে যুবলীগের ওপর দিয়ে। ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে যুবলীগের ডজন খানেক নেতা গ্রেফতার হয়েছে।

ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি সম্রাট আর কেন্দ্রীয় প্রেসিডিয়াম সদস্য নুরুন্নবী চৌধুরী শাওনের পরিবারের ব্যাংক লেনদেনের তথ্য জানতে চেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যুবলীগ নেতা খালিদ মাহমুদ ভূঁইয়া ও জি কে শামীমের গ্রেফতারের পর গা ঢাকা দিয়েছে অনেকে। প্রতিষ্ঠার পর সবচেয়ে বেশি ইমেজ সংকটে পড়েছে সংগঠনটি।

যুবলীগের একাধিক নেতার বিরুদ্ধে ক্যাসিনো ব্যবসার অভিযোগ উঠেছে, উঠেছে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, সন্ত্রাসের অভিযোগ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই ১৪ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে বলেছেন, ছাত্রলীগের চেয়েও কিছু দানব তৈরি হয়েছে যুবলীগে। এই দানব থেকে মুক্ত করতে হবে যুবলীগকে।

এখন যেভাবে বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের সমালোচনা করা হচ্ছে, যেভাবে এই সংগঠনটিতে চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসবাদ, টেন্ডারবাজ বা ক্যাসিনোর ট্যাগ লাগানো হচ্ছে। আসলে কি সংগঠনটির পরিচয় শুধু তাই? বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, গত দশ বছরে বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের অর্জন অনেক। যুবলীগই প্রথম সংগঠন যারা একুশে বইমেলায় প্রথম নিজেদের প্রকাশনা স্টল করেছে।

আওয়ামী যুবলীগের শতাধিক বই প্রকাশিত হয়েছে। এ সমস্ত বইয়ের মধ্যে রয়েছে, ‘আমাদের মুক্তিযুদ্ধ’, ‘জাতির পিতার জীবনাদর্শ’, ‘রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার কর্মময় জীবন’সহ মুক্ত চিন্তার বিভিন্ন ধরনের প্রকাশনা। এসব প্রকাশনার মাধ্যমে বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ যুবমননের বিকাশ ঘটাতে চেয়েছে।

অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ গত দশ বছরে একটি নতুন ধারার রাজনীতি শুরু করেছে। রাজনৈতিক দল মানেই আন্দোলন, সংগ্রাম, রাস্তায় মিছিল, মানববন্ধন ইত্যাদি হিসেবেই পরিচিত ছিল। কিন্তু আওয়ামী যুবলীগ সেই বলয় ভেঙে দিয়েছে। যুবলীগ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছে, যুবও জাগরণ কেন্দ্রের মাধ্যমে গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠিত করেছে, সারা দেশে পাঠচক্র করেছে, দেওয়াল লিখন পোস্টারের মতো

পরিবেশবিরোধী কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগই প্রথম সংগঠন যারা ক্রোড়পত্রের সংস্কৃতি চালু করেছে। একটি আদর্শভিত্তিক রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রে যে ধরনের মনন চর্চা দরকার তার একটা আদর্শ উদাহরণ হতে পারত যুবলীগ। কিন্তু এর পেছনের কদর্য রূপটি ধরা পড়েছে প্রধানমন্ত্রীর চোখে। যেটি তারা দীর্ঘদিন ধরেই চর্চা করে আসছিল।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি বার্তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন। যারা সন্ত্রাসী, ক্যাডার রাজনীতি করে, তাদের দলে দরকার নেই এবং এরা দলের দুঃসময়ে কোনো কাজে আসে না। আওয়ামী লীগের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, যারা ক্যাডার, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজরা দলের দুঃসময়ে দলের পাশে দাঁড়ায় না বরং নিজেকে বাঁচাতে পালিয়ে যায়। শেখ হাসিনার দূর দৃষ্টিসম্পন্ন রাজনীতিবিদ জন্যই এ ধরনের পদক্ষেপ নিতে পেরেছেন এবং যুবলীগের এই কলঙ্কমোচন করতে পেরেছেন।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে অনিয়মগুলো শুধরানোর জন্য তিনি যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করেছেন, যুবলীগের প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে তিনি সেই প্রক্রিয়া অনুসরণ করেননি। ছাত্রলীগের অনিয়ম দূর করতে তিনি ছাত্রলীগের দুই শীর্ষনেতাকে অব্যাহতি দিয়েছেন। মাথা ছেটে ফেলে ছাত্রলীগের নতুন নেতৃত্বকে পুনর্গঠন করেছেন।

এর মাধ্যমে ছাত্রলীগে একটি স্পষ্ট বার্তা গেছে যে, অনিয়ম করলে সে যত বড় নেতাই হোক ছাড় পাবে না। যুবলীগের ক্ষেত্রে তিনি অন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তিনি সুনির্দিষ্ট তালিকা করেছেন, কারা এই সংগঠন বিরোধী তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত, কারা সংগঠনের নাম ভাঙিয়ে চাঁদাবাজি করে, টেন্ডারবাজি করে, ক্যাসিনো বাণিজ্য করে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন।

১৯৭২ সালের ১১ নভেম্বর যুবলীগের জন্ম। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনি প্রতিষ্ঠিত যুবলীগকে আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী বিবেচনা করা হয়। নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে যুবলীগের উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল।

স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের প্রতীক নূর হোসেন ছিলেন যুবলীগ কর্মী। তত্ত¡াবধায়ক সরকার-পূর্ববর্তী সময়ে বিএনপি সরকার বিরোধী আন্দোলনে ঢাকার রাজপথ দখল করে যুবলীগ। আওয়ামী লীগের ‘ভ্যানগার্ড’ হয়ে শক্তিশালী কর্মকান্ড পরিচালনায় সুনাম ছিল সংগঠনটির। তবে সে সবই গত হয়েছে। তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকায় শৃঙ্খলার সব সীমা ছাড়িয়েছে যুবলীগে।

দলীয় নেতাকর্মীরা বলছেন, যুবলীগের হাইকমান্ডের ইন্ধনেই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে সম্রাট-খালেদরা। নেতারা সুবিধাভোগী হওয়ায় এতদিন কোনো ব্যবস্থা নেননি। যুব লীগের সর্বশেষ কমিটি হয় ২০১২ সালের ১৪ জুলাই। চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান ওমর ফারুক চৌধুরী এবং সাধারণ সম্পাদক হন হারুন-অর-রশিদ। ২০১৬ সালের আওয়ামী লীগের সম্মেলনকে সামনে রেখে অন্যান্য সহযোগী সংগঠনগুলোর কমিটি গঠন করা হলেও যুবলীগের আর সম্মেলন হয়নি। এখন যুবলীগে নতুন নেতৃত্ব আনা ছাড়া আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডে দ্বিতীয় কোনো বিকল্প নেই!