দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: নানা জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটে ক্যাসিনো কারবার, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজিসহ একের পর এক অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় যুবলীগের বর্তমান কমিটির ওপর ক্ষুব্ধ আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সুনির্দিষ্ট অভিযোগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক হয়েছেন যুবলীগের কেন্দ্রীয় ও ঢাকা মহানগরের একাধিক নেতা।

সন্দেহের তালিকায় রয়েছেন আরও বেশ কয়েকজন। এ অবস্থায় ভাবমূর্তি রক্ষায় যুবলীগের বর্তমান কমিটি ভেঙে দেওয়া ছাড়া বিকল্প নেই বলে মত দিয়েছেন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা। তারা বলছেন, জাতিসংঘ অধিবেশন শেষে দেশে ফিরে যুবলীগের বর্তমান কমিটিকে সম্মেলনের প্রস্তুতি নিতে বলবেন শেখ হাসিনা।

আওয়ামী লীগের একজন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং একজন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক গতকাল বৃহস্পতিবার জানান, চলমান শুদ্ধি অভিযানে যুবলীগের ভাবমূর্তি একেবারে ধুলোয় মিশে গেছে। বিভিন্ন অনিয়মে জড়িয়ে পড়েছেন যুব নেতারা। তাদের অনেকেই অবৈধভাবে হাজার কোটি টাকা আয় করেছেন গত কয়েক বছরে।

সম্প্রতি চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠার পরপরই ছাত্রলীগ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় সংগঠনটির সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীকে। কিন্তু যুবলীগের ক্ষেত্রে অভিযুক্ত নেতাদের তালিকা অনেক লম্বা। সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটির শীর্ষ নেতা থেকে অন্য নেতারা, মহানগর নেতারা এমনকি জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের অনেকের নামেই অভিযোগ রয়েছে। এই অবস্থায় যুবলীগের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে সংগঠনটি ঢেলে সাজানো দরকার। প্রধানমন্ত্রী দেশে ফিরলেই হয়তো এ বিষয়ে নির্দেশনা আসবে।

আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, প্রধানমন্ত্রী দেশ ছাড়ার আগেই বলে গেছেন, ছাত্রলীগের পর এবার যুবলীগকে ধরেছি। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে নির্দেশনাটা স্পষ্ট- শুধু প্রশাসনিক ব্যবস্থা নয়, সাংগঠনিক ব্যবস্থাও আসতে যাচ্ছে যুবলীগের বর্তমান কমিটির বিরুদ্ধে।

আওয়ামী লীগের সম্মেলন নিয়মিত হলেও দলটির সহযোগী সংগঠন যুবলীগে তা হচ্ছে না। সবশেষ সম্মেলনের পর কেটে গেছে ৭ বছর। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী প্রতি ৩ বছর অন্তর সম্মেলন হওয়ার কথা। সবশেষ ২০১২ সালের ১৪ জুলাই যুবলীগের ষষ্ঠ জাতীয় কংগ্রেস হয় দীর্ঘ ৯ বছর পর। এ কমিটিরও মেয়াদ ফুরিয়েছে ২০১৫ সালের ১৪ জুলাই।

চলমান শুদ্ধি অভিযানের মধ্যে যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন এবং মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। গ্রেপ্তার হয়েছেন দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। গ্রেপ্তার এড়াতে সিঙ্গাপুরে রয়েছেন এ শাখার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর একেএম মুমিনুল হক সাঈদ।

যুবলীগের দপ্তর সম্পাদক কাজী আনিসসহ বেশ কয়েকজনকে খুঁজছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সমবায়বিষয়ক সম্পাদক জিকে শামীমকে গ্রেপ্তারের পর রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। যদিও যুবলীগের দপ্তরের দাবি জিকে শামীম যুবলীগের কেউ নন। কিন্তু সংগঠনের নেতাকর্মীরা বলছেন, জিকে শামীম যুবলীগেরই ছিলেন। শুধু তিনি নন, আরও অনেকেই যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতা পরিচয় দিয়ে বেড়ান। পদপ্রাপ্তির প্রমাণ হিসেবে তারা যুবলীগের দপ্তর সম্পাদক কাজী আনিসের ফোন থেকে পাঠানো এসএমএস দেখান।

যুবলীগ সূত্রে জানা গেছে, ছাত্রলীগের গত তিন কমিটিতে মাহমুদ হাসান রিপন ও মাহফুজুল হায়দার চৌধুরী রোটন; বদিউজ্জামান সোহাগ ও সিদ্দিকী নাজমুল আলম এবং সাইফুর রহমান সোহাগ ও এসএম জাকির হোসাইনের সঙ্গে যারা রাজনীতি করেছেন তাদের অনেকেই ছাত্রলীগ থেকে সাবেক হওয়ার পর যুবলীগে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার আগ্রহ দেখান।

তখন যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীর নির্দেশে সাবেক ছাত্রলীগ নেতাদের অনেককেই যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে যোগ দেওয়ার জন্য এসএমএসের মাধ্যমে আহ্বান জানানো হতো। তারা যুবলীগের ‘এসএমএস কমিটি’র নেতা হিসেবে রাজনৈতিক অঙ্গনে পরিচিত।

নাজমুল-সোহাগ কমিটিতে ছাত্রলীগের সহসভাপতি ছিলেন, পরে যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে নিয়মিত এসএমএস পেতেন এমন এক নেতা জানান, গত ৬ মাস থেকে আমরা কোনো এসএমএস পাচ্ছি না। এর আগে নিয়মিত এসএমএস পেতাম। তিনি বলেন, রাজনীতিতে সেশন জট কমানোর জন্য শুধু ছাত্রলীগ নয়, যুবলীগেও নিয়মিত সম্মেলন হওয়া প্রয়োজন। তা হলে আমাদের মতো সাবেক ছাত্রনেতারা রাজনীতি করার একটা জায়গা পাবে এবং সংগঠনও গতিশীল হবে।

যুবলীগের আগামী সম্মেলনে বয়সসীমা বেঁধে দেওয়ার পক্ষেও মত দিয়েছেন অনেকেই। তাদের মতে, ৭০ বছর বয়সী ব্যক্তিরা যদি যুবসংগঠনের নেতৃত্ব দেয় তা হলে সেটা হাস্যকর হয়ে দাঁড়ায়। উদাহরণ হিসেবে তারা বলেন, এর আগে শেখ ফজলুল করিম সেলিম, মোস্তফা মহসীন মন্টু, জাহাঙ্গীর কবির নানক, মির্জা আজমসহ যারা যুবলীগের শীর্ষ পদে ছিলেন তাদের সবারই বয়স ওইসময় ৫০ বছরের ঘরে ছিল।

কিন্তু সবশেষ সম্মেলনে যুবলীগের চেয়ারম্যান মনোনীত হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আত্মীয় ষাটোর্ধ্ব ওমর ফারুক চৌধুরী। এই কমিটির সাধারণ সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা হারুনুর রশিদের বয়সও এখন সত্তর ছুঁই ছুঁই। যদিও কমিটির ঘোষণার পর বয়সের বিষয়ে জানতে চাইলে যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী মজা করে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, সৃষ্টিশীল মানুষ মাত্রই যুবক। আমার কাছে একজন নারীকে এনে রাখেন। এক বছর পর দেখবেন আমরা তিনজন।

এক সময় আওয়ামী লীগের ভ্যানগার্ড হিসেবে কাজ করেছে যুবলীগ, রাজপথে সক্রিয় থেকেছে। আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকতে সরকারবিরোধী আন্দোলনে প্রতিদিনই কর্মসূচি নিয়ে মাঠে ছিল সংগঠনটি। ওমর ফারুক চৌধুরী ও হারুনুর রশিদ নেতৃত্বে আসেন দল যখন ক্ষমতায়। ফলে সরকারবিরোধী কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামতে না হলেও হরতাল-অবরোধ ইত্যাদির বিরুদ্ধে মাঠে সক্রিয় ছিল যুবলীগ।

এ ছাড়াও দিবসভিত্তিক কর্মসূচিসহ বিভিন্ন পুস্তক ও প্রকাশনার মাধ্যমে সংগঠনের কার্যক্রম সচল রাখে ফারুক-হারুন কমিটি। তবে ক্ষমতাসীন দলের যুব সংগঠন হিসেবে যুবলীগের নেতাকর্মীরা জড়িয়ে পড়েন বিভিন্ন অনিয়মের সঙ্গে। যার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে চলমান অভিযানে।

আওয়ামী লীগের সহযোগী যুব অঙ্গসংগঠন যুবলীগ ১৯৭২ সালের ১১ নভেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন শেখ ফজলুল হক মনি। বাংলাদেশের আন্দোলন-সংগ্রামে যুবলীগের নেতাকর্মীদের তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে শহীদ হওয়া নূর হোসেন যুবলীগের সক্রিয় কর্মী ছিলেন।