এফ জাহান ও মোবারক হোসেন, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের ঘোষণা ছাড়া শেয়ার বিক্রি এবং মূল্য সংবেদনশীল তথ্য গোপন করার বিষয়ে কঠোর হার্ডলাইনে যাচ্ছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ‘বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন’ (বিএসইসি)। সরকারসহ নিয়ন্ত্রক সংস্থা আন্তরিকতার ফলে প্রাতিষ্ঠানিক ও সাধারণ বিনিয়োগকারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। এ সুযোগে কিছু কোম্পানির শেয়ারদর অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে।

অভিযোগ পেলে স্টক এক্সচেঞ্জ দায়সারা গোছের একটি কারণ দর্শানো নোটিস দেয়। কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে মেলে না সদুত্তর। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। এ অবস্থায় ইনসাইডার ট্রেডিংয়ের মাধ্যমে কারসাজি করে শেয়ারদর বাড়ানো হচ্ছে বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।

ইনসাইডার ট্রেডিং হচ্ছে কোম্পানির কোনো গোপন খবর স্টক এক্সচেঞ্জ বা গণমাধ্যমে প্রকাশ না করে নিজেদের মধ্যে লেনদেন করাকে সুবিধাভোগী প্রকৃত গ্রাহক (ইনসাইডার টার্নওভার নিট ক্লায়েন্ট) বলে। যদিও তালিকাভুক্ত কোম্পানির যে কোনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য প্রথমে স্টক এক্সচেঞ্জের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের অবহিত করার বিধান রয়েছে। সেটি না করে প্রথমে তা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাজারে প্রচার করে তারা সিংহভাগ শেয়ার কেনে।

তারপর তা মূল্য সংবেদনশীল তথ্য হিসেবে ডিএসইতে প্রচার করা হয়। তখন সেই তথ্যে আকৃষ্ট হয়ে যখন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা শেয়ার কিনতে থাকেন তখন বেশি দামে সিন্ডিকেট সেগুলো বিক্রি করতে থাকে, যা আইনত সম্পূর্ণ অবৈধ। তাই ইনসাইডার ট্রেডিং বা আগাম তথ্য ফাঁসের বিষয়টি বন্ধ করা খুবই জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ তথ্য ফাঁসকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের আইন খুবই দুর্বল এবং তার প্রয়োগও তেমন দেখা যায় না।

সুত্রে মতে, সম্প্রতি বীমা খাতের কোম্পানি ‘ইস্টল্যান্ড ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড’ এর উদ্যোক্তা কামালউদ্দিন আহমেদ এর বিরুদ্ধে কোনো প্রকার ঘোষণা ছাড়াই ৭ লাখের বেশি শেয়ার কেনার অভিযোগ উঠেছে। ঘোষণা ছাড়া শেয়ার কেনার কারণে তিনি সিকিউরিটিজ আইন ও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) লিস্টিং রেগুলেশন লঙ্ঘন করেছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

চলতি বছরের ৩১ জুলাই থেকে ৪ আগস্টের মধ্যে উদ্যোক্তা কামালউদ্দিন আহমেদ ৭ লাখ ১ হাজার ৪৯৪টি ইস্টল্যান্ড ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার ক্রয় করেন। এসব শেয়ার ক্রয় করার আগে তিনি কোনো ধরনের ঘোষণা দেননি। ফলে ডিএসই’র লিস্টিং রেগুলেশন ২০১৫ এর ৩৪ (১) বিধান এবং সিকিউরিটিজ আইন লঙ্ঘন হয়েছে। এ বিষয়ে কামাল উদ্দিন আহমেদ-এর কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে ডিএসই। পাশাপাশি ইস্টল্যান্ড ইন্স্যুরেন্সের কোম্পানি সচিবকে বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে এবং ঘোষণা ছাড়া উদ্যোক্তা কামালউদ্দিন আহমেদ এর শেয়ার কিনতে কেন বাধা দেয়া হয়নি তা জানতে চেয়েছে ডিএসই।

জানা যায়, কিছু কোম্পানির উদ্যোক্তা ও পরিচালক ঘোষণা ছাড়াই শেয়ার বিক্রি করছে। এতে কিছু ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠান আইন পরিপালন না করে ওইসব উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন। আবার ইস্যুয়ার কোম্পানি উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের শেয়ার ব্লক না রেখে আইন ভঙ্গ করছে। অনেক সময় কোম্পানির মূল্যসংবেদনশীল তথ্য গোপন করে ইনসাইডার ট্রেডিং করা হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে মূল্য সংবেদশীল তথ্য আংশিক প্রকাশ, গোপন করা, দেরিতে প্রকাশ করার মতো ঘটনা ঘটছে। যা সরাসরি আইনের লঙ্ঘন।

এদিকে উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণের বাধ্যবাধকতার কারণে আইন ভঙ্গ করে শেয়ার কিনছেন। কিছু কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকরা শেয়ারহোল্ডিং বিষয়ে আইন মানতে নারাজ। অনেকে আবার শেয়ার ধারণে মিথ্যা তথ্য দিচ্ছেন। অনেকে ডিএসই’র ‘লিস্টিং রেগুলেশন ২০১৫’ মানছেন না। আবার অনেকে অসম্পূর্ণ প্রতিবেদন জমা দিয়ে আইন ভঙ্গ করছে। এসব বিষয় আমলে নিয়ে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন ডিএসই-কে জমা দিতে হবে।

জানা যায়, তালিকাভুক্ত কোম্পানি ফার্মা এইডস, ফরচুন সুজ, আলহাজ্ব টেক্সটাইল, বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিসহ আরো বেশ কয়েকটি কোম্পানি এ আইন লঙ্ঘনের তালিকায় রয়েছে। ইতোমধ্যে আলহাজ্ব টেক্সটাইলকে শাস্তির আওতায় এনেছে কমিশন।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সংবেদনশীল পুঁজিবাজারে উদ্যোক্তা পরিচালকদের ঘোষণা ছাড়া শেয়ার বিক্রি করা এবং মূল্যসংবেদনশীল তথ্য গোপন করে শেয়ার কেনা অনেক বড় অপরাধ। এর মাধ্যমে সাধারণ বিনিয়োগকারীর সঙ্গে প্রতারণা করা হয়। এ সংক্রান্ত অপরাধে শাস্তি হলে বাজারে শৃঙ্খলা আসবে।

ওমেরা ফুয়েলস লিমিটেডের সিইও আকতার হোসেন সান্নামাত বলেন, পুঁজিবাজারকে তখনই ভালো বলা যাবে যখন সেটি ধারাবাহিকভাবে উন্নতি করবে। প্রতিনিয়ত কিছু অসাধু চক্র টাকার বিনিময়ে তথ্য ফাঁস করছে। কোম্পানিগুলোর তথ্য বাজারে আসার আগেই এ চক্র শেয়ার সংগ্রহ করে নিজেদের অবস্থান করে নেয়। তথ্য প্রকাশের পরে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ওই শেয়ারে বিনিয়োগ করে ক্ষতিগ্রস্ত হন। তাই ইনসাইডার ট্রেডিং বা আগাম তথ্য ফাঁসের বিষয়টি বন্ধ করা খুবই জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও তথ্য ফাঁসকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের আইন খুবই দুর্বল।

পুঁজিবাজারের উন্নতি না হওয়ার একটি বিশেষ কারণ হচ্ছে, অধিকাংশ বিনিয়োগকারী মনে করে ক্যাপিটাল মার্কেট একটি দৈনিক বেচাকেনা করার জায়গা। এখানে তাদের স্বল্প সময়ে অধিক লাভের প্রবণতা থাকে। আসলে কিন্ত তা নয়। এটি মূলত দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের জায়গা। তাছাড়া আমাদের দেশে কোম্পানির স¤প্রসারণ বা নতুন শিল্পায়নের জন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া হয়। প্রকৃতপক্ষে ব্যাংকগুলোর স্বল্পমেয়াদি ক্ষুদ্র ঋণ দেওয়ার কথা। আর দীর্ঘমেয়াদি বৃহৎ ঋণের জন্য পুঁজিবাজারকে ব্যবহার করার কথা, যা অধিকাংশ দেশগুলোতেই হয়ে থাকে। যদি বড় প্রকল্পগুলোর জন্য পুঁজিবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহ করা যেত তাহলে বাজার স¤প্রসারিত হতো। এতে লেনদেন ও ভলিউম বাড়তো।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক হাসান মাহামুদ বিল্পব বলেন, ২০১০ সালের পর থেকে পুঁজিবাজারে উল্লেখ করার মতো তেমন কোনো ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়নি। দেশের নাম করা ২০টি ওষুধ কোম্পানির মধ্যে মাত্র পাঁচটি কোম্পানি বাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে। এতদিনে আমরা ইউনিলিভারের মতো একটি ভালো কোম্পানিকে বাজারে আনতে পারিনি অথচ আমাদের পাশের দেশ কিন্তু ঠিকই তা পেরেছে। আর এ ধরনের ভালো কোম্পানিগুলো পুঁজিবাজারে আনতে পারলে বাজারের চেহারা এমনিতেই বদলে যাবে এবং বিনিয়োগকারীদের বাজারের প্রতি আস্থা অনেক বেড়ে যেত। যখন গ্রামীণফোন পুঁজিবাজারে অন্তর্ভুক্ত হয় তখন বাজার একটি ভালো অবস্থানে গিয়েছিল।

‘ইনসাইডার ট্রেডিং’ না থামলে পুঁজিবাজারে আস্থা বাড়বে না মন্তব্য করছেন আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরিফ খান। নয় বছর আগে ধসের পর পুঁজিবাজার ব্যবস্থাপনায় বেশ কিছু সংস্কার আনা হলেও সুবিধাভোগী লেনদেন বা ইনসাইডার ট্রেডিং বন্ধে কঠোর আইন না থাকায় আস্থার সংকট কাটেনি বলে মনে করেন তিনি।

তিনি বলেন, উদ্যোক্তা, ব্যবস্থাপক ও নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠানের (অডিট ফার্ম) মতো কোম্পানির ভেতরের লোকেরাই পুঁজিবাজারের অনিয়ম ‘সবচেয়ে বেশি’ করেন, কারণ তারা আগে থেকেই তথ্যগুলো জানেন। এই ইনসাইডারদের তথ্যের ভিত্তিতে পুঁজিবাজারে অনেক অনিয়ম হয়। এ বিষয়ে আইন থাকলেও তা অত্যন্ত দুর্বল; এ আইনের মাধ্যমে ইনসাইডারদের চার্জশিটের আওতায় আনা যায় না। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও সিঙ্গাপুরের উদাহরণ অনুসরণ করে বাংলাদেশে ‘ইনসাইডার ট্রেডিং’ বন্ধে আরও কঠোর আইন করার ওপর জোর দেন আরিফ খান।

বিএসইসি চেয়ারম্যান ড. খায়রুল হোসেন বলেন, পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতার জন্য ইনসাইডার ট্রেডিং বন্ধে সব সময় বিএসইসি এ বিষয়ে কঠোর নজরদারি করছে। অন্যদিকে বাজারে কারসাজি সহজে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বিএসইসি, ডিএসই ও সিএসইতে সর্বাধুনিক সার্ভিল্যান্স সিস্টেম বসানো হয়েছে বলে তিনি জানান।
এ বিষয় পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, ‘যেসব কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকরা ঘোষণা ছাড়া শেয়ার বিক্রি করছে, আবার অনেকে মূল্যসংবেদনশীল তথ্য গোপন করছে; এগুলো শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এসব কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকদের শাস্তি হওয়া উচিত।’