দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: নানামুখী সমস্যা ঘনীভূত হচ্ছে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকে। মাত্র ৯ মাসের ব্যবধানে ব্যাংকটির মন্দমানের খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় সাড়ে ৬৩ শতাংশ। আর লোকসানি শাখা বেড়েছে ৫৩ শতাংশ। এরই ধারাবাহিকতায় ব্যাংকটির সেপ্টেম্বর শেষে লোকসান হয়েছে ৩০ কোটি ৭৮ লাখ টাকা, যেখানে গত ডিসেম্বরে মুনাফা হয়েছিল ১০ কোটি ১২ লাখ টাকা। এমনিতেই দুর্বল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো একীভূত করতে আইন সংশোধন করা হচ্ছে; এর ওপর ব্যাংকটির আর্থিক অবস্থা অবনতিতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন প্রতিষ্ঠানটির সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক তদন্ত প্রতিবেদনে বেশ কয়েকটি ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা উঠে এসেছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। বেশ কিছু ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবস্থা অত্যন্ত দুর্বল। যে কারণে আর্থিক খাতের দুর্নাম হচ্ছে।

এ দিকে বিদ্যমান ব্যাংক কোম্পানি আইনের সীমাবদ্ধতার কারণে এদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক মার্জারও করতে পারছে না। এর মধ্যে ফারমার্স ব্যাংক থেকে নতুন নামে পরিচালিত পদ্মা ব্যাংক ও আইসিবি ইসলামিক ব্যাংককে দুর্বলতা থেকে উদ্ধার করতে বিশেষ প্যাকেজের আওতায় তদারকি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এ দুর্বলতার কথা বাংলাদেশ ব্যাংক যেমন জানে, তেমনি সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলও অবহিত রয়েছে। কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে কোনো আইনি কাঠামো না থাকায় দুর্বল কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান স্বেচ্ছায় মার্জার বা একীভূত হচ্ছে না। আবার তাদের দুর্বলতার কারণে গ্রাহকরা টাকা ফেরত না পাওয়ায় পুরো আর্থিক খাতের দুর্নাম হচ্ছে। এ দুর্নাম এড়াতে বা আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা রক্ষায় দুর্বল ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে বাধ্যতামূলকভাবে একে অপরের সাথে মার্জার ও একীভূত হতে পারে, সে জন্য ব্যাংক কোম্পানি আইন হালনাগাদ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

ইতোমধ্যে নীতিমালার খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে দুর্বল ব্যাংকগুলো চিহ্নিতকরণের স্তর নির্ধারণ করা হয়েছে। ওই স্তরের মধ্যে যারাই পড়বে তাদেরকে বাধ্যতামূলকভাবে একীভূতকরণের বিধান রাখা হয়েছে। এটি অনুমোদন হলে একে অপরের সাথে মার্জার বা একীভূত হতে বাধ্য হবে দুর্বল ব্যাংকগুলো।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এমন উদ্যোগে অন্যান্য ব্যাংকগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও চিন্তিত হয়ে পড়েছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কমার্স ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আব্দুল খালেক খান কমার্স ব্যাংকের এমডি হিসেবে যোগদানের পর থেকেই বিভিন্ন আর্থিক সূচকগুলো পতন হতে শুরু করেছে।

গত দেড় বছরের ব্যাংকটির বিভিন্ন আর্থিক সূচক তুলনা করলেই এর প্রমাণ মিলবে। যেমন, গত বছরের আগস্টে ব্যাংকটির ঋণ ছিল ২ হাজার ১২২ কোটি টাকা। ডিসেম্বরে এসে এ ঋণ বেড়ে যায় ২ হাজার ২১৪ কোটি টাকায়। চলতি বছরের আগস্টে এসে ডিসেম্বরের চেয়ে ব্যাংকটির ঋণ কমে হয় ২ হাজার ২১২ কোটি টাকায়। আর সেপ্টেম্বরে এসে ডিসেম্বরের চেয়ে ব্যাংকটির ঋণ সামান্য বেড়ে হয় ২ হাজার ২২৮ কোটি টাকা।

এ দিকে ঋণ সামান্য বাড়লেও মন্দ মানের খেলাপি ঋণ অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায়। যেমন, গত ডিসেম্বরে এসে ব্যাংকটির মন্দমানের খেলাপি ঋণ ছিল ৫৯২ কোটি ৯৯ লাখ টাকা, কিন্তু সেপ্টেম্বরে এসে এ মন্দমানের খেলাপি ঋণ বেড়ে হয় ৯৬৭ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। মাত্র ৯ মাসের ব্যবধানে ব্যাংকটির মন্দমানের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৬৩ দশমিক ৩৯ শতাংশ। মন্দঋণ বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে লোকসানি শাখার সংখ্যাও বেড়েছে। গত ডিসেম্বরে ব্যাংকটির লোকসানি শাখা সংখ্যা ছিল ১৭টি। মাত্র ৯ মাসের ব্যবধানে ব্যাংকটির লোকসানি শাখার সংখ্যা ১৭টি থেকে বেড়ে ২৬টিতে উন্নীত হয়েছে। ৯ মাসে লোকসানি শাখার সংখ্যা বেড়েছে ৯টি, যা শতকরা হিসেবে প্রায় ৫৩ ভাগ।

মন্দমানের খেলাপি ঋণ ও লোকসানি শাখা বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি ব্যাংকটির মুনাফায়ও ধস নেমেছে। ব্যাংকটির এক পরিসংখ্যান মতে, গত বছরের আগস্টে ব্যাংকটি মুনাফা করেছিল ৮ কোটি ২৯ লাখ টাকা। গত ডিসেম্বর শেষে মুনাফা আরো বেড়ে হয় ১০ কোটি ১২ লাখ টাকা। দীর্ঘ দিনে লোকসানে থাকা ব্যাংকটি ধীরে ধীরে মুনাফায় ফিরে আসায় সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যেও স্বস্তি এসেছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের গত বছরের অবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকেও প্রশংসিত হয়েছিল।

কারণ, ব্যাংকটি দীর্ঘ দিন বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে সমস্যাকবলিত ব্যাংক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। মুনাফায় ফিরে আসায় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও ইতিবাচক হিসেবে নিয়েছিল। কিন্তু গত জানুয়ারির পর থেকে আবারো ব্যাংকটির বিভিন্ন সূচক নেগেটিভ হওয়ায় সবার মধ্যেই হতাশা ফিরে এসেছে।

কমার্স ব্যাংকের এক পরিসংখ্যান মতে, গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকটি যেখানে মুনাফা করেছিল ১০ কোটি ১২ লাখ টাকা, গত আগস্ট শেষে মুনাফার পরিবর্তে লোকসান হয় ২৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। দিন দিন এ লোকসানের পরিমাণ বাড়ছে। গত সেপ্টেম্বর শেষে লোকসানের পরিমাণ আরো বেড়ে হয় ৩০ কোটি ৭৮ লাখ টাকা।

তবে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের এমডি আব্দুল খালেক খান এ বিষয়ে জানিয়েছেন, ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত ১২ জন শীর্ষ ঋণখেলাপিকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে বড় অঙ্কের ঋণ আদায় ও ঋণ নিয়মিত করা হয়েছে। যেমন গত ১৫ দিনে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিধিমালা মেনেই ১০০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে। গত ছয় মাসে ২৮ হাজার নতুন ডিপোজিট অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে। সবমিলে কমার্স ব্যাংক ভালো করছে বলে তিনি দাবি করেন। ডিসেম্বর শেষে আরো ভালো করবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।