দেশ প্রতিক্ষণ, বগুড়া: আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার আগে যাঁদের ব্যাংক হিসাব পর্যন্ত ছিল না, এখন তাঁরা কোটিপতি। বাড়ি-গাড়ির মালিক হয়েছেন। অনেকের আবার দেশের বাইরে বাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। বগুড়ায় ক্ষমতাসীন দল ও এর সহযোগী সংগঠনের এমন সব নেতা, যাঁদের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন ও অপকর্মের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে তাঁদের তালিকা করেছে পুলিশ। তাঁদের সংখ্যা অর্ধশতাধিক বলে জানা গেছে।

তালিকায় নাম আসা নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তের স্বার্থে তাঁদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে। এমনকি তাঁরা যেন বিদেশ চলে যেতে না পারেন, সে ব্যাপারেও খেয়াল রাখা হচ্ছে। পুলিশের হাতে থাকা এই তালিকায় বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, শ্রমিক লীগ ও ক্ষমতাসীন দলে যোগ দেওয়া কিছু সুবিধাবাদী নেতার নাম রয়েছে।

আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের সবুজ সংকেত পেলেই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে পুলিশের অভিযান শুরু হতে পারে। সে কারণে বগুড়ায় ক্ষমতাসীন দলের নেতারা আতঙ্কে রয়েছেন। বগুড়া পুলিশের গোয়েন্দাদের একাধিক সূত্র ও আওয়ামী লীগ নেতারা এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

বগুড়ার পুলিশ সুপার আলী আশরাফ ভূঞা বলেন, ‘বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি ব্যাপার। সরকারি নির্দেশনা মেনে কাজ করা হবে। অপরাধী হলে তার পার পাওয়ার সুযোগ নেই।’

সূত্রগুলো বলছে, আওয়ামী লীগের ভেতরে যাঁরা অপকর্ম করছেন, দলের নাম ব্যবহার করে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসসহ নানা রকম অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত আছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে তালিকা প্রণয়নের জন্য নির্দেশনা রয়েছে। তিনটি গোয়েন্দা সংস্থা এ ব্যাপারে কাজ করছে। দুই শতাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেলেও অর্ধশতাধিকের বিরুদ্ধে অভিযোগের দালিলিক প্রমাণ পাওয়া গেছে। সেসব তথ্য-প্রমাণ ও সংশ্লিষ্ট ছবি সংগ্রহ করা হয়েছে। সেগুলো প্রধানমন্ত্রী বরাবর পাঠানো হয়েছে। এখন শুধু নির্দেশের অপেক্ষা।

পুলিশের একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে যে মূলত পাঁচ ধরনের অভিযোগ খতিয়ে দেখা হয়েছে। এগুলো হলো অবৈধ টেন্ডার বাণিজ্য ও দলীয় পরিচয় ব্যবহার করে টেন্ডারে প্রভাব বিস্তার করা, সন্ত্রাসের মাধ্যমে অন্যের জমি দখল করা এবং বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে চাঁদা আদায়, মাদক সেবন, মাদক কারবার বা মাদকসেবীদের সঙ্গে যোগসাজশ, জঙ্গিদের সঙ্গে সম্পৃক্ততা, তাদের সহায়তা করা ও প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে জঙ্গিদের মদদ দেওয়া, সংখ্যালঘুদের নির্যাতন, তাদের সম্পদ দখল, নিপীড়ন ও নারী নির্যাতন, নারী নিপীড়নসহ নারী নিপীড়নকারীদের নানা রকম সহায়তার অভিযোগ।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের একটি সূত্র জানায়, যাঁদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ রয়েছে এবং যাঁরা সীমা অতিক্রম করেছেন, ধাপে ধাপে তাঁদের আইনের আওতায় আনার প্রক্রিয়া চলছে। কাউকে কাউকে সতর্কবার্তাও দেওয়া হচ্ছে, যাতে তাঁরা অন্যায়-অপকর্ম থেকে সরে যান।

জানা গেছে, তালিকায় বগুড়া জেলা ও শহর আওয়ামী লীগের ১০ জন, জেলা যুবলীগের ২০ জন, জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের ১০ জন এবং জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে দলে নতুন করে যোগ দেওয়া নেতাসহ ১০ জনের নাম রয়েছে। এ ছাড়া আরেকটি তালিকা গোয়েন্দাদের হাতে রয়েছে, যাতে একই অভিযোগে অভিযুক্ত বিভিন্ন দল এবং সুবিধাবাদী কিছু ব্যক্তি রয়েছেন।

পুলিশের এই তালিকা ছাড়াও এর আগে জেলা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনসহ বিভিন্ন অভিযোগে বেশ কয়েকজন নেতার নামে নোটিশ জারি করেছে। তাঁরা হলেন বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মঞ্জুরুল আলম মোহন ও তাঁর স্ত্রী কোহিনুর মোহন, দলের সাংগঠনিক সম্পাদক আসাদুর রহমান দুলু ও তাঁর স্ত্রী শামিমা জেসমিন, বগুড়ার প্রভাবশালী পরিবহন ব্যবসায়ী ও বগুড়া মোটর মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক সদর উপজেলা যুবলীগের সহসভাপতি আমিনুল ইসলাম ও তাঁর বাবা বগুড়ার ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও জেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি আব্দুল লতিফ মণ্ডল,

আদমদীঘি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নিসরুল হামিদ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাজেদুল ইসলাম, সহসভাপতি আবু রেজা খান, যুবলীগের সভাপতি শাহিনুর রহমান, উপজেলা শ্রমিক লীগের আহ্বায়ক রাশেদুল ইসলাম, কৃষক লীগের সভাপতি হারুন অর রশিদ, শহর শ্রমিক লীগের বহিষ্কৃত নেতা তুফান সরকার ও যুবলীগের সাবেক নেতা মাকছুদুল আলম। এ ছাড়া বগুড়া জেলা ট্রাক মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক যুবলীগ নেতা আব্দুল মতিন সরকার ও শুকরা এন্টারপ্রাইজের মালিক আবদুল মান্নান জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদকের করা মামলায় জেল খেটে জামিনে ছাড়া পেয়েছেন।

দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয়, বগুড়ার সহকারী পরিচালক আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘বগুড়ার আরো অনেকেই এই তালিকায় যুক্ত হবেন। দুদক তার মতো করে কাজ করে যাচ্ছে।’

বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের উপদপ্তর সম্পাদক মাশরাফি হিরো বলেন, ‘দলের বড় পোস্টে থাকলেও দলীয় কর্মকাণ্ডে অনেকেই নিয়মিত নন; যার কারণে কারা গাঢাকা দিল আর কারা দেশে নেই, এই তথ্য বলা মুশকিল। তবে সুবিধাবাদী ও দুর্নীতিপরায়ণ নেতারা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে আছে—এটা সঠিক