দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সবচেয়ে বেশি যার নাম আলোচনায় আসে তিনি অমিত সাহা। গত বৃহস্পতিবার সকালে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) একটি টিম সবুজবাগ এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে। একই সঙ্গে মিজানুর রহমান মিজান ও হোসেন মোহাম্মদ তোহা নামে আরও দুজনকে গ্রেপ্তার করে ডিবি। এ তিনজনকে নিয়ে আবরার হত্যা মামলার আসামি হিসেবে ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হলো।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানান, আবরার হত্যাকাণ্ডের সময় ঘটনাস্থলে অমিত সাহার উপস্থিতি মুখ্য বিষয় নয়। তবে আবরার হত্যাকাণ্ডে অমিতের জড়িত থাকার তথ্য-প্রমাণ পাওয়ায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এখন তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তার ভূমিকার বিস্তারিত জানা যাবে।

বুয়েটের একাধিক শিক্ষার্থী জানান, অমিত সাহা ছিলেন বুয়েটের শেরেবাংলা হলের একজন দুর্ধর্ষ প্রকৃতির নেতা। বুয়েট ছাত্রলীগের উপ-আইন বিষয়ক সম্পাদক তিনি। শেরেবাংলা হলের ‘টর্চার সেল’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া ২০১১ নম্বর রুমের মূল বাসিন্দা তিনি। সাধারণ ও নিরীহ শিক্ষার্থীদের মাঝেমধ্যেই সেই রুমে ডেকে নিয়ে নির্যাতনের অভিযোগ বেশ পুরনো। ছাত্রলীগের মিছিল-মিটিংয়ে গরহাজির থাকা শিক্ষার্থীদেরও সেই রুমে নিয়ে নানা কায়দায় নির্যাতন করা হয়।

প্রথম বর্ষের ছাত্রদের ওই কক্ষে নিয়ে নির্যাতন করায় অমিত সাহা ‘র‌্যাগিং কিং’ হিসেবেই পরিচিত হলে। অনেক আগে থেকেই মূলত অমিতের প্ররোচনাতেই ছাত্রলীগের ‘জুনিয়র গ্রুপ’ আবরারের ফেইসবুকসহ তার কর্মকাণ্ড অনুসরণ শুরু করেন। শুধু তাই নয়, আবরারের রুমমেট মিজানকেও তার সম্পর্কে তথ্য সরবরাহের নির্দেশনা দেওয়া হয়। অমিতের নির্দেশনাতেই মিজান আবরারের বিষয়ে নানা তথ্য সরবরাহ করতে থাকেন।

ডিবির এক কর্মকর্তা  বলেন, আবরার হত্যাকাণ্ডে রুমমেট মিজানুর রহমানের মিজানের সম্পৃক্ততার তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। তার মাধ্যমেই আবরারকে শিবির হিসেবে সন্দেহ করতে থাকে ছাত্রলীগ নেতারা। এর মধ্যে কাশ্মীরের ঘটনা ও প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর নিয়ে আবরারের স্ট্যাটাস দেখার পরপরই তাকে পিটিয়ে হল থেকে বের করে দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয় বুয়েট ছাত্রলীগের গোপন মেসেঞ্জার গ্রুপে।

গত ৫ অক্টোবর বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল মেসেঞ্জার গ্রুপে ১৭তম ব্যাচের প্রতি এ বিষয়ে কড়া নির্দেশ দেন। তার আগে ওই গোপন মেসেঞ্জার গ্রুপে অমিত সাহাও আবরারকে খুঁজতে থাকেন।

আবরার হলে এসেছেন কি না জানতে চান গ্রুপের জুনিয়র মেম্বারদের কাছে। তাদের কাছ থেকে নিশ্চিত হওয়ার পরই আবরারকে তার রুম থেকে ডেকে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয় বলে জানান হলের শিক্ষার্থীরা। তারা আরও জানান, আবরার সম্পর্কে সত্য-মিথ্যা যাচাই না করেই শিবির ট্যাগ লাগিয়ে মারধরের পরিকল্পনা করা হয়। এরই অংশ হিসেবে পরিকল্পিতভাবে তাকে পিটিয়ে মারা হয়।

ডিবির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, মিজানুর রহমান মিজান নামে আবরারের যে রুমমেট গ্রেপ্তার হয়েছেন, সেই মিজানের মাধ্যমেই অমিত সাহা আবরারকে শিবির হিসেবে পরিচিত করে তোলেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেলের কাছে। পরে রাসেল ও তার সহযোগীদের মাধ্যমেই পেটানোর ঘটনা ঘটে।

আমাদের নেত্রকোনা প্রতিনিধি জানিয়েছে, অমিত সাহা জেলা সদরের ঠাকুরাকোনার স্থায়ী বাসিন্দা রঞ্জিত সাহার ছেলে। তিনি ধানের বড় ব্যবসায়ী। ঠাকুরাকোনা বাজারে সাহা ট্রেডার্স নামে দোকান আছে। সেখানকার একাধিক বাসিন্দা জানিয়েছেন, রঞ্জিত সাহার লাইসেন্সের নাম দিয়ে ও টাকা দিয়ে অনেকেই ঠিকাদারি করছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অমিত সাহা ২০১৪ সালে নেত্রকোনা জেলা শহরের আঞ্জুমান আদর্শ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও ২০১৬ সালে নটর ডেম কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। অমিতের ব্যাপার জানার চেষ্টার জন্য তার পরিবারের কারও সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তার এক নিকট আত্মীয় জানান, অমিতের বাবা-মা বর্তমানে ভারতে তীর্থযাত্রায় রয়েছেন।

তাদের আগের বাসা নেত্রকোনা পৌর শহরের নাগড়ায় সাহা পাড়ায় থাকলেও ২০০৫ সালে তিনি সেটা বিক্রি করে তেরী বাজার এলাকায় ঝুমা রানী তালুকদারের কাছ থেকে ২ দশমিক ৫০ শতক জায়গা কেনেন। যে জায়গা নিয়ে আদালতে মামলা চলছে।

রঞ্জিতের ব্যবসায়ী অংশীদার অনিল কান্তি সাহা বলেন, গত ২৩ সেপ্টেম্বর থেকে রঞ্জিত তার স্ত্রীসহ ভারতের বৃন্দাবনে অবস্থান করছেন। প্রতি মাসেই তারা সেখানে যান। তারা নিরামিষভোজী। গৌরভক্ত। গলায় মালা পরতে হয়। সারাদিনই মালা জপে থাকেন তারা।