দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে দুই হাজার কোটি টাকা চায় সরকারি বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)। এরমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এক হাজার কোটি টাকা এবং ৫টি সরকারি ব্যাংক থেকে এক হাজার কোটি টাকা নিবে। মেয়াদি আমানত হিসাবে এই টাকা নেয়া হচ্ছে সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে। এর পুরোটাই শেয়ারবাজারকে সাপোর্ট দেয়ার জন্য বিনিয়োগ করা হবে।

ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠানগুলোতে আবেদন করা হয়েছে। তবে শেয়ারবাজারের জন্য টাকা নিয়ে অনত্র বিনিয়োগ করার অভিযোগ রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত এ প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। এক্ষেত্রে সদ্য বিদায়ী আইসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী সানাউল হকের সময়ে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে নেয়া অর্থের কিস্তি পরিশোধ না করার অভিযোগ রয়েছে আইসিবির বিরুদ্ধে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দুই হাজার কোটি টাকার মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ১ হাজার কোটি টাকার জন্য আবেদন করেছে আইসিবি। এছাড়া রূপালী ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (বিডিবিএল) এই পাঁচ প্রতিষ্ঠানের প্রত্যেকটি থেকে ২০০ কোটি করে আরও এক হাজার কোটি টাকা চেয়ে আবেদন করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এসব টাকার সম্পূর্ণটাই শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করা হবে বলে আইসিবি সূত্রে জানা গেছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আবুল হোসেন বলেন, এই ফান্ডের (অর্থের) জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সরকারি ৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আবেদন করা হয়েছে। শেয়ারবাজারের সাপোর্টের জন্য এই ফান্ড চাওয়া হয়েছে। শেয়ারবাজারে যখন দরপতন চলতে থাকে তখন বিনিয়োগ করার মতো কেউ থাকে না। ওই পরিস্থিতিতে বাড়তি অর্থ বিনিয়োগ না করলে বাজারে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। সে কারণে বিনিয়োগের জন্যই সরকারের কাছে পাঁচ হাজার কোটি টাকার তহবিল চাওয়া হয়েছে।

সরকার এর আগে আইসিবিকে দুই হাজার কোটি টাকা বন্ড সুবিধা দিয়েছিল, তা দিয়ে পাঁচ-ছয় মাস ধরে বাজারকে সাপোর্ট দেয়া হয়েছে। কিন্তু বন্ডের সুদহার অনেক বেশি। তাই সরকারের কাছ থেকে তহবিল পেলে তা কম সুদে বিনিয়োগ করা সম্ভব হবে। আর বাজার স্থিতিশীল রাখতে সরকারের সহযোগিতাও প্রয়োজন।

তবে শেয়ারবাজারের বাইরে অন্যত্র টাকা সরিয়ে নেয়ার বিষয়ে আইসিবির এমডি বলেন, আমাদের মোট তহবিলের ৫ থেকে ৮ শতাংশ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ রয়েছে। এটি কোন বড় অঙ্কের অর্থ নয়। অনেক সময় যেসব প্রতিষ্ঠান থেকে আমরা ফান্ড সংগ্রহ করি তারা হঠাৎ তা ফেরত চাইলে দিতে হয়, আর তখন যদি শেয়ার বিক্রি করে তাদের টাকা দিতে হয় তাহলে ব্যাপক দরপতন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই শেয়ারবাজারের বাইরেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আইসিবি অর্থ রাখে। এছাড়াও আগের ঋণের নিয়মিত কিস্তি পরিশোধ করা হচ্ছে বলে দাবি করেন তিনি।

এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, আগেও আসিবিকে টাকা দেয়া হয়েছিল কিন্তু তাতে তো কোন কিছুই হয়নি। আগে ব্যাংকিং খাতের সমস্যা সমাধান করতে হবে। তবে তহবিল অনত্র সরিয়ে ফেললে তা দুঃখজনক এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে (বিএসইসি) এ বিষয়ে ক্ষতিয়ে দেখা উচিৎ ।

এদিকে গত বছরের মাঝামাঝিতে সরকারের কাছ থেকে দুই হাজার কোটি টাকার বন্ড পায় আইসিবি। এর মধ্যে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের দেড় হাজার কোটি টাকা থেকে গত ১৮ মার্চ পর্যন্ত এক হাজার ২৩৬ কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে; অবশিষ্ট আছে ২৬৪ কোটি টাকা। গত ৬ নভেম্বর ডিএসইর সূচক ছিল ৫ হাজার ২০৪ পয়েন্ট। বন্ডের মাধ্যমে নেয়া অর্থ বিনিয়োগের পর গত ২৪ জানুয়ারি সূচক বেড়ে ৫ হাজার ৯৫০ পয়েন্টে উন্নীত হয়। এরপর থেকেই বাজার নিম্নমুখী হতে শুরু করে।

গত ১৯ মার্চ লেনদেন শেষে সূচক ৫ হাজার ৬০৫ পয়েন্টে অবস্থান করছে। সংস্থাটি বলছে, পুঁজিবাজারে আইসিবির মতো বড় বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান না থাকায় শেয়ার বিক্রি করা অর্থ পুঁজিবাজার থেকে উত্তোলন করা সব সময় সম্ভব হয় না। ফলে ব্যাংক থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে তহবিল সংগ্রহ করে বাজারে বিনিয়োগ করতে হয়েছে। এ কারণে ২০১১ সালের ৩০ জুন আইসিবির টার্ম ডিপোজিটের স্থিতি ছিল ২ হাজার ২৭১ কোটি টাকা, যা গত ৩০ জুন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৮৪১ কোটি টাকা। বেড়েছে সুদ ব্যয়ও।

আইসিবির তথ্য মতে, ২০১১-১২ থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত আইসিবির মেয়াদি আমানতে বৃদ্ধির হার বছরে ২১ শতাংশ। এ সময়ে মোট আয় বৃদ্ধির হার ১৩ শতাংশ। পোর্টফোলিও বৃদ্ধির হার বছরে ১৫ শতাংশ হলেও সুদ ব্যয়ের হার ছিল ২৪ শতাংশ। মেয়াদি আমানত বাড়ার কারণে করপোরেশনের সুদ ব্যয়ও বাড়ছে। সম্প্রতি পাওয়া দুই হাজার কোটি টাকার বন্ডে সুদহার ৯ শতাংশ।

এতে আগামী বছরগুলোতে সুদব্যয় আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ বাড়তি ব্যয় মেটাতে নিজস্ব পোর্টফোলিওর মূলধনী মুনাফা ও লভ্যাংশ আয়ের ওপর নির্ভর করতে হবে। এতে বাজারে আরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কাও করছে আইসিবি। এরই মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত বিভিন্ন ব্যাংক থেকে আইসিবির নেয়া ‘সিঙ্গেল পার্টি এক্সপোজার’ সীমার অতিরিক্ত অর্থ সমন্বয় করতে তাগাদা দেয়া শুরু হয়েছে।

২০১৬-১৭ অর্থবছরে আইসিবি ৪ হাজার ৪৩১ কোটি টাকার শেয়ার কেনে। বিপরীতে বিক্রি করে ৩ হাজার ৩৭৩ কোটি টাকার শেয়ার। একই অর্থবছরে বাজারমূল্যে আইসিবির পোর্টফোলিও মূল্য ছিল ১০ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা। পরের অর্থবছর সংস্থাটি ২ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকার শেয়ার ক্রয় ও বিক্রি করে ২ হাজার ৮৬২ কোটি টাকার। একই অর্থবছরে বাজারমূল্যে আইসিবির পোর্টফোলিও মূল্য ছিল ১০ হাজার ৭১ কোটি টাকা। আর চলতি অর্থবছরের ১৮ মার্চ পর্যন্ত আইসিবি ২ হাজার ২৬৯ কোটি টাকার শেয়ার কিনেছে, বিক্রি করেছে এক হাজার ৭২৪ কোটি টাকার শেয়ার। বাজার মূল্যে আইসিবির পোর্টফোলিওর মূল্য ১১ হাজার ৩০ কোটি টাকা।

শেয়ারাবাজারের জন্য গুরুত্বপূর্ন এবং রাষ্ট্রায়ত্ত একমাত্র বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান আইসিবি। তবে শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে রয়েছে বড় ধরনের অভিযোগ। বিশেষ করে বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার মূল্য প্রভাবিত করা, দুর্বল কোম্পানি বাজারে নিয়ে এবং সরকারি ইক্যুইটি অ্যান্ড এন্টারপ্রেনিয়র ফান্ডে (ইইফ) দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। বাজার সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ আইসিবির মূল কাজ হচ্ছে দরপতন হলে শেয়ারবাজারকে সাপোর্ট দেয়া, কিন্তু তা না করে বাজারে ট্রেডারের ভূমিকায় থাকে বেশি। কোন শেয়ারের দাম বাড়লেই বিক্রি করার অভিযোগ রয়েছে অনেক।

এ বিষয়ে পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মিজানুর রহমান চৌধুরী বলেন, বাজারে মূল সমস্যা হচ্ছে আস্থার সংকট। এগ আস্থার সংকট দূর করতে হবে, তা না হলে যত ফান্ডই আসুক কোন কাজ হবে না। আস্থার সংকট দূর করতে হলে দূর্বল কোম্পানি পুঁজিবাজারে আনা বন্ধ করতে হবে। যেসব শেয়ারে দাম ইস্যুমূল্যের নিচে চলে আসছে সেগুলো কোম্পানির মালিকদের নিতে হবে। নিয়ন্ত্রক সংস্থাতে যোগ্য লোক নিয়োগ দিতে হবে।

শেয়ারবাজারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান আইসিবি। তবে এ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বড় ধরনের অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ারমূল্য প্রভাবিত করা, দুর্বল কোম্পানি বাজারে নিয়ে আসা এবং সরকারি ইকুইটি অ্যান্ড এন্টারপ্রেনার ফান্ডে (ইইফ) দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।