মোবারক হোসেন, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজার গতিশীল করতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও সবই কার্যত বিফলে যাচ্ছে। বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে তারল্য সরবরাহ বৃদ্ধি ও আইনগত সহায়তা দেওয়া সত্ত্বেও বাজার গতিহীন। সময় যত গড়াচ্ছে পুঁজিবাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের অনাস্থা আরো প্রকট হচ্ছে। আস্থাহীনতা থেকে তাঁরা শেয়ার বিক্রি করে বাজার ছাড়ছেন।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজারে শেয়ার বিক্রির চাপ বাড়ায় প্রতিদিনই কমছে শেয়ারের দাম। আর লোকসান হলেও ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরাও বাজারে নিষ্ক্রিয়। মাঝে মধ্যে তারা সক্রিয় হলে বাজার ঊর্ধ্বমুখী হয়, আবার নিষ্ক্রিয় হলেই বাজারও নিম্নমুখী হয়ে পড়ে।

নিয়ন্ত্রক সংস্থা সূত্র বলছে, স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে বিভিন্ন সময় বৈঠক করে তাঁদের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে আইন সংস্কার করা হয়েছে। তার পরও তাঁরা বাজারে সক্রিয় হওয়ার পরিবর্তে নিষ্কিয় ভূমিকা পালন করছেন। বড় বিনিয়োগকারীদের এমন অস্বাভাবিক আচরণের কারণ খতিয়ে দেখছে কমিশন। তেমনি পুঁজিবাজারের গতি ফেরাতে একের পর এক সুবিধা দিয়েও পতন ঠেকানো যাচ্ছে না।

প্রতিনিয়ত দরপতনের কবলে পড়ে পুঁজি হারাচ্ছেন ছোট ও মাঝারি বিনিয়োগকারীরা। আগের দুই সপ্তাহের ধারাবাহিকতায় গত সপ্তাহ জুড়েই পুঁজিবাজারে দরপতন হয়েছে। এতে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সব মূল্যসূচকের পতন হয়েছে। একইসঙ্গে কমেছে গড় লেনদেনের পরিমাণও। এক সপ্তাহের ব্যবধানে ডিএসই’র বাজার মূলধন কমেছে ৪ হাজার ৩১৩ কোটি টাকা।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, পুঁজিবাজারের গতি ফেরাতে ও স্থিতিশীল বাজার গড়তে হলে সরকারকে বড় ধরনের ছয়টি উদ্যোগ নিতে হবে। প্রথমত, বাজারে নতুন করে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করা, না হয় সব ধরনের সুবিধা বন্ধ করে বাজারকে পতনের সর্বশেষ সীমায় যাওয়ার সুযোগ দেওয়া। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে (বিএসইসি) ভেঙে দিয়ে বিএসইসিকে নতুন করে ঢেলে সাজানো। তৃতীয়ত, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ ও মার্কেট মেকার নিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থার সমন্বয় সাধন করে বাজারে বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে হবে।

চতুর্থত, আইসিবিকে দ্রুত শক্তিশালী করতে হবে। বিশেষ করে আইসিবিকে ডে টেডিং’র ভুমিকায় না থেকে ভাল মৌল ভিত্তি কোম্পানিতে বিনিয়োগ করতে হবে।

পঞ্চমত, পতনমুখী পুঁজিবাজারে মিউচ্যুয়াল ফান্ডকে বিনিয়োগমুখী করা প্রয়োজন। তেমনি অতিমুল্যায়িত বাজারে শেয়ার বিক্রি করে, দরপতন বাজারে ক্রয় করতে হবে। এটাই মিউচ্যুয়াল ফান্ডের কাজ।

ষষ্ঠতম, রাষ্টায়ত্ত পাঁচ ব্যাংককে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগমুখী হওয়া প্রয়োজন। তবে এ ক্ষেত্রে ঘোষণা নয়, গোপনীয়তা ভাবে শেয়ার ক্রয় করতে হবে।
এই ছয় উদ্যোগের যেকোনও একটিকে বেছে নেওয়ার মাধ্যমে পুঁজিবাজারের গতি ফেরানো সম্ভব বলে মনে করে অর্থনীতিবিদরা।

পুঁজিবাজারের এই পরিস্থিতির জন্য তারল্য সংকটকে প্রধান কারণ বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ আবু আহমেদ। তিনি বলেন, ‘গ্রামীণফোন ইস্যুতে বাজার আরও খারাপ করেছে।  এখন এই বাজারকে তুলতে হলে ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) এর মাধ্যমে হোক অথবা অন্য কোনও মাধ্যমে হোক, অবশ্যই বাজারে বিনিয়োগ করতে হবে।

তিনি বলেন, ‘বর্তমান বাজারে তারল্য সংকট ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। এই তারল্য সংকট কাটাতে হলে নতুন করে টাকা দিতে হবে। তবে অন্যভাবেও বাজার ঠিক হতে পারে, সেটা হলো পতনের সুযোগ দিতে হবে। নিচের দিকে নামতে নামতে একসময় গিয়ে আর নিচে নামবে না। সেখান থেকে আপনা আপনিই ঠিক হয়ে যাবে। ’

প্রসঙ্গত, অব্যাহত দরপতনের কবলে পড়ে তিন বছর আগের অবস্থানে ফিরে গেছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল্যসূচক। বর্তমানে ডিএসইর বাজার মূলধন দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৫৯ হাজার ৩৩ কোটি টাকা। এক সপ্তাহ আগে ডিএসইর বাজার মূলধন ছিল ৩ লাখ ৬৩ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা। অবশ্য শেয়ারবাজারের গতি ফেরাতে সম্প্রতি নানামুখী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

এরইমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক বেশ কিছু ছাড় দিয়েছে। শেয়ারবাজারের তারল্য সংকট কাটাতে বাড়ানো হয়েছে বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণ আমানত অনুপাত (এডিআর) । রেপোর (পুনঃক্রয়চুক্তি) মাধ্যমে অর্থ সরবরাহের সুযোগও দেওয়া হয়েছে। শেয়ারবাজারে তারল্য বাড়াতে রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) বিনিয়োগ বাড়িয়েছে। বন্ড বিক্রি করে সোনালী ব্যাংক থেকে পাওয়া ২০০ কোটি টাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করছে প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু এর কোনও ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে না।

বিনিয়োগকারীদের আস্থা না থাকায় উল্টো পতনের বাজারে লেনদেন খরা নতুন মাত্রা পেয়েছে। এদিকে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক এবং সরকারি পাঁচ প্রতিষ্ঠানের কাছে দুই হাজার কোটি টাকা চেয়েছে আইসিবি। এ টাকার পুরোটা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করা হবে বলে জানা গেছে। এছাড়া ইউনিট ফান্ডের মাধ্যমে আইসিবিকে তহবিল সংগ্রহের সুযোগ দিতে চাচ্ছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ‘পুঁজিবাজার কিছু লোকের হাতে জিম্মি। এ কারণে পুঁজিবাজারে কোনও ভালো কিছু আশা করা যাচ্ছে না। বিশেষ করে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) কিছু ব্যক্তি এই বাজারকে কুক্ষিগত করে রেখেছে। তিনি বলেন, পুঁজিবাজারের গতি ফেরাতে যখনই কোনও জায়গা থেকে টাকা দেওয়া হয়, ডিএসই’র ওই ব্যক্তিরা ওই টাকা মেরে দেয়। যে কারণে এই বাজার ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না। ’

তিনি আরও বলেন, ‘এই বাজারকে মানুষের আস্থায় আনতে হলে সরকারকে বড় ধরনের উদ্যোগ নিতে হবে। ’ এদিকে, বিএসইসি ভেঙে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। তিনি বলেন, ‘বিএসইসিকে ঢেলে সাজাতে হবে। কারণ, এই বিএসইসি ব্যর্থ হয়েছে। ’ তার মতে, ‘শুধু বিএসইসি বদলালেই হবে না, এখানে শক্ত লোক নিয়োগ দিতে হবে। যারা কোনোভাবেই পুঁজিবাজারে লেনদেনের সঙ্গে যুক্ত থাকবেন না। ’

বাজার বিশ্লেষনে দেখা গেছে, অব্যাহত পতনের কবলে পড়ে গত ১৩ অক্টোবর ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থানে চলে আসে। এরপর আইসিবির বিনিয়োগ বাড়ানোর ফলে ১৫ অক্টোবর বড় উত্থান হলেও পরের কার্যদিবসেই বড় দরপতন হয়। সেই পতনের ধারা সপ্তাহের শেষ কার্যদিবস বৃহস্পতিবারও অব্যাহত থেকেছে।

ফলে শেষ ৯ কার্যদিবসের মধ্যে ৮ কার্যদিবসেই পতনের ঘটনা ঘটে। এর আগে পুঁজিবাজার চাঙ্গা করতে গত ১৬ সেপ্টেম্বর বাজারের সকল অংশীজনদের সঙ্গে বৈঠক করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বাজার স্বাভাবিক করতে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু এরপরও বাজারে চাঙা হচ্ছে না।

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গত বৃহস্পতিবার ডিএসই’র প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স ১০ পয়েন্ট কমে চার হাজার ৭৭০ পয়েন্টে নেমে গেছে। অন্য দুই সূচকের মধ্যে ডিএসই শরিয়াহ্ ৫ পয়েন্ট কমে এক হাজার ৯৪ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। আর ডিএসই ৩০ সূচক ৬ পয়েন্ট কমে এক হাজার ৬৭৯ পয়েন্টে অবস্থান করছে। মূল্যসূচকের এই পতনের পাশাপাশি ডিএসইতে লেনদেনে অংশ নেওয়া প্রায় অর্ধেক প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের মূল্য কমেছে। ডিএসই’র লেনদেন গড়ে তিনশ’ কোটি টাকার ঘরে আটকে রয়েছে।