দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা : বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা স্বল্পমেয়াদি ইনস্ট্রুমেন্টেই বেশি বিনিয়োগ করে এবং এখানে এখনো সেভাবে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী গড়ে ওঠেনি বলে মনে করছে বিশ্বব্যাংক গ্রুপ। সংস্থাটির ‘বাংলাদেশ: সিজিং দ্য অপরচুনিটি’ শীর্ষক প্রকাশনায় পুঁজিবাজারের উন্নয়নে প্রধান চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায় সম্পর্কে তাদের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা হয়েছে।

বিশ্বব্যাংক বলছে, উচ্চপ্রবৃদ্ধি অর্জনে সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতেই বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। বাংলাদেশে সঞ্চয়ের হার ৩০ শতাংশ, যার অধিকাংশই ব্যক্তি খাতের। বিনিয়োগের এক-তৃতীয়াংশ মাত্র ব্যাংক ও পুঁজিবাজার থেকে আসছে। কারখানা স্থাপন, যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদিতে বিনিয়োগ এবং অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগের জন্য বেসরকারি খাতের অর্থায়ন কাঠামোকে আরো বিস্তৃত করতে হবে।

এছাড়া শুধু ব্যক্তি খাতের মাধ্যমে আবাসন কিংবা শিক্ষা অথবা তাদের সঞ্চয়ের বিপরীতে উচ্চহারে রিটার্ন পাওয়া সম্ভব নয়। মৌলিক প্রাতিষ্ঠানিক বাধা দূর করার জন্য নীতিগত সিদ্ধান্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি পুঁজিবাজার ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী গড়ে তোলার জন্য মধ্যমেয়াদি পদক্ষেপ এবং দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন নিশ্চিত করতে ত্বরিত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছে বিশ্বব্যাংক।

স্বল্পমেয়াদি আমানতের ওপর নির্ভরশীলতা দেশের ব্যাংকিং খাতের সক্ষমতাকে সীমিত করে দিয়েছে। দুর্বল রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক, খেলাপি ঋণ, করপোরেট সুশাসন নিশ্চিতে চ্যালেঞ্জ এবং তদারক ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নিয়ে শঙ্কা ব্যাংকিং খাতের বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে। এ ধরনের দুর্বলতার কারণে সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকট তৈরি হয়েছে এবং উচ্চ ঋণপ্রবৃদ্ধি বজায় রাখার ক্ষেত্রে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। সঞ্চয়পত্র ও বৈদেশিক মুদ্রার কারণে সংকট আরো ত্বরান্বিত হয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুঁজিবাজার উন্নয়নের ভিত্তি হচ্ছে একটি কার্যকর সরকারি ঋণ ব্যবস্থা। এটি অন্যান্য ইনস্ট্রুমেন্টের মূল্য নির্ধারণের মাপকাঠি হিসেবে কাজ করে। বাজারভিত্তিক সরকারি ইনস্ট্রুমেন্টের সংখ্যা অপর্যাপ্ত এবং সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে সরকারের বড় আকারের ঘাটতি মেটানো হয়ে থাকে। তাছাড়া করপোরেট বন্ড মার্কেটও সেভাবে গড়ে ওঠেনি। বর্তমানে একটি মাত্র করপোরেট বন্ড ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত রয়েছে।

পুঁজিবাজারে আর্থিক খাতবহির্ভূত ইস্যুর সংখ্যা সীমিত এবং ভালো কোম্পানিগুলো তাদের নিজেদের পুঞ্জীভূত অর্থ ও ব্যাংকের ওপর নির্ভর করছে। লেনদেন কাঠামো, কর অবকাশ, নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছ থেকে পর্যাপ্ত প্রণোদনার অভাব, পেশাগত সেবা যেমন নিরীক্ষা ও ঋণমাণের ওপর আস্থার ঘাটতি, ঋণপণ্যে বৈচিত্র্যের অভাব এবং পর্যাপ্ত প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী না থাকার বিষয়টি এখানে মুখ্য ভূমিকা রাখছে। যদিও ইকুইটি বাজার দ্রম্নত বাড়ছে, কিন্তু এখনো বাজার মূলধনের পরিমাণ জিডিপির ২০ শতাংশের নিচে অবস্থান করছে; যা ভারত, থাইল্যান্ড কিংবা ভিয়েতনামের চেয়ে কম।

সঞ্চয়পত্রের কারণে বিনিয়োগ ও সঞ্চয় বরাদ্দে প্রভাব পড়ছে এবং সরকারি বন্ডের ইল্ড কার্ভ মাপকাঠি না থাকাই পুঁজিবাজার উন্নয়নের প্রধান অন্তরায় বলে মনে করছে বিশ্বব্যাংক। দেশের বিমা খাতের মোট সম্পদের পরিমাণ জিডিপির ৩ শতাংশ। তাছাড়া বাংলাদেশের অন্যান্য প্রতিযোগীর তুলনায় এখানে এখনো সেভাবে পেনশন খাত গড়ে ওঠেনি।

মর্টগেজের বাজারও সেভাবে গড়ে ওঠেনি এবং এটি জিডিপির মাত্র ৩ শতাংশ। অবকাঠামো অর্থায়নের ক্ষেত্রে সরকারের অংশগ্রহণই বেশি। বর্তমানে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টশিপ (পিপিপি) কাঠামো গড়ে উঠছে এবং পাইপলাইনে রয়েছে ১৪ বিলিয়ন ডলারের প্রকল্প। অবকাঠামো বন্ড কিংবা সিকিউরাটাইজেশন এখন পর্যন্ত গড়ে ওঠেনি।

পুঁজিবাজারের চ্যালেঞ্জ থেকে উত্তরণে বিশ্বব্যাংক বেশকিছু স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি সুপারিশ করেছে। স্বল্পমেয়াদে যে বিষয়গুলো বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে সরকারি বন্ডের ইল্ড কার্ভ তৈরি, বন্ডের ক্ষেত্রে আইনি, নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও কর কাঠামোর বিষয়গুলো পর্যালোচনা করা, দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের জন্য প্রভিডেন্ট ফান্ড ও জীবন বীমা কোম্পানির আকার, সংখ্যা ও সম্পদ বরাদ্দের বিষয়টি নিশ্চিত করা এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) আর্থিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি এর অন্যতম।

মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে সক্ষম বিনিয়োগকারী ও ইস্যুয়ার গড়ে তোলা, নতুন প্রভিডেন্ট ফান্ড আইন প্রণয়ন, ফিক্সড ইনকাম মার্কেট ও বিমার বাজার গড়ে তোলা এবং পেনশন ব্যবস্থার সংস্কারসহ সম্পদভিত্তিক সিকিউরিটিজ ও ডেরিভেটিভসের মতো পণ্য যোগ করা অন্যতম।