দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সদস্যভুক্ত ব্রোকারেজ হাউজগুলো নানা অনিয়ম করলেও বিভিন্ন কারণে তাদের বিরুদ্ধে সঠিক ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয় না। তাই তাদের অনিয়ম রুখতে ভিন্ন কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে বিএসইসি। দেশের সিকিউরিটিজ আইনে পুঁজিবাজারে কাজের স্বচ্ছতা যাচাই ও কমপ্লায়েন্স পরিপালন বিষয়ে ব্রোকারেজ হাউজগুলোয় পরিদর্শনের বিধান রয়েছে। সে অনুযায়ী নিয়মিত ও বিশেষ পরিদর্শন কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে বিএসইসি।

এদিকে ব্রোকারেজ হাউজগুলোর প্রতিদিনকার সম্মিলিত লেনদেন বর্তমানের খরার বাজারেও ২৮০ থেকে ৩৫০ কোটি টাকার কম বেশি হচ্ছে। একসময় ছিল যখন পৃথকভাবে একেকটি হাউজেই লেনদেন ছাড়িয়ে যেত ১০০ কোটি টাকার ওপর। আর তখন অনেক ক্ষেত্রে হাউজে ট্রেডারদের ভুল কিংবা অনৈতিকতার কারণে লেনদেনে বড় ধরনের ঘাপলা হতো। কিছু অসৎ বিনিয়োগকারীর যোগসাজশে ট্রেডারগণ বিএসইসির বিধিবিধান লঙ্ঘন করে অনৈতিক লেনদেনে জড়িয়ে পড়ত, যার খেসারত দিতে হতো ব্রোকারেজ হাউজগুলোর মালিকদের।

এসব ঘটনায় অনেক বড় বড় হাউজকেও জরিমানা গুনতে হয়েছে। এর প্রতিবিধান করতে গিয়ে বিএসইসির উদ্যোগে ২০১০ সালের পর হাউজগুলোতে নিয়মিত পরিদর্শনে যেতো সংস্থাটির একটি বিশেষ টিম। এর ফলে হাউসগুলোর কমপ্লায়েন্স পরিপালনের অনেক ঘাটতি কেটে গিয়েছিল। কিন্তু গত দেড় বছর ধরে ওই টিমের কোনো পরিদর্শন না থাকায় হাউজগুলোতে আবারো নানা ধরনের অনিয়ম সংঘটিত হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থায় হাউজগুলোর মেম্বারগণ তাদের নিজেদের স্বচ্ছতার প্রশ্নেই ওই টিমের আবারো সক্রিয়তা প্রয়োজন বলে মনে করছেন। তবে তাদের অনুরোধ, পরিদর্শনের নামে যাতে বাজারে কোনো আতঙ্ক সৃষ্টি না হয় সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রেখে এ কাজটি করতে হবে।

এদিকে গত বছর জুনে সমাপ্ত ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) -এর ব্রোকারেজ হাউজগুলোর নিরীরিক্ষত আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় নানা অনিয়ম পরিলক্ষিত হয়েছে। এমতাবস্থায় অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ১৪টি ব্রোকারেজ হাউজ সরেজমিনে পরিদর্শনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএসইসি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ কথা জানা গেছে।

ডিএসই’র প্রতিবেদনে দেখা যায়, ১৯৩টি প্রতিষ্ঠান তাদের সমাপ্ত বছরের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এগুলোর মধ্যে নানা কারণে ৭টি প্রতিষ্ঠানের আর্থিক প্রতিবেদন বিএসইসি-তে জমা দেয়নি ডিএসই। অবশিষ্ট ১৮৬টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৭৯টি প্রতিষ্ঠানের আর্থিক বিবরণীর ওপর বিএসইসি’র এসআরআই বিভাগ তাদের পর্যবেক্ষণ দিয়েছে।

এসআরআই বিভাগের পর্যবেক্ষণে ওঠে এসেছে ১৮টি ট্রেকহোল্ডার তাদের সমন্বিত গ্রাহক হিসাবে পরিচালকদের প্রদানকৃত ঋণ, হাতে নগদ এবং জমির জন্য প্রদানকৃত অগ্রিমের টাকা ৪২ কোটি ৪১ লাখ সমন্বয় করেছে। এসব ট্রেকহোল্ডারগণ ডিএসই এর মার্জিন সমন্বয়ের জন্য সমন্বিত গ্রাহক হিসাবের টাকা ব্যবহার করেছে। ৩টি ট্রেকহোল্ডারের সমন্বিত গ্রাহক হিসাবে ঘাটতি রয়েছে। আবার ৩টি ট্রেকহোল্ডার তাদের পরিচালকদের ঋণ প্রদান করেছে।

জানা যায়, ১৬টি ট্রেকহোল্ডার কর্তৃক মার্জিন রুলস ১৯৯৯ এর রুল ৩ (১) এবং ৩ (২) লঙ্ঘন করেছে। ৫টি ট্রেকহোল্ডার কর্তৃক প্রোপার্টি সেক্টরে বিনিয়োগ করা হয়েছে। এর মধ্যে কিছু বিনিয়োগ অনেক আগের। তবে যে প্রোপার্টিতে বিনিয়োগ করা হয়েছে; তা এখনও নিবন্ধন করা হয়নি। ৫টি ট্রেকহোল্ডার তার সিস্টার কনসার্নকে ঋণ প্রদান করেছে। ২৭টি ট্রেকহোল্ডার তার আর্থিক বিবরণী প্রকাশে বিভিন্ন ধরনের ভুল করছে।
প্রতিবেদনে ওঠে এসেছে, ১৪টি ট্রেকহোল্ডারের পেয়েবল টু ক্লায়েন্টস, আইপিও পেয়েবল, ইনভেস্টমেন্ট ইন ডিলার অ্যাকাউন্টস, ক্রেডিট ফ্যাসেলিটিস টু কাস্টমার্সসহ নানা বিষয়ে সন্দেহজনক। তাই কমিশন প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে সরাসরি পরিদর্শন কার্যক্রম পরিচালনা করবে।

কোম্পানিগুলো হচ্ছে: রয়্যাল গ্রিন, সালতা ক্যাপিটাল, আইল্যান্ড সিকিউরিটিজ, ইউনিক শেয়ার ম্যানেজমেন্ট, সাদ সিকিউরিটিজ, জয়তুন সিকিউরিটিজ, সাবভ্যালি সিকিউরিটিজ, শাহ মোহাম্মদ সগির, অ্যাংকর সিকিউরিটিজ, ওয়াইফাং সিকিউরিটিজ, শার্প সিকিউরিটিজ, রাসতি সিকিউরিটিজ এবং স্টারলিং স্টক অ্যান্ড সিকিউরিটিজ লিমিটেড।

আর্থিক প্রতিবেদনে এ ধরণের ভুলের কারণে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানকে শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে। এর মধ্যে সিনহা সিকিউরিটজ, শাহ মোহাম্মদ সগির অ্যান্ড কোম্পানি এবং ওয়াইফাং সিকিউরিটিজকে সমন্বিত গ্রাহক হিসাবে ঘাটতি সমন্বয়ের জন্য ৪ মাস সময় দেয়া হয়েছে। আর প্রুডেন্টসিয়াল সিকিউরিটিজ, হ্যাক সিকিউরিটিজ এবং রাসতি সিকিউরিটিজ অ্যান্ড কনসালটেন্ট পরিচালকদের ঋণ প্রদান করেছে। এতে প্রতিষ্ঠানগুলো সিকিউরিটিজ আইন লঙ্ঘন করেছে। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণ সমন্বয়ের জন্য জন্য ৪ মাস সময় দেয়া হয়েছে।

এদিকে এরশাদ সিকিউরিটিজ, হাজী আহমেদ ব্রাদার্স, হ্যাক সিকিউরিটিজ, আল-হাজা জাহনারা, কিএইচবি সিকিউরিটিজ, সাবভ্যালি সিকিউরিটিজ, ওষধী সিকিউরিটিজ, শার্প সিকিউরিটিজ, মডার্ন সিকিউরিটিজ, মাল্টি সিকিউরিটিজ, এএনএফ ম্যানেজমেন্ট এবং এম সিকিউরিটিজ তাদের গ্রাহক হিসাব সমন্বয় করলেও ১ বছর পর্যবেক্ষণ করবে বিএসইসি।

আর আজম সিকিউরিটিজ, আল-মুন্তাহা ট্রেডিং, ই সিকিউরিটিজ, রয়্যাল গ্রিন, তমহা, আলী সিকিউরিটিজ, ইত্তিহাদ সিকিউরিটিজ, সাদ সিকিউরিটিজ, থিয়া সিকিউরিটিজ, আল-হাজা জাহনারা, জয়তুন সিকিউরিটিজ, ইনভেস্টমেন্ট প্রোমশন, শাহ মোহাম্মদ সগির, হযরত আমানত শাহ, শার্প সিকিউরিটিজ, মডার্ন সিকিউরিটিজ মার্জিন রুলস ১৯৯৯ এর রুল ৩ (১) এবং ৩ (২) লঙ্ঘন করেছে। এই ১৬টি প্রতিষ্ঠানকে আগামী ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯ এর মধ্যে লঙ্ঘনকৃত মার্জিন ঋণ যথাযথভাবে পরিপালন করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ৫টি ট্রেকহোল্ডারের প্রোপার্টিতে বিনিয়োগ এবং ৫টি ট্রেকহোল্ডার তার সিস্টার কনসার্নকে ঋণ প্রদান সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য বিএসইসিতে জমা প্রদান নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ ছিদ্দিকী দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণকে বলেন, ব্রোকারেজ হাউজগুলো নিয়মিত পরিদর্শন করা উচিত। কাজের স্বচ্ছতা যাচাই ও কমপ্লায়েন্স পরিপালনের বিষয় রয়েছে। আর বিএসইসিই’রও এ বিষয়ে দায়বদ্ধতা রয়েছে। এছাড়া বাজারে শেয়ারের দরে কেউ মেনুপুলেট করে কিনা তা তদারকি করা বিএসইসির দায়িত্ব।

বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মিজান উর-রশিদ চৌধুরী বলেন, শুধু বিশেষ পরিদর্শন ও অভিযোগের ভিত্তিতে পরিদর্শন না করে নিয়মিত পরিদর্শন করা উচিৎ। পরিদর্শন না হওয়ায় বিএসইসি অনিয়মে সহায়তা করছে বলে অভিযোগ করেন তিনি। তিনি বলেন, বিএসইসির তৎপরতা কম হলে বিনিয়োগকারীদের প্রতারণার শিকার হওয়ার আশংকা রয়েছে। এজন্য নীতি-নৈতিকতার সাথে বিনিয়োগকারীদের পক্ষে বিএসইসির কাজ করা উচিত।