দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে ব্যাংকের মাধ্যমে অর্থের প্রবাহ বাড়াতে নীতিমালা শিথিল করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। বলা হয়েছিল, টাকার সঙ্কটে পড়া ব্যাংকগুলো তাদের হাতে থাকা ট্রেজারি বিল ও বন্ড বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বন্ধক রেখে (রেপো) অর্থের সংস্থান করতে পারবে। ওই অর্থ দিয়ে ব্যাংকগুলোর নিজস্ব পোর্টফোলিওতে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে পারবে।

কিন্তু নীতিমালা শিথিলের এক মাস পার হলেও পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বাড়াতে ব্যাংকগুলোর কোনো সারা মিলছে না। গত এক মাসে মাত্র একটি ব্যাংক ৫০ কোটি টাকার সুবিধা নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে। তাই পড়ন্ত পুঁজিবাজার চাঙ্গা করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের এ উদ্যোগ তেমন কাজে আসছে না। বরং ব্যাংকগুলো পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ নিয়ে নয়ছয় করছে বলে অভিযোগ তোলেন বিনিয়োগকারীরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, গত এক বছরে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বাড়াতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বেশ কয়েকটি উদ্যোগ নিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এর অন্যতম উদ্যোগ ছিল ব্যাংকগুলোর হাতে থাকা ট্রেজারি বিল ও বন্ড বন্ধক রেখে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে অর্থের সংস্থান করা। বর্তমানে ব্যাংকগুলোর কাছে বিনিয়োগযোগ্য প্রায় ৯২ হাজার কোটি টাকা রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া সুযোগ অনুযায়ী এ খাত থেকে দেশের পুঁজিবাজারে ২৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে পারবে। কিন্তু মাত্র একটি ব্যাংক ৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগে যাচ্ছে। অথচ বর্তমানে ২৫ ব্যাংকের এই সুযোগ রয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ভরযোগ্য সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

টানা দরপতনে থাকা পুঁজিবাজারে অর্থের প্রবাহ বাড়াতে নীতিমালা শিথিল করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়, পৃথক বিও হিসাবের মাধ্যমে ব্যাংকগুলো মৌলভিত্তির কোম্পানিতে বিনিয়োগ বাড়াতে পারবে। এজন্য প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলো স্বল্প সুদে টাকাও ধার নিতে পারবে।

ব্যাংকগুলো ট্রেজারি বিল ও বন্ড বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বন্ধক রেখে (রেপো) অর্থের সংস্থান করতে পারবে। ওই অর্থ দিয়ে ব্যাংকগুলোর নিজস্ব পোর্টফোলিওতে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে পারবে। এর পূর্বে ব্যাংকের ঋণ আমানতের অনুপাত (্এডিআর) সাড়ে ৮৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৮৫ শতাংশ করা হয়। যাতে ব্যাংকের বিনিয়োগ সক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।

জানা গেছে, ব্যাংকগুলো নিজেদের মোট মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি বিনিয়োগ করতে পারে না। বর্তমানে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকের সংখ্যা ৩০। এর মধ্যে ২৩ ব্যাংকের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ ২৫ শতাংশের নিচে রয়েছে। তাদের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগসীমা ২৫ শতাংশে উন্নীত করার সুযোগ রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোতে মোট তারল্যের পরিমাণ হচ্ছে দুই লাখ ৪৬ হাজার ৭৯৪ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে সিআরআরসহ বিভিন্ন খাতে বাধ্যতামূলক কমপক্ষে তারল্য থাকতে হবে এক লাখ ৮৬ হাজার ২৪৫ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। এ হিসেবে ব্যাংক খাতে উদ্বৃত্ত তারল্যের পরিমাণ ৬০ হাজার ৫৪৯ কোটি টাকা।

সূত্রমতে, এ পরিমাণ উদ্বৃত্ত তারল্যের পুরোটা ব্যাংকের কাছে নেই। বিভিন্ন সময় এসএলআরসহ বিবিধ জমা, সরকারকে ঋণ দেওয়াসহ বিভিন্ন বন্ড ও বিলে বিনিয়োগ রয়েছে। এছাড়া মোট তরল সম্পদের মধ্যে বিদেশি মুদ্রাও রয়েছে, যা সহজে দেশীয় মুদ্রায় পরিবর্তন করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। বিদেশি মুদ্রায় রয়েছে ১০ হাজার ২৮২ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এসব ব্যাংকের কাছে ৯২ হাজার কোটি টাকার ট্রেজারি বিল ও বন্ড রয়েছে। এর বিপরীতে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা ধার নেওয়ার সক্ষমতা রয়েছে ব্যাংকগুলোর, যা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে পারত। কিন্তু নীতিমালা শিথিলের এক মাস পার হলেও পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বাড়াতে ব্যাংকগুলোর কোনো সাড়া মিলছে না। গত এক মাসে মাত্র একটি ব্যাংক ৫০ কোটি টাকার সুবিধা নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে।

পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে গত মাসের ২২ সেপ্টেম্বর এক সার্কুলার জারি করেছিল। ওই সার্কুলারে বিনিয়োগসীমা যাদের ২৫ শতাংশ নিচে রয়েছে, তাদের রেপোর মাধ্যমে (ট্রেজারি বিল ও বন্ড বন্ধক রেখে) বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে থেকে ধার নেওয়ার অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রথমে ২৮ দিনের জন্য, পরবর্তীকালে তা বাড়িয়ে ছয় মাস পর্যন্ত এ ধার নিতে পারবে।

পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংকের এ উদ্যোগ ব্যাংকগুলো সাড়া দেয়নি। বেসরকারি খাতের দি সিটি ব্যাংক তারা নিজস্ব পোর্টফোলিওর মাধ্যমে ৩০ কোটি টাকা এবং তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ২০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে রেপোর মাধ্যমে ধার নিয়েছে।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানান, ব্যাংকের কাজ হচ্ছে তুলনামূলক কম ঝুঁকি নিয়ে বিনিয়োগ করা। যতটা সম্ভব ঝুঁকির বিপরীতে সম্পদ রাখা। দেশের পুঁজিবাজারে ধারাবাহিক পতন হচ্ছে। গত বছরও কয়েকটি ব্যাংক সাত থেকে ১০ কোটি টাকা পর্যন্ত লোকসান গুনেছে। এ বছর মনে হয় লোকসানের পরিমাণ বাড়বে।

তিনি আরও বলেন, ট্রেজারি বিল ও বন্ড বন্ধ রেখে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ধার নিয়ে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু শেয়ারের দাম আরও কমে গেলে এর দায়দায়িত্ব কেউ নেবে না। এটি ব্যাংকগুলোকেই বহন করতে হবে। আর সাধারণ আমানতকারীদের অর্থ দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এ খাতে একজন সচেতন ব্যাংকার বিনিয়োগ করতে পারেন না।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ব্যাংকগুলোর ডিসেম্বর ক্লোজিংয়ের কাছেই চলে এসেছে। এ কারণে জেনেশুনে ব্যাংকগুলো এখনই এ ঝুঁকিপূর্ণ খাতে বিনিয়োগ করবে না। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সার্কুলার কার্যকর করার সময়সীমা বাড়ালে ডিসেম্বরের পর এ সুযোগ কেউ কেউ নিতে পারে।

অপরদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) এক পরিচালক জানিয়েছেন, বর্তমানে ডিএসইর মোট বাজার মূলধনের প্রায় ১৮ শতাংশই ব্যাংক খাতের। এ খাতের বিনিয়োগ বাড়লে ঘুরে দাঁড়াবে পুঁজিবাজার। আর পুঁজিবাজারে এখনই বিনিয়োগের সময়। ১০ ও ২০ টাকার শেয়ার যদি ১৫ শতাংশও ডিভিডেন্ড দেয়, তবুও লাভ হবে। এছাড়া এসব শেয়ারের দর বর্তমান মূল্যে থাকবে না। এক সময় অবশ্যই বাড়বে। বিনিয়োগকারীরা বর্তমানে একটু অনিশ্চয়তায় রয়েছেন। এটি কাটিয়ে উঠতে পারলেই সূচক ঘুরে দাঁড়াবে বলে মনে করেন তিনি।

পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, ব্যাংক পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে বাধ্য নয়। ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশকে (আইসিবি) অর্থের জোগান দিতে পারে সরকার। তাহলে পুঁজিবাজারে তারল্য প্রবাহ বৃদ্ধি পাবে। এতে বিনিয়োগকারীরা সরাসরি উপকৃত হতেন।