বিশেষ প্রতিনিধি, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: বন্ড বা ডিবেঞ্চার ইস্যু করে কোম্পানির জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছেন কিন্তু পাওনা পরিশোধ করেননি, এমন বন্ড খেলাপিদের জন্য দুঃসংবাদ আসছে। দেশে একটি কার্যকর বন্ড মার্কেট চালুর অংশ হিসেবে সরকার বন্ড বা ডিবেঞ্চার ইস্যুয়ারদের তালিকা তৈরি করতে যাচ্ছে, যাতে বন্ড খেলাপিদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এ তালিকাটি বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোতে সংযোগ দেওয়া হবে। এর ফলে বন্ড খেলাপিরা ব্যাংক ঋণ পাবে না।

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি) বন্ড ও ডিবেঞ্চার ইস্যুয়ারদের তালিকা তৈরি করবে। বিএসইসি সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। এছাড়া বন্ডের ঋণমান করার জন্য রেটিং এজেন্সির একটি তালিকাও করবে তারা। বন্ড ইস্যুর অনুমোদন দেয় বিএসইসি। এ কারণে সম্প্রতি দেশের দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন ও মূলধন বাজার উন্নয়নে গঠিত কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংক বন্ড বা ডিবেঞ্চার খেলাপিদের চিহ্নিত করার দায়িত্ব বিএসইসিকে দেওয়ার প্রস্তাব করেছে।

বন্ডের তালিকায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রবেশ এবং পর্যবেক্ষণ করতে পারবে। ফলে বন্ড ও ডিবেঞ্চার খেলাপিরা চাইলেও কোনো ব্যাংক ঋণ পাবে না। বর্তমানে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) মোট নয়টি করপোরেট বন্ড ও ডিবেঞ্চার তালিকাভুক্ত রয়েছে। এর মধ্যে আটটি ডিবেঞ্চার রয়েছে, যেগুলো দীর্ঘদিন ধরে কোনো লেনদেন হচ্ছে না।

নব্বইয়ের দশকে পুঁজিবাজারে ডিবেঞ্চার (ঋণ স্বীকারপত্র) ইস্যুর মাধ্যমে কোম্পানি আধুনিকায়ন ও ব্যবসা সম্প্রসারণ করেন দেশের আলোচিত দুটি ব্যবসায়ী গ্রুপ। তবে ঋণের অর্থে কোম্পানির উন্নয়ন হলেও দুই যুগেও ডিবেঞ্চারধারীদের পাওনা পরিশোধ করেনি তারা। পাওনা পরিশোধে আদালতের নির্দেশনাও মানেনি এসব প্রতিষ্ঠান। নির্ধারিত সময়ে ডিবেঞ্চারধারীদের পাওনা পরিশোধ না করায় অর্থ সংগ্রহের জনপ্রিয় এ মাধ্যমটি পরবর্তীকালে বন্ধ হয়ে যায়। ডিএসইতে আটটি ডিবেঞ্চার তালিকাভুক্ত থাকলেও এক যুগেরও বেশি সময়ে এগুলোর কোনোটিই লেনদেন হয়নি।

এদিকে ডিবেঞ্চারের অর্থ পরিশোধ না করলেও অর্থসংগ্রহকারী ব্যবসায়ী গ্রুপ দুটির ব্যাংকঋণের ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হয়নি। কারণ ডিবেঞ্চার বা বন্ড খেলাপি হলেও তা বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এমন পরিস্থিতিতে দেশে একটি কার্যকর বন্ড মার্কেট গড়ে তুলতে বন্ড ইস্যুয়ার তথা বন্ড খেলাপিদের তালিকা তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

চলতি বছর বন্ড মার্কেট উন্নয়নে গঠিত এক কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, বন্ড খেলাপিরা কোনো প্রশ্নের মুখোমখি না হয়ে ব্যাংকঋণ পাচ্ছে। এ কারণে কমিটি কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বিষয়টি সমাধান করার পরামর্শ দিয়েছিল। তবে কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে পাঠানো মতামতে বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার, ১৯৭২-এর অধ্যায় ৪-এর ধারা ৪২(সি) মোতাবেক ক্রেডিট ইনফরমেশনের সংজ্ঞানুযায়ী করপোরেট বন্ড এবং ডিবেঞ্চার বা অন্য কোনো বিনিয়োগের তথ্য সিআইবি ডেটাবেজে অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ নেই। এসইসি যেহেতু করপোরেট বন্ড ও ডিবেঞ্চার ইস্যুর অনুমোদন দিয়ে থাকে, তাই এসইসির তত্ত্বাবধানেই বন্ড ও ডিবেঞ্চারের তথ্যসংবলিত ডেটাবেজ তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে।

ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ডেটাবেজটিতে প্রবেশের সুযোগ পাবে। ফলে কোনো প্রতিষ্ঠান বন্ড বা ডিবেঞ্চার খেলাপি হলে তা চিহ্নিত করা যাবে। আর সে অনুযায়ী বন্ড এবং ডিবেঞ্চার খেলাপিরা নতুন করে যাতে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করতে না পারে সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।

বন্ড হচ্ছে এক ধরনের ঋণপত্র। বন্ড ছেড়ে ইস্যুয়ার প্রতিষ্ঠান ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে। স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত কোম্পানি, অতালিকাভুক্ত কোম্পানি, ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বিধিবদ্ধ যেকোনো কোম্পানি পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসইসির অনুমোদনক্রমে বাজারে বন্ড বা ঋণপত্র ছেড়ে অর্থ সংগ্রহ করে থাকে। বর্তমানে এসইসি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বন্ড অনুমোদনের পরে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি অনাপত্তি পত্র দেয়।

বন্ড সাধারণত দুই ধরনের হতে পারে, অবসায়নযোগ্য ও রূপান্তরিত। রিডিমেবল বা অবসায়নযোগ্য বন্ড মেয়াদ শেষে অবসায়ন হয়। আর কনভার্টবেল বা রূপান্তরিত বন্ড নির্দিষ্ট সময়ে শেয়ারে রূপান্তর হয়। বন্ডে সুদের হার নির্ধারিত থাকতে পারে আবার নাও থাকতে পারে। এছাড়া লভ্যাংশযুক্ত কুপন বিবেচনায় বন্ড দুই ধরনের হয়। এর মধ্যে কুপনযুক্ত বন্ডের ক্ষেত্রে বন্ডহোল্ডাররা নির্দিষ্ট সময় পরপর লভ্যাংশ পায়। আর জিরো কুপন বন্ডে কোনো লভ্যাংশ দেওয়া হয় না। এই বন্ড ডিসকাউন্ট রেটে বিক্রি হয় এবং মেয়াদ শেষে বন্ডহোল্ডার অভিহিত মূল্যে টাকা ফেরত পান।

শেয়ারের তুলনায় বন্ডে বিনিয়োগ ঝুঁকি তুলনামূলক কম থাকলেও দেশে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ নেই বললেই চলে। যদিও উন্নত বিশ্বে পুঁজিবাজারের পাশাপাশি রয়েছে বন্ড মার্কেটের শক্ত অবস্থান। বর্তমানে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ড ইস্যু করে মূলধন ঘাটতি পূরণ করছে। আর বন্ডের গ্রাহকও এসব প্রতিষ্ঠানই। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ নেই বললেই চলে। সম্প্রতি সরকারি মালিকানাধীন আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন বন্ড ইস্যু করে পুঁজিবাজার থেকে ১০০ কোটি টাকা সংগ্রহ করার উদ্যোগ নিলেও পর্যাপ্ত বিনিয়োগকারী না পাওয়ায় আইপিওটি ভেস্তে যাওয়ার উপক্রম হয়। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন সিকিউরিটিজ আইন থেকে কোম্পানিটিকে অব্যাহতি দিয়ে চাঁদা গ্রহণের সময় বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

গত রোববার আইএফসির এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ফিক্সড ইনকাম মার্কেট ছোট ও অনুন্নত রয়ে গেছে। ২০১৮ সাল পর্যন্ত দেশের বন্ড মার্কেটের মোট আকার হচ্ছে ১৬ বিলিয়ন ডলার, যা জিডিপির ৬ শতাংশ। বন্ডের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ক্রেডিট রেটিং। তবে দেশের রেটিং এজেন্সিগুলোর দেওয়া ঋণমান নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। ঋণমান সনদ নেওয়া কোম্পানিগুলোর সঙ্গে আপসের অভিযোগ রয়েছে রেটিং এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে। এমন পরিস্থিতিতে বন্ড মার্কেট উন্নয়নের স্বার্থে ও ঋণমান সনদের নির্ভরযোগ্যতা বাড়াতে রেটিং এজেন্সিগুলোর একটি তালিকা তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে এসইসির। এসব রেটিং এজেন্সির জন্য একটি গাইডলাইনও করে দেবে এসইসি। খাতটির উন্নয়নে বন্ড ও ডিবেঞ্চারে ব্যাংকের বিনিয়োগ কীভাবে পুঁজিবাজারের এক্সপোজার থেকে বাদ দেওয়া যায় সে বিষয়টিও বিবেচনা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।