দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারের আস্থা ফিরিয়ে আনতে ক্যাসিনোর মতো বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই), চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই), ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) এবং বিভিন্ন ইস্যু ম্যানেজারের বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করার দাবি জানিয়েছেন শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীরা। মঙ্গলবার জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদ’ এর ব্যানারে সংবাদ সম্মেলন করে এসব দাবি জানানো হয়। সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বিনিয়োগকারীদের পক্ষ থেকে মোট ২১টি দাবি জানানো হয়েছে।

‘দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোর মূলস্তম্ভ ব্যাংকিং তথা আর্থিক খাত এবং পুঁজিবাজার চরমভাবে হতাশার মধ্য দিয়ে চলছে’ মন্তব্য করে বাংলাদেশ বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদ সভাপতি মিজান-উর-রশীদ চৌধুরী বলেন, দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা এবং পুঁজিবাজারকে নাজুক অবস্থায় রেখে দেশকে আমরা কোন উন্নয়নের মহাসড়কে নিয়ে যাচ্ছি? কীভাবে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা সত্যিকার অর্থে বাস্তবায়ন হবে? জাতির কাছে আজ এটি এক বিরাট প্রশ্ন।

তিনি বলেন, পুঁজিবাজারে ২০১০ সালে ভয়াবহতম পতনের পর বাজারকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে বিএসইসিতে যাদের দায়িত্ব দেয়া হয়, তারা বাজার স্বাভাবিক করার পরিবর্তে উল্টো বাজারকে আরও বেশি অস্বাভাবিক করে তোলেন। স্মরণকালের মহাধসের পর পুঁজি ও জীবনরক্ষার জন্য দিশেহারা, পুঁজিহারা বিনিয়োগকারীরা লাগাতার আন্দোলন করে যাচ্ছিলেন। এরই মধ্যে পুঁজি হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে রনি জামান, রনি সাহা, লে. কর্নেল ডা. মাহবুবুর রহমান, মিল্লাত হোসেন, হাবিবুর রহমান, রতন চৌধুরী, লিয়াকত আলী যুবরাজ, দিলদার হোসেনসহ অসংখ্য নাম না জানা বিনিয়োগকারী আত্মহত্যা ও হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন।

তিনি আরও বলেন, পুঁজিবাজারে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা থেকে শুরু করে অধিকাংশ স্টক হস্তান্তরের প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা, ঢাকা-চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ, আইসিবি, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের বেশকিছু অসাধু কর্মকর্তার সীমাহীন দুর্নীতি ও লুটপাট পুঁজিবাজার ধসের মূল কারণ। এছাড়া সেকেন্ডারি মার্কেটের আদলে বা সমান্তরালে অনৈতিক প্লেসমেন্ট বাণিজ্য ও দুর্বল কোম্পানি আইপিও-তে তালিকাভুক্তির মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের সর্বস্বান্ত করা হয়েছে।

‘বর্তমান কমিশন ২০১১ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত মোট ৯০টি কোম্পানি অনুমোদন দিয়েছে। তাদের মধ্যে অধিকাংশ কোম্পানি ফেসভেলু ও ইস্যু মূল্যের নিচে অবস্থান করছে। সিএনএ টেক্সটাইল, ফ্যামিলি টেক্স, টুংহাই নিটিং, কাট্টলি টেক্সটাইল, অ্যাপোলো ইস্পাত, খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং, এমারেল্ড ওয়েলসহ অনেক কোম্পানির উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। এই কোম্পানিগুলো অনৈতিকভাবে তালিকাভুক্তির অনুমোদন দেয়া হয়েছিল’ বলেন মিজান।

তিনি বলেন, এই কোম্পানিগুলো তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে প্লেসমেন্টের অবৈধ বাণিজ্য, আইপিও বাণিজ্য, ঘুষ ও দুর্নীতি করে হাজার হাজার কোটি টাকা মানি লন্ডারিং করে বিদেশে পাচার করে দেশের পুঁজিবাজারের মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়া হয়েছে।

বিএসইসি পুনর্গঠনের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে সাধারণ জনগণের সত্যিকার অর্থনৈতিক মুক্তি আনার জন্য যেভাবে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন এরই অংশ হিসেবে আপনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে চলমান শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করছেন, সর্বমহলে তা প্রশংসনীয় হয়েছে। পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণ করতে আপনি যাদের দায়িত্ব দিয়েছেন সেই বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ একচেঞ্জ কমিশন বিভিন্ন অনিয়ম,

দুর্নীতি, ঘুষগ্রহণের বিনিময়ে অবৈধভাবে দুর্বল কোম্পানিগুলোকে আইপিও অনুমোদন, প্লেসমেন্ট বাণিজ্য ও রাইট শেয়ার অনুমোদনের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করে আপনার সরকারকে বিব্রত অবস্থায় ফেলেছে। আমরা সেই বিএসইসি চেয়ারম্যান খাইরুল হোসেন ও কমিশনার হেলাল উদ্দিন নিজামীসহ সকল কমিশনারের অপসারণ চাই এবং মেধাবী ও যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের দিয়ে কমিশন পুনর্গঠনের দাবি জানাচ্ছি।

বিনিয়োগকারীদের ২১ দাবি: ১. বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যান খায়রুল হোসেনসহ সকল কমিশনারকে অপসারণ করে সৎ, মেধাবী ও যোগ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে কমিশন পুনর্গঠন করতে হবে।

২. পুঁজিবাজারে আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য ক্যাসিনো মার্কেটের মতো বিএসইসি, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ, আইসিবি ও বিভিন্ন ইস্যু ম্যানেজারদের বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করতে হবে।

৩. বাইব্যাক আইন পাশ করতে হবে। বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে ইস্যু মূল্যের নিচে অবস্থান করা শেয়ারগুলো নিজ নিজ কোম্পানিকে ইস্যু মূল্যে শেয়ার বাইব্যাক করতে হবে।

৪. পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতার লক্ষ্যে আগামী তিন বছর সব ধরনের আইপিও, রাইট শেয়ার ইস্যু বন্ধ রাখতে হবে। প্লেসমেন্ট শেয়ারের অবৈধ বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে।

৫. বুকবিল্ডিং পদ্ধতি, ডাইরেক্ট লিস্টিং পদ্ধতি বাতিল করতে হবে।

৬. ২ সিসি আইনের বাস্তবায়ন করতে যে সকল কোম্পানির উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের ব্যক্তিগতভাবে ২%, সম্মিলিতভাবে ৩০% শেয়ার নেই, ওই সকল উদ্যোক্তা পরিচালক ও কোম্পানিকে শেয়ার ধারণ করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

৭. কোম্পানি আইনে কোথাও জেড ক্যাটাগরি এবং ওটিসি মার্কেটের কথা উল্লেখ নেই। তাই শেয়ারের কোনো বিভাজন করা যাবে না। ওটিসি মার্কেটে যে সকল কোম্পানি নিয়মিত এজিএম করে এবং ডিভিডেন্ট দেয় তাদের মূল মার্কেটে ফেরত আনতে হবে। যে সকল কোম্পানি এজিএম করে না, বন্ধ আছে, সেই সকল কোম্পানির সম্পদ বিক্রি করে বিনিয়োগকারীদের টাকা ফেরত দিতে হবে।

৮. কোম্পানির ব্যবসা ভালো থাকা সত্ত্বেও যে সকল কোম্পানি নো ডিভিডেন্ট ঘোষণা করে বাজারকে অস্থিতিশীল করে, সে সকল কোম্পানিকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।

৯. কোনো কোম্পানিকে দি লিস্টিং করা যাবে না। সম্প্রতি দি লিস্টিং হওয়া মডার্ন ডাইং ও রহিমা ফুড কোম্পানির শেয়ারহোল্ডারদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।

১০. কোনো কোম্পানির বোর্ড মিটিংয়ে ডিভিডেন্ট ঘোষণার সাতদিনের মধ্যেই এজিএম করতে হবে। দুই-আড়াই মাস পর নয়। পৃথিবীর কোনো দেশেই দুই-আড়াই মাস পর এজিএম করার নিয়ম নেই।

১১. পুঁজিবাজারের উন্নয়নের স্বার্থে বহুজাতিক লাভজনক কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করতে হবে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে ভারত এবং পাকিস্তানের ন্যায় বাধ্যতামূলকভাবে তাদের বিনিয়োগের ৪৯% পুঁজিবাজারে অংশগ্রহণ করতে হবে। কারণ বিদেশি কোম্পানিগুলো তাদের কোম্পানির কিছু সংখ্যক শেয়ার (২০-২৫%) পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করে ৩০০ থেকে ৪০০% ডিভিডেন্ট দিয়ে এদেশের অর্থ বিদেশি কোম্পানিগুলো লুণ্ঠন করে নিয়ে যাচ্ছে। এই লুণ্ঠন প্রক্রিয়া বন্ধ করতে হবে।

১২. পুঁজিবাজারের প্রাণ মিউচুয়াল ফান্ডগুলোকে বাজারে সক্রিয় করে তাদের সঞ্চিত অর্থের ৮০% পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে হবে।

১৩. যে সমস্ত কোম্পানি তাদের মূলধন সংগ্রহের জন্য পুঁজিবাজারে আসবে ওই সমস্ত কোম্পানিকে পেইডআপ ক্যাপিট্যালের ৪০% পর্যন্ত আইপিও অনুমোদন দেয়া যেতে পারে। তবে কোম্পানি প্লেসমেন্ট শেয়ারের টাকা কোনো প্রকারেই কোম্পানির পেইডআপ ক্যাপিটাল হিসেবে দেখাতে পারবে না এবং কোম্পানি পুঁজিবাজারে আসার একমাস পূর্বে কোম্পানির প্রসপেক্টস সমস্ত ব্রোকারেজ হাউজ ডিএসই, সিএসই-তে পাঠাতে হবে। সাংবাদিক এবং বিনিয়োগকারীদের চাহিবা মাত্র কোম্পানি প্রসপেক্টস দিতে বাধ্য থাকিবে।

১৪. পুঁজিবাজারে অর্থের জোগান বৃদ্ধির জন্য সহজশর্তে অর্থাৎ ৩% সুদে ১০ হাজার কোটি টাকার বিশেষ বরাদ্দ দিতে হবে। যা আইসিবি, বিভিন্ন মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকার হাউজের মাধ্যমে ৫% হারে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা লোন হিসেবে বিনিয়োগের সুযোগ পাবে।

১৫. খন্দকার ইব্রাহিম খালেদের তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী শেয়ারবাজার লুণ্ঠনকারীদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।

১৬. ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের বিপরীতে বাংলাদেশ স্টক এক্সচেঞ্জ নামে বিকল্প স্টক এক্সচেঞ্জ করতে হবে।

১৭. বিনিয়োগকারীদের “বিনিয়োগ নিরাপত্তা আইন” অতিদ্রুত প্রণয়ন করতে হবে এবং তা বাস্তবায়ন করতে হবে।

১৮. বাজারের ভয়াবহ পতনে ২০১০-২০১৯ সাল পর্যন্ত যে সকল বিনিয়োগকারী অসুস্থ হয়ে, হার্ট অ্যাটাক করে আত্মহুতি দিয়েছেন তাদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে এবং ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।

১৯. পুঁজিবাজারের এই ক্রান্তিকালে মার্জিন ঋণে জর্জরিত বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে এবং বাজারে আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য এই মুহূর্তে মার্জিন ঋণের আওতাভুক্তদের সুদ সম্পূর্ণ মওকুফ করতে হবে।

২০. ফোর্স সেল বন্ধ করতে হবে। ইতঃপূর্বে অর্থ মন্ত্রণালয় ও বিএসইসির নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত যে সমস্ত ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারী মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউজ কর্তৃক ফোর্স সেল ও ট্রিগার সেলের শিকার হয়েছেন সে সমস্ত বিনিয়োগকারীর কোডে বিক্রিকৃত মূল্যে শেয়ার ক্রয় করে দিতে হবে।

২১. পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব ৩৩ লাখ বিনিয়োগকারীর জীবন-মান রক্ষা ও পুঁজিবাজার রক্ষার যৌক্তিক আন্দোলন করতে গিয়ে “বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদ” এর নেতাকর্মী বিনিয়োগকারীদের ওপর গ্রেফতার, হামলা, মামলা, গোয়েন্দা নজরদারি এবং মুচলেকা নেয়াসহ সব রকমের হয়রানি বন্ধ করতে হবে। সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন- বাংলাদেশ বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক, সহ-সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান প্রমুখ।