দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘যারা দুর্নীতি করছে তাদেরই ধরা হচ্ছে। এখানে কোনো ক্রাইটেরিয়ায় ধরা হচ্ছে না। এখানে আইওয়াশের কিছু নেই। যে অপরাধী সে অপরাধীই। আমি আপন-পর দেখছি না।’ তিনি বলেন, ‘শুধু ক্যাসিনো নয়, ব্যাংক জালিয়াতি ও শেয়ারবাজারের হোতাদেরও ধরা হবে।’ গত মঙ্গলবার বিকালে গণভবনে ন্যাম শীর্ষ সম্মেলনের অভিজ্ঞতা জানাতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মঞ্চে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম ছিলেন।

বিএনপিকে ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘যারা আপাদমস্তক দুর্নীতিবাজ, যাদের বিরুদ্ধে খুন-দুর্নীতি-অগ্নিসন্ত্রাস-অর্থ পাচারের অভিযোগ রয়েছে, যে দলের শীর্ষ দুজনই দুর্নীতির দায়ে দি ত, তারা দুর্নীতিবিরোধী অভিযান নিয়ে কথা বলে কোন মুখে, কোন সাহসে! অপরাধী অপরাধীই। সবাইকে ধরা হবে। কখন কাকে ধরা হবে, তা সময়ই বলে দেবে। আর অপেক্ষা করুন, চলমান অভিযান আইওয়াশ কিনা তা দেখতে পারবেন।’ তিনি বলেন, ‘জীবনের ভয় বলে কোনো কথা আমার ডিকশনারিতে নেই। ভয় থাকলে এমন অভিযানে নামতাম না।’

বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানের নিষেধাজ্ঞা বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিসিবি বলেছে তারা সাকিবের পাশে থাকবে। এ বিষয়ে আমাদের আসলে বেশি কিছু করার নেই। তবে বিসিবি সব সময় সাকিবের সঙ্গে আছে এবং সবরকম সহযোগিতা দেবে। তবু আমরা এটুকু বলব যে, আমাদের দেশের একটা ছেলে, সারা বিশ্বে ক্রিকেটে তার একটা আলাদা অবস্থান আছে। ভুল সে করেছে এটা ঠিক।

সে এটা বুঝতেও পেরেছে। তার পরও আমরা, বিশেষ করে বিসিবি বলেছে তার পাশে থাকবে। তবে খুব বেশি কিছু যে করণীয় আছে তা কিন্তু নয়।’ সাকিব আল হাসানের মতো বিশ্বসেরা খেলোয়াড়দের ওপর জুয়াড়িদের নজর থাকার বিষয়টি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এ ধরনের ক্রিকেট খেলোয়াড়দের সঙ্গে যারা ক্রিকেট জুয়াড়ি থাকে তারা যোগাযোগটা করে। ওর (সাকিব) যা উচিত ছিল যখন ফিক্সিংয়ের যোগাযোগ করেছে, তখন ও এটাকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি। ফলে সে এ কথাটা আইসিসিকে জানায়নি।

নিয়মটা হচ্ছে সঙ্গে সঙ্গে আইসিসিকে জানানো। এখানে সে একটা ভুল করেছে।’ ক্রিকেটারদের হঠাৎ করে আন্দোলন প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, ‘ক্রিকেটারদের কোনো দাবি-দাওয়া থাকলে তা বিসিবিকে জানাতে পারত। কথাবার্তা নেই, হঠাৎ করে ধর্মঘট ডাকা জীবনে শুনিনি। ক্রিকেটাররা এভাবে ধর্মঘট ডাকে তা-ও শুনিনি। তবে সেটা এখন মিটমাট হয়ে গেছে। কেননা, আমরা যেভাবে আমাদের ক্রিকেটারদের সমর্থন দিই, পৃথিবীর খুব কম দেশই আছে এমন সমর্থন দেয়। আমাদের ক্রিকেটাররা খেলছেও ভালো।’

মূল দুর্নীতিবাজরা শাস্তি পেয়েছে : শেখ হাসিনা বলেন, ‘মূল যারা দুর্নীতিবাজ তারা তো আগেই শাস্তি পেয়ে গেছে। খালেদা জিয়া পেয়েছেন। তারেক রহমানেরও সাজা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘দেশকে দুর্নীতিবাজ বানানো তো বিএনপিই করেছে। মানি লন্ডারিং, ঋণখেলাপি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অস্ত্রের ঝনঝনানি তো জিয়াউর রহমানই শুরু করেছে। তারপর যে আসছেন এরশাদ, আরও একধাপ এগিয়ে নিলেন। পরে খালেদা জিয়া এসে তো আরও শুরু করলেন। একদিকে হাওয়া ভবন অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ঘুষের লেনদেন।’

নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুললে তিনিও বিতর্কিত হবেন : ‘গত নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে পারেনি’ ১৪ দলের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা রাশেদ খান মেননের এমন বক্তব্যের সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তিনি ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন না, কারণ তিনি নিজেও ওই ভোটে বিজয়ী হয়েছেন।’

তবে মেনন এ ব্যাপারে দুঃখ প্রকাশ করায় এখন আর কোনো বক্তব্য থাকতে পারে না বলে জানান ১৪-দলীয় জোটের প্রধান শেখ হাসিনা। মেননকে উদ্দেশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের এক নেতা হয়তো একটা কথা বলেছেন। তার মনে হয়তো একটা ক্ষোভ, দুঃখ থাকতে পারে। তিনি জেনে হোক বা না জেনেই হোক তাকে একটা ক্লাবের চেয়ারম্যান করা হয়েছে।

সেটা নিয়ে অনেক কথা আসছে। কিন্তু তিনি হয়তো চলে গেছেন, এই নির্বাচনে তিনিও নির্বাচিত হয়ে এসেছেন। নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুললে তিনিও বিতর্কিত হয়ে পড়েন।’ মেনন প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘ছাত্র আন্দোলন থেকে তিনি (রাশেদ খান মেনন) এমন আচরণ করছেন।

স্বাধীনতার আগে বলেছেন, “ভোটের বাক্সে লাথি মারো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো”, পরে ইন্দিরা-মুজিব আমলে স্থলসীমানা চুক্তির সময় বলেছেন, “বেরুবাড়ী বেচে দিল”। এমন কথা তিনি অনেক বলেছেন।’ মেনন প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘কিছু কিছু রাজনীতিবিদ আছেন তারা কথা বলেন। এটা তো আপনাদের জন্য ভালো। কারণ লেখার খোরাক পান। তবে এখন তিনি দুঃখ প্রকাশ করেছেন।’

ভয় শব্দ আমার ডিকশনারিতে নেই : এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি ছোটবেলা থেকে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। রাজনৈতিক পরিবারে আমার জন্ম। আমার বাবাকে (জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু) দেখেছি কীভাবে সাহসের সঙ্গে বাংলাদেশকে স্বাধীন করে গেছেন। কাজেই ভয় শব্দটা আমার ডিকশনারিতে নেই। ভয় পাওয়ার লোক আমি না।

ভয় পেলে এ অভিযানে আমি নামতাম না। আর আমি যখন নেমেছি, তখন সে কী করে, কোন দলের তা আমার কাছে বিবেচ্য নয়।’ শেখ হাসিনা অভিযোগ করে বলেন, ‘বিএনপি আমেরিকায় এফবিআইর অফিসারকে কিনে ফেলল। তাদের টাকার এত জোর! জয়কে অপহরণের চেষ্টা করল। কিন্তু এটা ধরা পড়ে গেছে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, জয়কে কিডন্যাপ করে হত্যা করবে। এটা কিন্তু আমরা নই, তারাই বের করেছে।’

পিয়াজ প্রসঙ্গ : পিয়াজের দাম সহনীয় করা সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘পিয়াজ নিয়ে এত অস্থির হওয়ার কিছু নেই। কারণ পিয়াজ ছাড়াও রান্না করা যায়।’ তিনি বলেন, ‘ইতিমধ্যে ৫০ লাখ মেট্রিক টন পিয়াজ এসেছে। এটা সাময়িক সমস্যা। এ সমস্যা থাকবে না।’ পিয়াজ যারা মজুদ করে রেখেছেন তাদের উদ্দেশে শেখ হাসিনা বলেন, ‘যারা মজুদ করে রাখছেন তারা কত দিন রাখতে পারবেন কে জানে। কারণ পিয়াজ কিন্তু পচে যায়। সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে গিয়ে তাদের কিন্তু লোকসান হতে পারে।’

পদ্মা সেতু উদ্বোধনের সময় নির্ধারণ হয়নি : মুজিববর্ষে পদ্মা সেতু উদ্বোধন করা যাবে কিনাÑ এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘পদ্মা সেতু উদ্বোধনের কোনো সুনির্দিষ্ট সময় বলা যাবে না। পদ্মা সেতুর পুরো প্রক্রিয়াটাই হাইলি টেকনিক্যাল বিষয়। সেতুর নিচের অংশে ট্রেন, ওপরের অংশে গাড়ি চলবে। এটার টেকনোলজিটাই ভিন্ন। এ ছাড়া নদীর চরিত্রও একটা বড় ব্যাপার।’

বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দেশে ফেরাতে আলোচনা চলছে : মুজিববর্ষের মধ্যেই বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনিদের দেশে ফিরিয়ে বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব কিনাÑ এমন এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমেরিকার সঙ্গে আলোচনা চলছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে চিঠিও দিয়েছিলাম। নূর আছে কানাডায়, তার ব্যাপারেও কানাডা সরকারের সঙ্গে কথা চলছে। ট্রুডোর (কানাডার প্রধানমন্ত্রী) সঙ্গেও কথা হয়েছে।

ক্যাসিনোর খবর গণমাধ্যমে আগে আসেনি কেন? : সংবাদমাধ্যমের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের সামনে রেখে ক্যাসিনোর খবর আগে না আসা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আপনারা এত খবর রাখেন, এ রকম আধুনিক সব যন্ত্রপাতি এসে গেছে, এত কিছু হলো, আপনারা কেউ খবর রাখলেন না? কেউ খবর পেলেন না? কোনো দিন কেউ তো নিউজ করলেন না। কীভাবে হয়? ক্রিকেটারদের আন্দোলন নিয়ে প্রশ্ন করতে গিয়ে বিসিবি পরিচালক লোকমানের প্রসঙ্গ টেনে একজন সাংবাদিক বলেন, বোর্ডে একজন ‘ক্যাসিনোবাজ’ ঢুকে পড়েছেন, এখনো বহাল তবিয়তে আছেন।

বোর্ড ‘প্রপারলি ফাংশন’ করছে কিনা সেই প্রশ্ন উঠেছে। উত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ক্রিকেটারদের আন্দোলনের সঙ্গে ক্যাসিনো টেনে আনা ঠিক হচ্ছে না। এই ক্যাসিনো খেলার সঙ্গে কে কে জড়িত তা তো ক্রিকেট বোর্ডের বিষয় নয়। হয়তো এখানে একজন ছিল। সে রকম তো আপনাদের সাংবাদিক মহলেও যদি খোঁজ করা যায়, অনেককে খুঁজে পাওয়া যেতে পারে।

ভবিষ্যতে যদি খুঁজে পাওয়া যায় তো কী করব আমি? সেটাও তো আপনাদের ভাবতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘ক্যাসিনোকাে র সেই পরিচালক ধরা পড়েছে। সে বহাল তবিয়তে আছে, তাও নয়। তাকে তো ধরা হয়েছে। এটা কিন্তু আপনারা কেউ কখনো নিউজ করেননি। কোনো সাংবাদিক, কোনো সংবাদপত্রে কিন্তু একটা নিউজও আসেনি যে বাংলাদেশে এ রকম ক্যাসিনো খেলা হয়।’ এ সময় সাংবাদিকরা কিছু বলার চেষ্টা করলে তাদের থামিয়ে দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘নো, নো, কোথাও আমি নিউজ পাইনি, এটা বলে লাভ নেই। ক্যাসিনো সম্পর্কে কেউ কোনো নিউজ দেননি।

এটা ধরার দায়িত্ব আমি নিয়েছিলাম। আমি খুঁজে পেয়েছিলাম, আমিই করিয়েছি, এতে কোনো সন্দেহ নেই।’ সংবাদমাধ্যম কেন সেই খবর আগে দিল না আবারও সেই প্রশ্ন রেখে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এ রকম একটা বিষয় বাংলাদেশে ঘটে যাচ্ছে নীরবে, বাংলাদেশে সব থেকে বেশি সংবাদপত্র, কয়েক হাজার সংবাদপত্র, বেসরকারি চ্যানেল বাংলাদেশে আগে তো একটাই ছিল। আমিই তো সব ওপেন করে দিলাম। ৪৪টি চ্যানেলকে আমরা পারমিশন দিয়েছি, তার মধ্যে ৩২টির মতো চালু।

কোনো একটা চ্যানেল থেকে কোনো দিন এই নিউজটা কেন দিতে পারলেন না, এই জবাবটা কি জাতির কাছে দিতে পারবেন? পারবেন না। তাহলে আপনারা কাকে দোষ দেবেন?’ উপস্থিত সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘ধরব আমরা, আর এ ব্যাপারে আমাদেরই প্রশ্ন করবেন, তা তো হয় না। এখন আরেকটু সাহায্য করেন, খুঁজে বের করেন কোথায় কী পাওয়া যায়।’ ক্রিকেটকে নদীতে নিয়ে যাচ্ছেন কেন : বাংলাদেশ-ভারত টেস্ট ম্যাচ দেখতে ভারত যাবেন প্রধানমন্ত্রী।

সেখানে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে তিস্তা নিয়ে কোনো আলাপ হতে পারে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ক্রিকেটকে নদীতে নিয়ে যাচ্ছেন কেন? এটা প্রধানমন্ত্রীরও না, মুখ্যমন্ত্রীর দাওয়াতও না। একজন বাঙালি ছেলে সৌরভ গাঙ্গুলী দাওয়াত দিয়েছে। আমি রাজি হয়েছি। ওখানে আমি ক্রিকেট খেলা দেখতে যাব, সেখানে তিস্তা নিয়ে কেন তিক্ততা তৈরি করব?’