দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা : বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট ফার্ম তাদের ব্যবস্থাপনায় থাকা তহবিলের ৩৫ শতাংশই অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ খাতে লগ্নি করেছে, যা ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে বিশ্বাসভঙ্গের শামিল বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। ঝুঁকিপূর্ণ খাতে বিনিয়োগ করা এই অর্থের পরিমাণ এক হাজার কোটি টাকার বেশি। এর পুরোটাই বিনিয়োগ করা হয়েছে নন লিস্টেড কোম্পানিতে, যেখান থেকে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের অর্থ ফেরত পাওয়া নিয়ে রয়েছে অনিশ্চয়তা।

ব্যবস্থাপনায় থাকা সম্পদের পরিমাণের দিক দিয়ে রেইস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টই দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ ব্যবস্থাপনা ফার্ম। ঢাকার পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ৩৭টি মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মধ্যে ১০টির সম্পদ ব্যবস্থাপনায় আছে রেইস। এই দশ ফান্ডের মিলিত সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৩০০০ কোটি টাকা, যার মালিক ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা।

ডুবতে বসা ফারমার্স ব্যাংকে ৭০ কোটি ২৫ হাজার টাকা বিনিয়োগের পাশাপাশি রেইস একটি স্টক ব্রোকারেজ কোম্পানি ও বিভিন্ন সিকিউরিটিজে বড় অংকের অর্থ খাটিয়েছে, যার পরিমাণ অন্তত ৮৭ কোটি টাকা। কেবল প্রিমিয়ার ব্যাংকের অনিবন্ধিত সিকিউরিটিজেই রেইস ৪৮৬ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। একটি নিবন্ধিত কোম্পানির অনিবন্ধিত সিকিউরিটিজ থাকতে পারে, যেমন থাকে বন্ড। এ ধরনের সিকিউরিটিজের শেয়ার পুঁজিবাজারে লেনদেন হয় না।

একজন বাজার বিশ্লেষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘রেইস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট পরিচালিত কোনো কোনো মিউচ্যুয়াল ফান্ডের দাম যে ১০ টাকা অভিহিত মূল্য থেকে কমতে কমতে ৩ টাকার নিচে নেমে এসেছে, তার অন্যতম কারণ এই ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ।

“এখন প্রশ্ন হল, এসব বিনিয়োগ বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) অনুমোদন পেল কীভাবে? ওই সিদ্ধান্ত পর্যালোচনার কোনো উদ্যোগ কি বিএসইসি নিয়েছে?’ রেইসের ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগের তালিকায় বেস্ট হোল্ডিংয়ের কনভার্টিবল বন্ডও (বিএফআইএসপিভি) রয়েছে। এই নন লিস্টেড বন্ডে রেইস লগ্নি করেছে ২৫০ কোটি টাকা।

আরেকজন বিশ্লেষক বলেন, ‘রেইসের মাধ্যমে যারা টাকা লগ্নি করেছেন, এই বিনিয়োগগুলোর ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা নিয়ে তারা প্রশ্ন করতেই পারেন। এসব ফান্ডের যে নেট সম্পদ মূল্য দেখানো হয়, তা সঠিক কিনা তা বোঝার জন্যও বিনিয়োগকারীদের পর্যাপ্ত তথ্য দেওয়া উচিৎ।’

‘প্রতিহিংসার’ শিকার হওয়ার শঙ্কায় এই বাজার বিশ্লেষকও নিজের নাম প্রকাশ না করতে অনুরোধ করেছেন। তিনি বলেন, “এগুলো সরকারি ফান্ড নয়। যে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা এসব ফান্ডের শেয়ার মালিক, তারা এইটুকু অধিকার রাখে যে, তাদের লগ্নি করা টাকা খাটানোর সময় স্বচ্ছতা রক্ষা করা হবে; যে টাকা তারা বিনিয়োগ করেছেন, তার অপব্যবহার যেন না হয়, ফান্ড ম্যানেজার তা নিশ্চিত করবে।’

এই বাজার বিশ্লেষকের দৃষ্টিতে রেইসের বিনিয়োগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ সম্ভবত ফারমার্স ব্যাংকে তাদের বিনিয়োগ, যে ব্যাংকের নাম বদলে পদ্মা ব্যাংক হয়েছে। “লগ্নি করা টাকার অংকটা শুধু দেখুন; বাজারে এত ব্যাংক থাকার পরও তারা এরকম নতুন একটা ব্যাংকে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মিউচুয়াল ফান্ড যে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের প্রতিনিধিত্ব করে, সেটা ভুলে যাওয়াটা কারো উচিৎ নয়।’

রেইস অ্যাসেট ম্যানেজেমেন্ট কোম্পানি যাত্রা শুরু করে ২০০৮ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর। রেইস গ্রুপের চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সারাফাত পদ্মা ব্যাংকেরও (সাবেক ফারমার্স ব্যাংক) চেয়ারম্যান। ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগের বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, “আমি রেইসের বিষয়গুলো দেখি না। আমার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে কথা বলেন।’

আর বিএসইসির মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সাইফুর রহমান বলেন, “এ বিষয়ে আমি বিস্তারিত জানি না। সংশ্লিষ্ট ডিপার্টমেন্ট থেকে আগে আমার জেনে নিতে হবে।’ বিএসইসির এমন ভূমিকার সমালোচনা করে দ্বিতীয় বাজার বিশ্লেষক বলেন, “এটা আরও খারাপ বিষয় যে বিএসইসি কার্যত ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগকে উৎসাহিত করছে। এত টাকা বিনিয়োগ করার পরও ওই ব্যাংক এখনও সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি।’

দুইজন বিশ্লেষকই বলেছেন, বিএসইসির একটি অংশ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষার ক্ষেত্রে তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছে না।
রেইসের ১০ ফান্ডের দরই অভিহিত মূল্যের অর্ধেকের নিচে নেমে যাওয়ার দিকে ইংগিত করে অন্য একজন বিশ্লেষক বলেছেন, দেশে এটাই সম্ভবত ‘সবচেয়ে মিসম্যানেজেড’ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট ফান্ড।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, “বাংলাদেশের মিউচ্যুয়াল ফান্ডের এই খারাপ অবস্থার জন্য সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানগুলোর অপব্যবস্থাপনা দায়ী। তারা বিনিয়োগকারীদের কথা না ভেবে উল্টা-পাল্টা বিনিয়োগ করেছে। আর যারা এ ধরনের বিনিয়োগ করেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।’