দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা : আর্থিক অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার আখড়ায় পরিণত হয়েছে বেসরকারি খাতের সিটি ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিদের্শনাকে উপেক্ষা করে কর্মকর্তাদের দ্রুত পদোন্নতি ও অতিরিক্ত আর্থিক সুবিধা, নিয়োগের নামে অনিয়ম ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তি প্রদানসহ নানা অব্যবস্থাপনা চলছে ব্যাংকটিতে।

সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক তদন্ত প্রতিবেদনে ব্যাংকটির বিরুদ্ধে এসব তথ্য পাওয়া যায়। সে সঙ্গে এসব অভিযোগের বিরুদ্ধে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের কাছে যথাযথ ব্যাখ্যা প্রদান করতে বলা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৭ সালের ৬ জুলাই বিভিন্ন প্রক্রিয়া সম্পাদনের পর ব্যাংক কর্তৃক নির্বাচিত ১৬ জনের মধ্যে ১৩ জন নিয়োগের ক্ষেত্রে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছে ব্যাংকটি।

নামকরা প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব না দিয়ে শুধুমাত্র ব্যয় হ্রাসের অজুহাত দিয়ে আইবিএর একজন শিক্ষকের মাধ্যমে সব প্রক্রিয়া সম্পাদন করে নিয়োগের জন্য চূড়ান্তভাবে প্রার্থী নির্বাচন করা হয়েছে। কোনো অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কিংবা স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানকে এই কাজে নিয়োজিত না করে একজন ব্যক্তির ওপর নির্ভর করা যুক্তিযুক্ত হয়নি বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

৩১ জন প্রার্থীকে নির্বাচনের বিপরীতে ব্যাংক কর্তৃক ৪ হাজার প্রার্থীর পেছনে ১১ লাখ ৩৭ হাজার টাকা ব্যয় করা হয়েছে। এ ছাড়াও ১৬ জন নির্বাচিত কর্মকর্তার পেছনে জনপ্রতি ব্যাংকের ৭১ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। যা ব্যয় হ্রাসের জন্য আইবিএর একজন শিক্ষককে কার্যপত্র প্রদানের বিষয়টি পরিদর্শন দলের কাছে ভিত্তিহীন মর্মে প্রতীয়মান হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, সর্বশেষ ভাইবা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের ফলাফল পর্যালোচনায় দেখা যায় প্রাথমিক অ্যাসেসমেন্ট টেস্টে লিখিত পরীক্ষার মেধাতালিকায় ১-২০তম মেধাক্রমে মাত্র ছয়জন উত্তীর্ণ হয়েছে যা অনভিপ্রেত এবং অ্যাসেসমেন্টের প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

এ ছাড়াও বেনিফিশয়ারি কর্তৃক কর প্রদানের পরিবর্তে ব্যাংক কর্তৃক ৭৫ হাজার টাকা কর প্রদান করা হয়েছে যা বিধিবহির্ভূত। এসব বিষয়ে ব্যাংকটিকে প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা প্রদান করতে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলে তিনি দেশের বাইরে অবস্থান করায় তার বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।

তবে ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহবুবুর রহমান এ বিষয়ে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা ফলো করেই আমরা এসব করেছি, তবে তদন্তে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে এসব বিষয়ে অনিয়ম বা দুর্নীতিমূলক কোনো কিছু হয়েছে তা বলা হয়নি। যেসব বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়েছে আমরা তা দিয়েছি। ব্যাংকে নিয়োগে অনিয়মের বিষয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মানুযায়ী আমরা ব্যাংক নিয়োগ প্রক্রিয়ার কাজ করেছি। সে সময় আমরা আইবিএকে দায়িত্ব দিয়েছি সুতরাং এখানে অনিয়মের কিছু দেখছি না।

আইনজীবী নিয়োগ ও মামলার ব্যয় সংক্রান্ত পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, ২০১৭ সালে ১ বছর পর্যন্ত মোট মামলাধীন ঋণের বিপরীতে আইনগত ব্যয় ৫ কোটি টাকা যা বিগত বছরে ছিল ৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা। মামলাধীন ঋণের বিপরীতে আইনগত ব্যয় ১ কোটি ৪২ লাখ টাকা বা ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে কিন্তু আদায় অগ্রগতি যৎসামান্য। পরিদর্শনকালে ২০১৭ সালে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মামলা বাবদ প্যানেল আইনজীবীগণকে ১৩৯টি মামলা পরিচালনার জন্য সর্বমোট ১ কোটি ৮২ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। অথচ পরবর্তী বছরে ২০১৮ সালের ১৮৮টি মামলার বিপরীতে ৫২ লাখ ৬২ হাজার টাকা ব্যয় করা হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, আদালত ভেদে এবং মামলায় বিজড়িত অর্থভেদে সর্বোচ্চ ৬০ হাজার টাকা পর্যন্ত প্রদান করা যায় যা বেশ কয়েক ধাপে ছাড়করণযোগ্য। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, আইনজীবীকে দায়িত্ব পালনের বিপরীতে অর্থ প্রদানের ক্ষেত্রে ব্যাংকের পরিষদ অনুমোদিত পলিসি লঙ্ঘন করে যথেচ্ছভাবে (এমনকি একবারে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা পর্যন্ত) অর্থ প্রদান করা হয়েছে যা গ্রহণযোগ্য নয়।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, শাখাওয়াত হোসেন এবং মোহাম্মদ শফিউল্যাহ-এই দুই আইনজীবী কেই বারবার দায়িত্ব প্রদান করা হচ্ছে যার কোনো যৌক্তিকতা প্রতীয়মান হয়নি এবং বিভিন্ন গ্রাহকের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলার পেছনে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হয়েছে অথচ আদায় অগ্রগতি নেই বললেই চলে। এ ছাড়া বিভিন্ন ভাউচার পরীক্ষণে দেখা যায়, এ ধরনের অর্থ প্রদানের ক্ষেত্রে ভ্যাট এবং ট্যাক্স ব্যাংক পরিশোধ করেছে যা বিধিবহির্ভূত।

মামলা ব্যয়ে অধিক টাকা খরচের বিষয়ে মাহবুবুর রহমান বলেন, শুধু খরচের ফিগার দেখলে তো অনেক টাকা খরচ বলাই যাবে। তবে দশ বছরে যেসব মামলা নিষ্পত্তি হয়নি আমরা তা এক বছরেও মামলা নিষ্পত্তিতে বেশি টাকা আদায় করেছি। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে মনে হয়েছে যে আমরা মামলা পরিচালনায় বেশি টাকা খরচ করেছি। পরবর্তী সময়ে এ বিষয়ে আমরাও তদন্ত করে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে কেন বেশি টাকা খরচ করেছি তা বোঝাতে সক্ষম হয়েছি।

ব্যাংকের কর্মকর্তাদের চাকরি থেকে অপসারণ সংক্রান্ত পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, ব্যাংকের এইচআর পলিসি অনুযায়ী কোনো কর্মকর্তা যদি ‘ডাবল এনআই’ অথবা অপ্রত্যাশিত রেটিং প্রাপ্ত হন তবে সেই কর্মকর্তাকে পদ।