দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা : প্রায় এক যুগ ধরে নির্মাণের পর রাজধানীর নিকুঞ্জে অবস্থিত ভবনে যাচ্ছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) কর্তৃপক্ষ। মতিঝিলের অফিস ছেড়ে নিকুঞ্জের চার বিঘা জায়গায় নির্মিত ভবনে গতকাল ডিএসই তাদের কার্যক্রম শুরু করছে। যদিও এখনো অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জার কাজ পুরোপুরি শেষ না হওয়ায় ডিএসইর সব বিভাগ এখনই তাদের কার্যক্রম শুরু করতে পারছে না। তবে অস্বাভাবিক নির্মাণ ব্যয়, পরিচালন খরচ ও অবচয়ের কারণে ডিএসইর নতুন ভবন বোঝা হয়ে দাঁড়াবে বলে জানা গেছে।

১৯৯৬ সালে নিজস্ব ভবন তৈরিতে নিকুঞ্জে সরকারি চার বিঘা জমি বরাদ্দ পায় ডিএসই। ২০০৭ সালে ‘ডিএসই টাওয়ার’ নামে ভবন নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করেন তত্ত¡াবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দিন আহমেদ। প্রায় ১২ বছরেরও বেশি সময় লাগল ছয় লাখ বর্গফুটের বেশি আয়তনের এই ভবন নির্মাণে। এতে প্রায় হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেছে ডিএসই। যদিও ভবনটি নির্মাণের শুরুতে এর ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছিল ৮০ কোটি টাকা। এরপর ধাপে ধাপে ব্যয় বেড়ে বর্তমানে তা প্রায় হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে।

ভবনটির রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় ও অবচয় চার্জ শুরু হলে ডিএসইর নিট মুনাফায় ধস নামতে পারে। নিকুঞ্জের এই ডিএসই টাওয়ারে ভবন, যন্ত্রপাতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বছরে অন্তত ২০ কোটি টাকা অবচয় বাদ রাখতে হবে ডিএসইকে। আর এই অত্যাধুনিক ভবনে ডিএসই কর্তৃপক্ষ অফিস শুরুর পর প্রতি বছর ডিএসইর পরিচালন ব্যয় অন্তত ৫০ থেকে ৬০ কোটি টাকা বাড়বে বলে জানা গেছে। এতে করে অবচয় ও পরিচালন ব্যয়সহ বছরে অতিরিক্ত ৭০ থেকে ৮০ কোটি টাকা ব্যয় বাড়বে ডিএসইর। ২০১৭-১৮ হিসাব বছরে ডিএসইর নিট মুনাফা হয় ১০৪ কোটি টাকা। পরের বছর তা আরও কমবে বলে জানা গেছে।

কারণ, বাজার পরিস্থিতি মন্দার কারণে ২০১৮-১৯ হিসাব বছরে লেনদেন থেকে ডিএসইর আয় কমেছে। ডিএসইর আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস সুদ আয়ও কমে যেতে পারে বলে জানা গেছে। বিভিন্ন ব্যাংকে রাখা স্থায়ী আমানত থেকে ডিএসই ২০১৭-১৮ হিসাব বছরে সুদ আয় ছিল ৮৮ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। ওই বছর নিট মুনাফার চেয়ে বেশি লভ্যাংশ দেওয়ায় ২০১৮-১৯ হিসাব বছরে ডিএসইর স্থায়ী আমানতের পরিমাণ কিছুটা কমেছে। নিট মুনাফা কমে যাওয়া ও ডিএসই টাওয়ারের কারণে পরিচালন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ডিএসইর নিট মুনাফা আশঙ্কাজনক হারে কমে যাবে।

২০১৭-১৮ হিসাব বছরে ডিএসইর ব্যয় ছিল ১২৮ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। এর সঙ্গে নতুন ভবনের অবচয়সহ পরিচালন ব্যয় ৮০ কোটি টাকা যোগ হলে ব্যয় দাঁড়াবে ২০৮ কোটি টাকা। যদিও ২০১৭-১৮ হিসাব বছরে লেনদেন, লিস্টিং ফি, সুদ ও লভ্যাংশ আয়সহ বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে ডিএসইর মোট আয় ছিল ২০৯ কোটি টাকা। ফলে নতুন ভবন বাবদ অতিরিক্ত ব্যয় বাদ দেওয়ার পর আগামীতে ডিএসই মুনাফায় থাকবে কি না, তা নিয়েই সংশয়ে থাকতে হবে।

তবে ডিএসইর নতুন ভবনে কার্যক্রম শুরু হলেও শাখা ও বর্ধিত অফিস সংক্রান্ত স্টক এক্সচেঞ্জের আইনের ব্যতয় ঘটাতে হচ্ছে। একইসঙ্গে বহুল কাক্সিক্ষত ভবনটিতে ডিএসইর অফিস স্থানান্তর নিয়ে অতীতে আগ্রহ থাকলেও ব্রোকারদের মধ্যে বর্তমানে ছিটেফোটাও দেখা যাচ্ছে না। নিকুঞ্জে ডিএসইর অফিস যাওয়ার পর মতিঝিল এলাকায় অফিসগুলোর সঙ্গে কিভাবে যোগাযোগ বা দাফতরিক কর্মকান্ড পরিচালনা করা হবে সেটির নির্দেশনা না আসায় ব্রোকারদের মধ্যে কিছুটা দ্বিধা বিভক্তি কাজ করছে।

ডিএসইর নিকুঞ্জ ভবনের খুঁটিনাটি: রাজধানীর খিলক্ষেত-নিকুঞ্জ এলাকায় ডিএসইর নিজস্ব জমিতে ১৩তলা ভবনের আয়তন সাত লাখ ৪১ হাজার ১০৯ বর্গফুট। ভূগর্ভস্থ তিনতলা কার পার্কিংয়ের স্থান বাদে মূল ভবন হবে ১৩তলা। এর প্রথম দুই তলায় থাকবে ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, সাব-স্টেশন, লবি, মিডিয়া সেন্টারসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান। চতুর্থ তলা ডিএসইর অফিসের জন্য বরাদ্দ রাখা হবে। পঞ্চম তলা থেকে ১১ তলায় ব্রোকারেজ হাউস ও শেয়ারবাজার-সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থাকবে। অডিটরিয়ামের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১২ তলার কিছু অংশ ও ১৩ তলা। ভবনে ওঠা-নামায় যাত্রীবাহী লিফটের সঙ্গে থাকছে একটি কার্গো লিফট।

উল্লেখ্য, নিকুঞ্জ এলাকার যে জমিতে ১৩তলা ভবন নির্মাণ করা হয়েছে সেই জমিটি ১৯৯৬ সালে সরকারের কাছ থেকে চার কোটি টাকায় বরাদ্দ পায় ডিএসই। ২০০৭ সালের ২৪ ফেব্রæয়ারি ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন সাবেক তত্ত¡াবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দীন আহমেদ। ওই বছর ২৮ মার্চ ডিএসইর তৎকালীন প্রেসিডেন্ট শাকিল রিজভী আনুষ্ঠানিকভাবে নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন। ২০০৭ সালের ২৮ ফেব্রæয়ারি ডিএসইর ভবন নির্মাণ, স্থাপত্য ও প্রকৌশল কাজের জন্য জিবিবি লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী, ২০১০ সালের ৩১ মার্চে কাজ শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু ওই সময়ের মধ্যে মোট কাজের ২৪ দশমিক ১৭ শতাংশ শেষ হয়।

নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষে ব্যর্থ হওয়ায় আদালতের নির্দেশে ২০১০ সালের ১৫ জুলাই জিবিবি লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে ডিএসই। এরপর ভবন নির্মাণ কমিটি পুনঃদরপত্র আহবান করে। আটটি প্রতিষ্ঠান দরপত্র দাখিল করে। এর মধ্যে খুশলি নির্মাতা লিমিটেড, ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং (এনডিই) ও রেজা কনস্ট্রাকশন লিমিটেডকে প্রাথমিকভাবে বাছাই করা হয়। ২০১০ সালের ২৭ ডিসেম্বর এনডিইকে কাজ দেয়া হয়। নিকুঞ্জের এ নতুন ভবনের অফিস স্পেস ডিএসইর পর্ষদ ছাড়াও আড়াই শ’ সদস্যের মধ্যে বণ্টন করা হয়েছে। লটারির মাধ্যমে এ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। আর এ স্পেসের জন্য ডিএসইকে নির্ধারিত হারে ভাড়া দিতে হবে প্রত্যেক সদস্যকে।

শাখা ও বর্ধিত অফিস নিয়ে ডিএসইর আইনী সঙ্কট : বিদ্যমান আইন অনুযায়ী মূল স্টক এক্সচেঞ্জের দুই কিলোমিটারের মধ্যে ব্রোকারেজ হাউস ও কার্যকর প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান অফিসের সঙ্গে বর্ধিত অংশ হিসেবে ব্যবসা পরিচালিত করতে পারে। আর শাখা অফিসগুলোর অনুমতি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) মাধ্যমে নেয়া হয়ে থাকে। গত কয়েকবছর ধরে কমিশন ব্রোকারেজ হাউসের নতুন শাখা চালুর অনুমোদন বন্ধ রেখেছে। ব্রোকারেজ হাউসের নেতাদের পক্ষ থেকে কমিশনের কাছে নতুন শাখা খোলার আবেদনও করা হচ্ছে। কিন্তু এখনও কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি নিয়ন্ত্রক সংস্থা।

অন্যদিকে মতিঝিলের পুরাতন ভবন থেকে ডিএসইর অফিস স্থানান্তরের পর ডিএসইর ভবন, আশপাশের পল্টন, সেগুনবাগিচা, টিকাটুলিসহ ব্রোকারেজ হাউসগুলোর পরিচয় নিয়ে সঙ্কটে রয়েছে। তারা এখনও বুঝতে পারছে না, মতিঝিলের অফিসগুলো শাখা না বর্ধিত অংশ হিসেবে বিবেচিত হবে। কারণ এখন কমিশন আপাতত নতুন শাখা খোলার অনুমতি দিচ্ছে না। তাই বর্ধিত অংশ হিসেবেই এগুলো বিবেচনা হওয়ার কথা। কিন্তু মতিঝিল থেকে নিকুঞ্জের দূরত্ব ১৫ কিলোমিটারের বেশি। তাই স্পটতো মতিঝিলের অফিসগুলো কিছুটা পরিচয় সঙ্কটে ভুগছে।

তবে কমিশনের নির্ভরশীল একটি সূত্র জানিয়েছে, ডিএসইর পক্ষ থেকে শাখা অফিস ও বর্ধিত অংশের পরিচয় সংক্রান্ত লিখিত আবেদন জমা দেয়া হয়েছে। ডিএসইর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ব্রোকারেজ হাউসগুলোর অফিসগুলোকে ২ কিলোমিটারের পরিবর্তে ১৫ কিলোমিটারের মধ্যে স্থাপনের অনুমতি দেয়া হোক। আগামী কমিশনে এই বিষয়টি নিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিদ্ধান্ত নেবে বলে জানা গেছে।

নিকুঞ্জে আগ্রহ নেই ব্রোকারদের: অতীতে আগ্রহ দেখালেও বর্তমানের বাজার পরিস্থিতিতে ব্রোকাররা নিকুঞ্জের অফিসে যেতে চাচ্ছে না। অতিরিক্ত ভাড়া ও বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ কমে যাওয়ার আশঙ্কাতেই ব্রোকারেজ হাউসগুলো আর নিকুঞ্জে যাচ্ছে না। ডিএসইর নিকুঞ্জে যেতে মোট ১২১টি ব্রোকারেজ হাউস আগ্রহ দেখিয়েছিল। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৯টি ব্রোকারেজ হাউস পুরোপুরি রবিবারের লেনদেন করতে পারবে। আর ১০টি ব্রোকারেজ হাউস দ্রুত লেনদেন শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

বাকি ১০০টি ব্রোকারেজ হাউস কবে সেখানে অফিস স্থানান্তর করবে বা আদৌ সেখানে অফিস নেবে কিনা সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। মূলত ডিএসইর নতুন ভবনে অন্যদের তুলনায় অতিরিক্ত ভাড়া ও বিনিয়োগকারীদের উপস্থিতি কমে যাবে সেই আশঙ্কাতেই তারা আপাতত সেখানে যাচ্ছে না। আর বর্তমান বাজার পরিস্থিতি ব্রোকারদের আরও হতাশ করছে।

দাফতরিক কর্মকান্ডে স্থবিরতার আশঙ্কা : ডিএসই মতিঝিল থেকে সরে যাওয়ায় মূলত অধিকাংশ ব্রোকারেজের দাফতরিক কাজে সমস্যার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ বৃহস্পতিবার বিকেল পর্যন্ত ডিএসইর পক্ষ থেকে নতুন ভবনে যাওয়ার পর কোথায় কিভাবে কর্মকান্ড পরিচালনা করা হবে সেই বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। ফলে ব্রোকারেজ হাউসগুলোও এখনও অন্ধকারে রয়েছে। একইসঙ্গে পুরাতন ভবনটির স্ট্যাটাসও বলা হচ্ছে না। একইসঙ্গে ভাড়া সংক্রান্তু বিষয়ে ব্রোকারগুলোকে নিজ নিজ ভবনের মালিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে। তবে ব্রোকাররা বিষয়টি নিয়ে ডিবিএর সঙ্গে বৈঠকও করবে বলে জানা গেছে।

ডিএসইর পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বলেন, বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে ডিএসইর নতুন ভবন বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে। টাওয়ারের কারণে অবচয় ও পরিচালন ব্যয় বাবদ বছরে প্রায় ৬০ কোটি টাকা বেশি ব্যয় হবে। তবে লেনদেন হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হলে ও সব ভাড়াটিয়া ভবনটি ব্যবহার শুরু করলে হয়তো ব্রেক ইভেনে আসতে পারে। ভবনটির নির্মাণ ব্যয় বেশি হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন তিনি।