দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা : গ্রামে ঋণ দিতে অনিহা প্রকাশ করছে ব্যাংকগুলো। গ্রামের একজন দরিদ্র মানুষ ব্যাংকে ঋণ নিতে গেলে বিভিন্ন অজুহাতে তাদের ব্যাংকিং কার্যক্রমে সম্পৃক্ত হতে নিরুৎসাহিত করা হয়। কাউকে আবার এনজিও থেকে ঋণ নেয়ারও পরামর্শ দেয় ব্যাংকগুলো। এ সুযোগে চড়া সুদের ঋণ নিয়ে গ্রাহকদের দুয়ারে পৌঁছে যাচ্ছে এনজিওগুলো। এনজিও থেকে সর্বোচ্চ ২৪ শতাংশের চড়া সুদের ঋণ নিয়ে লাভবান হতে পারছে না গ্রামের মানুষ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৯ সালের জানুয়ারি-মার্চ মাসে ব্যাংক খাতের মোট আমানতের ২০.৮৯ শতাংশ সংগ্রহ করা হয়েছে গ্রাম থেকে, কিন্তু ঋণ দেয়া হয়েছে মাত্র ১০.২০ শতাংশ। শহর থেকে মোট আমানত সংগ্রহ হয়েছে ৭৯.১১ শতাংশ, কিন্তু ঋণ দেয়া হয়েছে ৮৯.৮০ শতাংশ। এভাবে গ্রামের মানুষের আমানত শহরে পাচার হয়ে অর্থনৈতিক ব্যবধান সৃষ্টি হচ্ছে। বিভিন্ন অজুহাতে ব্রাঞ্চ ম্যানেজাররা গ্রামের মানুষকে ঋণ দিচ্ছে না। খাত সংশ্লিষ্টরাও বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব না দেয়ায় চড়া সুদে এনজিওর ঋণ নিতে বাধ্য হচ্ছে গ্রামের মানুষ।

এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘এটা নতুন কিছু নয়। দীর্ঘদিন এই বৈষম্য চলে আসছে। আমানত গ্রহণ ও ঋণ প্রদানের এই অনুপাতের জন্য গ্রাম ও শহরের মধ্যে একটা বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে। গ্রামের মানুষ যে অনুপাতে ডিপোজিট রাখছে, সেই অনুপাতে ঋণ পাচ্ছে না। তখন সেই অর্থ শহরে চলে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে ব্যাংকের কিছু নিয়মকানুন রয়েছে যা গ্রামের মানুষ পূরণ করতে পারে না, তাই ব্যাংক ঋণও পায় না। আর কিছু ব্যাংক কর্মকর্তা আছে, যারা গ্রামের মানুষের সঙ্গে লেনদেন করতে চায় না। এসব কারণে এই ঋণ প্রবাহ কমছে। শুধু তা-ই নয়, শহর ও গ্রামের মানুষের আয় বৈষম্যও বাড়ছে।’

এই পরিস্থিতিতে করণীয় কি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু নীতিমালা আছে, যেমন কৃষিখাতে ঋণ প্রবাহ বাড়ানো, এসএমই খাতে ঋণ বাড়ানো ইত্যাদি। ব্যাংকগুলো প্রকৃতপক্ষে এই নীতিমালা মানছে কিনা তা তদারকি করতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংককে। তবে এ সমস্যা খুব দ্রুত সমাধান হবে বলে আমার মনে হয় না।’

গ্রামের মানুষকে ঋণ প্রদানে ব্যাংকগুলো অনিহা প্রকাশ করলেও শহরের চেয়ে গ্রামে ঋণখেলাপির হার অনেক কম। গ্রামের ঋণের রিকভারি রেট ৯৬ থেকে ৯৮ শতাংশ। গ্রামে অধিকাংশ ক্ষুদ্রঋণ প্রদান করে এনজিওগুলো এবং সুদও বেশি। গত ২০১৪ সালের জানুয়ারি-মার্চ গ্রাম থেকে আমানত সংগ্রহ করা হয় ১৮.১৮ শতাংশ এবং ঋণ প্রদান করা হয়েছে ৯.৯১ শতাংশ। ২০১৯ সালের একই সময়ে সেটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে আমানত ২০.৮৯ ও ১০.২০ শতাংশে। সে তুলনায় গ্রামে আমানত ও ঋণ প্রদান দুটিই বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু যে হারে বৃদ্ধি পাওয়ার কথা সেই হারে বৃদ্ধি পায়নি।

ব্যাংকগুলোর অনিহার কারণে এনজিও ঋণের হার বাড়ছে কিনা জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আতিউর রহমান বলেন, ‘হ্যাঁ, এই সমস্যাটা রয়েছে। অনেক সময় গ্রামের মানুষকে ঋণ দিতে চায় না ব্যাংকগুলো। এগুলো ঠিক করার জন্য আমরা অনেক পদক্ষেপ নিয়েছিলাম। শহরে দেয়ার পর অনেক ঋণ ফেরত আসে না। কিন্তু গ্রামের ঋণ ফেরত আসে। এজন্য নিজেদের স্বার্থেই গ্রামের মানুষকে ঋণ দেয়া উচিত ব্যাংকগুলোর।’

গ্রামে শাখা খুলেও গ্রামের মানুষকে ঋণ না দিলে তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া যাবে কিনা জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘একজন গ্রাহক ব্যাংকে গিয়ে ঋণ নেয়ার জন্য সব কাগজপত্র দেয়ার পরও ঋণ না পেলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাস্টমার কমপ্লেইনসে অভিযোগ করতে পারবে। বাংলাদেশ ব্যাংক সেই অভিযোগের ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গ্রামের ৭৪ শতাংশ মানুষ ব্যাংক থেকে ঋণ সুবিধা পান না। এসব এলাকার বড় অংশই এনজিও ঋণনির্ভর। এনজিও থেকে ঋণ নেয় ২৮ শতাংশ মানুষ। ব্যাংক ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশের কাছাকাছি কিন্তু এনজিওর সুদের হার ২৪ থেকে ২৭ শতাংশ। বিবিএসের পরিসংখ্যানে আরও বলা হয়, যারা এনজিও থেকেও ঋণ পান না, তারা এলাকার মহাজন ও আত্মীয়স্বজন থেকে ঋণ নেন। মহাজনদের থেকে ঋণ নেন ৩ দশমিক ৬৭ শতাংশ, আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে ঋণ নেন ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ এবং অন্যান্য উৎস থেকে ঋণ নেন ৩ দশমিক ২৭ শতাংশ। এসব উৎস থেকে নেয়া ঋণের সুদের হার এনজিও থেকেও বেশি, প্রায় ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ। অর্থাৎ দেশের ব্যাংকিং খাতের উদাসীনতার কারণে ২৪ থেকে ৫০ শতাংশ সুদে ঋণ নিতে বাধ্য করা হচ্ছে গ্রামের মানুষকে।

এই প্রসঙ্গে রুপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ বলেন, ‘গ্রামগুলোকে বলা হয় ডিপোজিট সংগ্রহের সেন্টার। শহরকে বলা হয় বিনিয়োগের সেন্টার। শহরে বিনিয়োগের যেমন সুযোগ রয়েছে, গ্রামে তেমন সুযোগ নেই। এজন্য আমানত সংগ্রহ ও ঋণ প্রদানের অনুপাতটা এমন।’ গ্রামের মানুষকে ঋণ প্রদানে ব্যাংকগুলোর অনিহার কারণে ঋণ প্রদানের হার কম কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না, গ্রামের মানুষকে ঋণ দিতে আমরা আগ্রহী, বিশেষ করে সরকারি ব্যাংকগুলো। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, এখন শহরের তুলনায় গ্রামের উন্নয়ন বেশি। এই উন্নয়ন রুপালী, সোনালী, অগ্রণী ও কৃষি ব্যাংকই করেছে, এনজিওগুলো করেনি। তবে আত্ম সমালোচনা হিসেবে বলতে পারি, গ্রামে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের আরও একটিভ হওয়া উচিত, যেন এনজিওগুলো ঢুকতে না পারে।’

ব্যাংক ও এনজিওর সুদ হারে পার্থক্যের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটা আমাদের অনেক বড় ব্যর্থতা। কারণ আমরা শহরের ধনীদের ৯ শতাংশ সুদে ঋণ দিচ্ছি কিন্তু গ্রামের একজন দরিদ্রকে ২৫ শতাংশের ওপরে এনজিও থেকে নিতে হচ্ছে। এনজিওগুলো অরেকটা আইন লঙ্ঘন করছে। সেটা হলো, তারা প্রত্যেক ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে সঞ্চয় সংগ্রহ করলেও সেই সঞ্চয়ের ওপর সুদ দিচ্ছে না এবং শেয়ারও দিচ্ছে না। এনজিওগুলো বলে, তারা জনসেবা করছে। আসলে তারা জনসেবা তো করেই না বরং গ্রামের দরিদ্র মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছে। নিজেরা উন্নত জীবনযাপন করছে, বাড়ি করছে, গাড়ি করছে।’

দেশে এসব এনজিওর সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমন বাড়ছে ঋণ বিতরণের পরিমাণ। মাইক্রো ক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির (এমআরএ) পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৭ সালের জুন মাস পর্যন্ত দেশের ছোট বড় এনজিওর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭৮৩টি। এসব এনজিওর মোট ১৭ হাজার ১২০টি ব্রাঞ্চ ও ১ লাখ ৩৯ হাজার ৫২৬ জন কর্মী কাজ করছে। এসব এনজিও ২০১২-১৩ সালে মোট ঋণ প্রদান করেছে ৪৩ হাজার ২২৮ কোটি টাকা। ২০১৬-১৭ সালে সেটি বেড়ে দাঁড়ায় ১ লক্ষ ৪ হাজার ৬১২ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত পাঁচ বছরে ঋণ বিতরণের পরিমাণ দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। গ্রামের মানুষ ব্যাংক ঋণ না পেয়ে এনজিওর ঋণ নিচ্ছে। এনজিও থেকে সহজে ঋণ পেয়ে কিছুটা উপকৃত হলেও চড়া সুদের কারণে ব্যবসায় লাভবান হতে পারছে।

এ প্রসঙ্গে রাজশাহী জেলার তানোর উপজেলার বাসিন্দা আলম হোসেন বলেন, ‘গত বছর একটি এনজিও থেকে ৬০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিলাম। যে পরিমাণ টাকা ঋণ নিয়েছি এক বছর পর তা সুদে আসলে শেষ হয়ে গেছে। শুনেছি ব্যাংক থেকে কম সুদে ঋণ দেয়। এজন্য এনজিওর ঋণ নেয়ার আগে একটি সরকারি ব্যাংকে গিয়েছিলাম। ব্যাংকের ম্যানেজার জানিয়েছিল, ঋণ নিতে হলে জমির দলিল জমা দিতে হবে। আমি বসতভিটার দলিলটা জমা দেয়ার জন্য তার কাছে নিয়ে গেলাম। ম্যানেজার বলল, দলিলে সমস্যা আছে, তাই এই দলিল জমা রেখে ঋণ দেয়া যাবে না। ম্যানেজার আমাকে এনজিও থেকে ঋণ নেয়ার পরামর্শ দিল। পরে আমি ভূমি অফিসে গিয়ে জেনেছি, দলিলে কোন সমস্যা ছিল না।’

এমন ব্যাংক কর্মকর্তার বিষয়ে অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও শামস-উল ইসলাম বলেন, ‘একজন ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে ভুলে যায়, তার বাবা কত কষ্ট করে তাকে লেখাপড়া শিখিয়েছে। সে যখন গ্রামে গিয়ে চাকরি করে, তখন নিজেকে বড় সাহেব মনে করে। তখন সে গ্রামের মানুষের দুঃখ দুর্দশা বুঝে না। সে এটাও ভুলে যায়, তার মা মুরগির ডিম বিক্রি করে তার কলম-খাতা কিনে দিয়েছিল। তার বাবা হালের গরু বিক্রি করে ভার্সিটিতে ভর্তি করিয়েছিল। এসব যদি তার মনে থাকত, তাহলে গ্রামের মানুষকে সেবা দিতে অনিহা করত না, গ্রামের মানুষকে ছোট করেও দেখতো না। আমরা এই মানসিকতা পরিবর্তন করার চেষ্টা করছি। ইনশাল্লাহ একদিন পরিবর্তন হবে।’

সম্প্রতি এনজিওর সুদহার কিছুটা কমানোর নির্দেশনা দিয়েছে মাইক্রো ক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি। এখন থেকে ক্রমহ্রাসমান স্থিতি পদ্ধতিতে সর্বোচ্চ ২৪ শতাংশ পর্যন্ত সুদহার আরোপ করতে পারবে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো। এর আগে সর্বোচ্চ সীমা ছিল ২৭ শতাংশ। ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক ও প্রশাসনিক ব্যয় বিশ্লেষণ করে সুদহার কমানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো যে অর্থ বিনিয়োগ করছে, তার ৩৫ শতাংশ আসছে নিজস্ব তহবিল থেকে, যার পেছনে কোন ব্যয় নেই। গ্রাহকদের সঞ্চয় থেকে আসছে ৩৫ শতাংশ, এক্ষেত্রেও প্রতিষ্ঠানগুলোর খরচ কম। বাকি ৩০ শতাংশ অর্থ আসছে ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, পিকেএসএফসহ অন্যান্য সরকারি সংস্থা ও দাতা তহবিল থেকে। নিজস্ব তহবিল বৃদ্ধি পাওয়ায় এসব এসব এনজিওর তহবিল ব্যয় কমেছে।

২৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে সর্বোচ্চ ২৪ শতাংশ করা হলেও এই সুদের হার ব্যাংকের তুলনায় অনেক বেশি কিনা- জানতে চাইলে পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) সভাপতি কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, ‘ব্যাংক একসঙ্গে অনেক বেশি বিনিয়োগ করে, যেমন এক কোটি, ১০ কোটি, হাজার কোটি ইত্যাদি। আর এনজিও থেকে দেয়া হয় ছোট আকারে। এটা দেয়া হয়, ব্যক্তি পর্যায়ে ও পরিবার পর্যায়ে। এসব ছোট ছোট সহায়তা দেয়ার ক্ষেত্রে লোকবল বেশি লাগে, খরচ বেশি পড়ে। এনজিও শুধু টাকা দিয়েই ছেড়ে দেয় না, প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি, তথ্য ও বাজারজাতকরণে সহায়তা করে গ্রাহককে। তাছাড়া বছর শেষে যা সঞ্চয় হয়, তার ১৫ থেকে ২০ শতাংশ অর্থ গ্রাহকের বাচ্চাদের পড়াশোনা ও স্বাস্থ্য সেবায় অনুদান হিসেবে খরচ করা হয়। আর সুদের হার সর্বোচ্চ ২৪ শতাংশের মানে অনেকে বুঝে যে ২৪ শতাংশই, কিন্তু সেটি সঠিক নয়। সুদের হার ১ শতাংশ আছে, ৮ শতাংশ আছে, ১২ শতাংশ আছে. ২০ শতাংশ আছে আর সর্বোচ্চ ২৪ আছে।