দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা : পুঁজিবাজারের টালমাতাল পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীরা স্বস্তি ফিরে পাচ্ছেন না। দেশের দুই পুঁজিবাজারে একদিকে রয়েছে তারল্যের সঙ্কট অন্যদিকে বিনিয়োগকারীদের আস্থার অভাব। পুঁজিবাজার উন্নয়নে সকারের নেওয়া নানা উদ্যোগও কাজে আসছে না। ফলে দীর্ঘ দিন পুঁজিবাজারে চলছে অস্থিরতা। আর বর্তমান বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার সংকট ও তারল্য সংকটের কারনে বাজার ঘুরে দাঁড়াতো পারছে না। বর্তমান বাজার নিয়ে সরকারসহ নীতি নির্ধারকরা বাজার উন্নয়নে নানামুখী পদক্ষেপ নিলেও বাজার স্থিতিশীল হচ্ছে না।

বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে পুঁজিবাজারে কোনো গতি নেই। টানা মন্দার কবলে বাজার। প্রতিদিন প্রায় সব ধরনের শেয়ারের দর কমছে। কমছে লেনদেন। বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা প্রায় শূন্যের কোঠায়। তার পরও নিয়ন্ত্রক সংস্থার কোনো বিকার নেই, নেই কোনো সুপরিকল্পিত উদ্যোগ। এ অবস্থায় বিনিয়োগকারীদের অভিযোগের তীর ডিমিউচুয়ালাইজেশনের (মালিকানা থেকে ব্যবস্থাপনা পৃথক্করণ) দিকে। তাদের অভিমত, ডিমিউচুয়ালাইজেশনের আগে অনেক স্বপ্ন দেখানো হলেও তা কোনো কাজে আসছে না। বাজারে গতি ফেরাতে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারছে না নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানগুলো। ফলে পুঁজিবাজার যেন গলার কাঁটা সরকারের জন্য। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে ধস নামার পর বাজার স্বাভাবিক ধারায় আনতে নয় বছর ধরে চেষ্টা চলছে। দেওয়া হয়েছে নানা আর্থিক প্রণোদনা ও নীতি সহায়তা। কোনো সুবিধাই কাজে আসেনি। উল্টো বাজারের আরও অবনতি হয়েছে।

কয়েক বছরে শেয়ারবাজার ইস্যুতে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংশ্নিষ্টদের নিয়ে কয়েক দফায় আনুষ্ঠানিক বৈঠক করেছেন। বর্তমান ও সাবেক অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে আলাদা বৈঠক করেছেন। শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গেও বৈঠক করে সমস্যার কথা শুনেছেন। বাজারের জন্য সহায়ক হতে পারে এমন পদক্ষেপ নিতে বলেছেন। সরকারের এমন আন্তরিক প্রচেষ্টার পরও শেয়ারবাজার সংকটের সমাধান না হওয়ার কারণ কী- এমন প্রশ্নে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, অনেক পদক্ষেপই সময়মতো নেওয়া হয়নি। বিনিয়োগকারীদের জন্য আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করা যায়নি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, যখনই দরপতন মাত্রা ছাড়িয়েছে, সমালোচনার ঝড় উঠেছে, তখনই সংশ্নিষ্টরা নড়েচড়ে উঠেছেন। দফায় দফায় মিটিং-সিটিং করেছেন। বেশিরভাগ সময় যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তার বাস্তব কার্যকারিতা ছিল না বা বিলম্বে সিদ্ধান্ত হয়েছে, কার্যকর হয়েছে আরও পরে। তার থেকেও বড় কথা, শেয়ারবাজারে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় কোনো অগ্রগতিই হয়নি। তিনি আরও বলেন, সমস্যাগ্রস্ত শেয়ারবাজারকে স্বাভাবিক ধারায় আনতে দক্ষতা, সততা এবং প্রয়োজনে কঠোরতার মাধ্যমে পরিচালনার জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থায় যে নেতৃত্বের দরকার ছিল, সরকার তা নিশ্চিত করতে পারেনি। কিছু ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থার কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়ম, এমনকি আইন করে স্বার্থানেষী মহলকে সুবিধা করে দেওয়ার অভিযোগ আছে। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে ধস নামার পর ২০১১ সালের ২২ জানুয়ারি রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় শেয়ারবাজারের অংশীদার, বিশেষজ্ঞ ও সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের করণীয়

নির্ধারণে উচ্চপর্যায়ের বৈঠক করেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। ওই বৈঠকের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদকে প্রধান করে ধসের কারণ খতিয়ে দেখতে তদন্ত কমিটি করে সরকার। কমিটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসইসির দায়িত্বে অবহেলাসহ কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের দায় উল্লেখ করে প্রতিবেদন দেয়। নিজেদের সীমাবদ্ধতা স্বীকার করে তৎকালীন নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে পুনর্গঠন করে শেয়ার কারসাজির অধিকতর তদন্ত করার সুপারিশ করে।

সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এম খায়রুল হোসেনকে চেয়ারম্যান করে কমিশন পুনর্গঠন করে। কিন্তু আগের কমিশনের অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কার্যত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা করলেও তা স্থগিত হয়ে আছে, সুরাহা করার উদ্যোগ নেই। শেয়ারবাজার ট্রাইব্যুনাল গঠন করলেও সেখানে মামলা নেই। ছিয়ানব্বইয়ের শেয়ার কারসাজির মতো ২০০৯-১০ সালের কারসাজির ঘটনারও বিচার হয়নি। শেয়ার কারসাজি করলে বিচার হয় না- এমন ধারণা বদ্ধমূল হয়েছে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে। ২০১১ সালের নভেম্বরে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি পোষাতে ৯০০ কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন তহবিল (স্বল্পসুদে ঋণ) দেয় সরকার। প্রক্রিয়াগত জটিলতাসহ নানা কারণে অর্থছাড় হয় ২০১৩ সালের আগস্টে অর্থাৎ বাজার ধসের প্রায় তিন বছর পর। দীর্ঘ পতনের পর আর্থিক সুবিধা দেওয়া হলেও যাদের জন্য এ সুবিধা তারা নিজেদের পুঁজির পুরোটা হারান। ফলে নতুন করে ঋণের বোঝা নিতে রাজি ছিলেন না। সরকারের ৯০০ কোটি টাকার ঋণের অর্থ পুরোটা কখনও ব্যবহার হয়নি। এর সিংহভাগই ব্যবহার করেছে আইসিবি তার গ্রাহকদের জন্য। ফলে ওই তহবিল তেমন কাজে আসেনি। সাম্প্রতিক দরপতনের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ব্যাংক ওই অর্থ দিয়ে শেয়ারবাজারে তারল্য জোগান বাড়াতে ঘূর্ণায়মান তহবিল গঠন করেছে। এ তহবিল থেকে আইসিবি একাই ৭৫০ কোটি টাকা ঋণ হিসেবে নিয়েছে। খোদ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির চেয়ারম্যান অভিযোগ করেছেন, আইসিবি এ অর্থ দরপতনের সময় বিনিয়োগ করেনি। অর্থাৎ সরকারের এ সহায়তা আগেও কাজে আসেনি, এখনও নয়।

২০১১ সালের নভেম্বরে ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের জন্য আইপিওতে বিশেষ কোটা বরাদ্দ রাখা হয়। কিন্তু ব্যাপক লোকসানে মূল পুঁজি হারানোর পর অনেকেই আইপিও শেয়ার পেতে আগ্রহী ছিলেন না। এর অন্যতম কারণ, আইপিওতে ১০০ থেকে ৫০০টি শেয়ার পাওয়া যায়। তাছাড়া প্রতি ১০ থেকে ৫০ জন আবেদন করে একজন আইপিও শেয়ার পায়। এভাবে ক্ষতি পোষানোর চেষ্টাও কাজে আসার সুযোগ ছিল না। ২০১১ সালের শেষে দরপতন রুখতে শেয়ারের ক্রয় চাহিদা বাড়াতে কমিশন তালিকাভুক্ত কোম্পানির উদ্যোক্তা-পরিচালকদের সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ এবং পরিচালকদের এককভাবে ২ শতাংশ শেয়ার থাকার বাধ্যবাধকতা আরোপ করে। নির্দেশনা জারির আট বছর পরও তা কার্যকর করতে পারেনি। উল্টো এ সময়ে তালিকাভুক্ত বেশ কিছু কোম্পানির উদ্যোক্তা-পরিচালকরা গোপনে নিজেদের শেয়ার বিক্রি করে পালিয়েছে। এর কয়েকটি কোম্পানি এখন বন্ধ।

২০১৫ সালে প্রথম দফায় ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং বীমা কোম্পানিগুলোর জন্য করপোরেট করহার আড়াই শতাংশ এবং ২০১৮ সালে আরেক দফায় আড়াই শতাংশ কমানো হয়। ২০১৫ সালে আর্থিক খাতের বাইরে বাকি সব খাতের করপোরেট করহার আড়াই শতাংশ কমানো হয়। এছাড়া এ বছর বস্ত্র খাতে নানাভাবে করছাড় দেওয়া হয়েছে। কয়েক বছর শেয়ারবাজারে কালো টাকা বিনা প্রশ্নে বিনিয়োগের সুযোগ করে দিয়েছিল সরকার। এসব সুবিধাও কাজে আসেনি।

সাম্প্রতিক দরপতন ও প্রণোদনা : চলতি বছরের বেশিরভাগ সময় শেয়ারাবাজারের অবস্থা খারাপ গেছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচক কমতে কমতে ৫ হাজার পয়েন্টের নিচে এসেছে। দায়িত্ব নেওয়ার পর নতুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল শেয়ারাবাজার ঠিক করতে বাজেটে চমক দেখানোর আগাম ঘোষণা দেন। বাজেটে করমুক্ত লভ্যাংশের সীমা বাড়ানো হয়। নগদ লভ্যাংশ উৎসাহিত করতে অবণ্টিত মুনাফা এবং অধিক বোনাস লভ্যাংশ ঘোষণার ওপর কর আরোপ করেন। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হলে কিছুটা সংশোধন করে সরকার। তবে অর্থমন্ত্রী যাকে প্রণোদনা বলেছেন, তাকে প্রকৃত অর্থে প্রণোদনা বলতে নারাজ অনেকেই। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে এসে শেয়ারবাজারে নিয়মবহির্ভূত বিনিয়োগ ঠেকাতে কঠোর হওয়ার কারণে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো দ্রুত শেয়ার বিক্রি করেছিল। এটি ধস নামার অন্যতম কারণ ছিল। পরবর্তী সময়ে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে কড়াকড়ি আরোপ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ২০১৬ সাল থেকে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ বাড়াতে দফায় দফায় নিয়ম সংশোধন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ বছরও দুই দফায় শেয়ারবাজারে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ সীমা গণনা-সংক্রান্ত নীতি শিথিল করেছে। সর্বশেষ রেপোর মাধ্যমে ট্রেজারি বিল ও বন্ডে ব্যাংকের বিনিয়োগের কিছু অংশ ঋণ দিতে রাজি হলেও সিংহভাগ ব্যাংকই এ ঋণ নিয়ে স্বল্পমেয়াদি বিনিয়োগ করতে রাজি নয়। ব্যাংকগুলোর শীর্ষ কর্মকর্তারা জানান, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করার মতো দক্ষ লোক এখন তাদের নেই।

বাজার সংশ্নিষ্টরা যা বলেন: নানা প্রণোদনার পরও বাজার স্বাভাবিক না হওয়ার কারণ ব্যাখ্যায় ডিএসইর ব্রোকারদের সংগঠন ডিবিএর সভাপতি শাকিল রিজভী বলেন, সময়ের কাজ সময়ে না করলে তা কাজে আসে না। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে ধস নামার পর শেয়ারবাজারে যত ধরনের প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে, তার কোনোটিই প্রকৃত বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার মতো ছিল না।

শাকিল রিজভী বলেন, শেয়ারবাজারকে সঠিক পথে রাখে বিশ্নেষণনির্ভর বিনিয়োগ, যা প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায় থেকে হয়। বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ নগণ্য। ২০১০ সাল পর্যন্ত এ বাজারে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বড় প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী হিসেবে কাজ করলেও তাদের কার্যক্রম ক্রমে সংকুচিত করা হয়েছে। এদের বিকল্প হিসেবে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানকে দাঁড় করানো যায়নি। মিউচুয়াল ফান্ড বিকল্প হতে পারত। কিন্তু সম্পদ ব্যবস্থাপক কোম্পানিগুলো পেশাদারিত্ব দেখাতে পারেনি।

ব্যক্তি বিনিয়োগকারী যে শেয়ারবাজারে প্রধান ভূমিকা রাখে সে বাজারে অস্থিরতা থাকবেই-এমন মন্তব্য করে অর্থনীতিবিদ আবু আহমেদ বলেন, তার থেকেও বড় কথা ১৭ কোটি মানুষের দেশে কয়েক লাখ মানুষ বিনিয়োগ করেন। বাকিরা করেন না, কারণ আস্থা নেই। এখানে কারসাজি হয়, কিন্তু তার বিচার হয় না। প্রকৃতপক্ষে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে অর্থাৎ বিনিয়োগ করার জন্য যে ধরনের পরিবেশ তারা চায়, তা নিশ্চিত করতে পারলে অন্য কিছুর দরকার পড়ে না।