এফ জাহান, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: বহুমুখী সংকটে ডুবছে বস্ত্র খাতের কোম্পানি ডেল্টা স্পিনার্স। উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধিতে এরই মধ্যে পুঁজিবাজারের বস্ত্র খাতের কোম্পানিগুলোর ব্যবসায় বিপর্যয় ফুটে উঠেছে। বাড়তি ব্যয়ে ঝুঁকিতে পড়ছে বস্ত্র খাত। কাঁচামাল, জ্বালানি ও পরিবহন ব্যয় বাড়ার কারণে সংকটে রয়েছে বস্ত্র খাত। উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় এ খাতের বেশিরভাগ কোম্পানির নিট মুনাফা কমেছে।  ফলে বস্ত্র খাতের তালিকাভুক্ত প্রায় সব কোম্পানিই শেয়ারদর হারিয়েছে।

বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, বস্ত্র খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে বিনিয়োগকারীরা আশানুরূপ গেইন করতে না পারায় আস্থার সংকট দেখা দিয়েছে। ভালো পারফরমেন্সের মাধ্যমে কোম্পানিগুলোর এ পরিস্থিতি থেকে উত্তোরণ সম্ভব।

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বস্ত্র খাতের কোম্পানি ডেল্টা স্পিনিং রাইটে অর্থ উত্তোলনের পরে মুনাফা ক্রমাগত কমছে। মুলত ব্যবসা স¤প্রসারনের লক্ষ্যে রাইট শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে অর্থ উত্তোলন করলেও ধারাবাহিকভাবে মুনাফায় ধ্বস নামছে কোম্পানিটির। বর্তমানে কোম্পানিটির শেয়ার দর ফেসভ্যালুর নিচে রয়েছে।

১০ টাকার ফেসভ্যালু শেয়ারের দর ৩ টাকার ঘরে অবস্থান করছে। এছাড়া ডেল্টা স্পিনিং শেয়ার প্রতি সম্পদমুল্য ক্রমাগত কমেছে। ২০১৩ সালে কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি সম্পদ ছিল ২৬.৮২ টাকা, বর্তমানে কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি সম্পদমুল্য দাঁড়ায় ১৪.৪১ টাকা। কোম্পানির এমন শোচণীয় অবস্থায় উদ্যোক্তা/পরিচালকেরা তাদের শেয়ার বিক্রি করে মালিকানা অর্ধেকে নামিয়ে এনেছেন।

কোম্পানিটির পক্ষে ২০১৪ সালে ১টি সাধারন শেয়ারের বিপরীতে ২টি রাইট শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে ৯১ কোটি ৭৩ লাখ টাকা সংগ্রহ করা হয়। এজন্য ওই বছরের ৫ আগস্ট থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত শুধুমাত্র অভিহিত মূল্যে চাদাঁ সংগ্রহ করে। ব্যবসা স¤প্রসারনে ৭২ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ও ১৮ কোটি ৩৫ লাখ টাকার ঋণ পরিশোধের লক্ষ্যে এই অর্থ সংগ্রহ করা হয়।

দেখা গেছে, রাইটে অর্থ সংগ্রহের ২০১৪-১৫ অর্থবছরে কোম্পানিটির মুনাফা হয়েছিল ৭ কোটি ২১ লাখ টাকা। এরপরের বছরগুলোতে রাইটের অর্থ ব্যবহারের ফলে মুনাফা ধারাবাহিক উত্থানের পরিবর্তে কমেছে। রাইট সংগ্রহের পরের অর্থবছরেই (২০১৫-১৬) মুনাফা কমে আসে ৪ কোটি ৬৭ লাখ টাকায়। যা এরপরের ২০১৬-১৭ অর্থবছরে কমে আসে ৪ কোটি ৩৭ লাখ টাকায়।

এরপরে ২০১৭-১৮ অর্থবছর অনেক আগে পার হয়ে গেলেও সেই অর্থবছরের সম্পূর্ণ মুনাফার তথ্য প্রকাশ করা হয়নি। ওই অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই ১৭- মার্চ ১৮) কোম্পানিটির মুনাফা হয় ২ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরের ৯ মাসে (জুলাই ১৮- মার্চ ১৯) মুনাফা হয়েছে ৩ কোটি ২৬ লাখ টাকা।

তবে কোম্পানিটির ২০১৩ সালে মুনাফা করছিল ৪ কোটি ৭৭ লাখ টাকা, ঐ সময় কোম্পানিটির ইপিএস ছিল ১টাকা ৪ পয়সা। তেমনি ২০১৪ সালে কোম্পানিটি মুনাফা করছিল ৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা, ঐ সময় কোম্পানিটির ইপিএস ছিল ১.৪১ টাকা। টানা কোম্পানির ইপিএস কমে ২০১৭ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ২৯ পয়সা। বিনিয়োগকারীদের প্রশ্ন ৫ বছরের মাথায় কোম্পানির মুনাফায় বড় ধরনের ধ্বস নেমেছে। কোম্পানিটি ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল তিন বছর ক্যাশ ডিভিডেন্ড ঘোষনা করলেও ২০১৬ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত স্টক ডিভিডেন্ড ঘোষণা করে।

ডেল্টা স্পিনার্সের সচিব মাসুদুর রহমান বলেন, মুনাফা কমে যাওয়ার অনেক কিছু আছে। তবে সেগুলো নিয়ে কথা বলা যাবে না। আমরা সবকিছু আর্থিক প্রতিবেদনে তুলে ধরি। সেখানেই পাওয়া যাবে। কিন্তু ২০১৭-১৮ অর্থবছরের আর্থিক প্রতিবেদনতো প্রকাশ হয়নি এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, সেটা ঠিক আছে। তাহলে ওই বছরের বিস্তারিত পাওয়া যাবে না। তারপরেও এখন অনেক কড়াকড়ি চলছে। কিছু বললেই মূল্য সংবেদনশীল তথ্য (পিএসআই) হয়ে যায়। তাই কিছু বলা ঠিক হবে না।

রাইটে বিপুল অর্থ সংগ্রহের পরে কোম্পানিটির পর্ষদ বোনাস শেয়ার দেওয়া শুরু করে। রাইটের আগে নগদ লভ্যাংশ দিলেও ২০১৫-১৬ অর্থবছর ও ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১০ শতাংশ করে বোনাস শেয়ার দেয়। আর নির্ধারিত সময় পার হয়ে গেলেও ২০১৭-১৮ অর্থবছরের ব্যবসা নিয়ে এখনো লভ্যাংশ ঘোষণা করেনি। এছাড়া ওই অর্থবছরের জন্য বার্ষিক সাধারন সভাও (এজিএম) অনুষ্ঠিত হয়নি।

যে কারনে কোম্পানিটি সর্বনি¤œ ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে পতিত হয়েছে। ১৯৯৫ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া ডেল্টা স্পিনার্স ২০১০ ও ১৯৯৬ সালে রাইট শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে। ওই ২ বছরই ১টি সাধারন শেয়ারের বিপরীতে ১টি করে রাইট শেয়ার ইস্যু করেছিল।

প্রতিবারই অভিহিত মূল্যে রাইট শেয়ার ইস্যু করা হয়। ২০১৪ সালে রাইট ইস্যুর মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহের সময় ডেল্টা স্পিনার্সের উদ্যোক্তা/পরিচালকদের ৩৩ শতাংশ মালিকানা ছিল। এখন সেটা নেমে এসেছে মাত্র ১৮ শতাংশে। ব্যবসায় দুরাবস্থার সঙ্গে সঙ্গে উদ্যোক্তা/পরিচালকেরা কোম্পানিটি থেকে নিজেদেরকে সড়িয়ে নিয়েছেন।

এছাড়া পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বস্ত্র খাতের শেয়ার ছেড়ে যাচ্ছে বিদেশিরা। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদেরও আগ্রহ কমছে এসব শেয়ারে। প্রত্যাশিত মুনাফা না পেয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীরাও হতাশ। মন্দা বাজারে এ খাতের বেশ কিছু কোম্পানির দর ফেস ভ্যালুর নিচে। সব মিলিয়ে বস্ত্র খাতের কোম্পানিগুলোর বেহাল দশা।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বস্ত্র খাতের যেসব প্রতিষ্ঠান তালিকাভুক্ত হয়েছে তার বেশিরভাগেরই পারফরমেন্স দুর্বল। এসব কোম্পানি বাজারে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের আগে তাদের আর্থিক প্রতিবেদন ফুলিয়ে ফাপিয়ে দেখিয়েছে। বাজার থেকে অর্থ উত্তোলনের পর তাদের প্রকৃত দুর্বল আর্থিক চিত্র প্রকাশ পেয়েছে। এসব কোম্পানির অধিকাংশই প্রতিযোগিতার বাজারে হারিয়ে যাচ্ছে।

এছাড়া কিছু কোম্পানি মালিকানার দ্ব›েদ্ব জড়িয়ে পড়েছে। এসব কারণে বস্ত্র খাতের অধিকাংশ কোম্পানির পারফরমেন্স দুর্বল। তাদের দুর্বল পারফরমেন্সের কারণে পুরো বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। তবে ভালো পারফরমেন্সের মাধ্যমে এসব কোম্পানি বাজারে আস্থা ফেরাতে পারে। যা বাজার স্থিতিশীলতায় সহায়ক হতে পারে বলে মনে করছেন তারা।

এদিকে পোশাক শিল্পে গত কয়েক বছরে ব্যয় বেড়েছে। ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বেড়েছে গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানির বিল। বেড়েছে পরিবহন ব্যয়, সরকারের ভ্যাট-ট্যাক্স, পৌরকর এবং বন্দর খরচ; অন্য দিকে শ্রমিকের মজুরি বেড়েছ ৫১ শতাংশ। কিন্তু পণ্যের দাম সে তুলনায় বাড়েনি, উল্টো কমেছে। অন্য দিকে কমেছে রফতানিরও। অসম ও অসুস্থ প্রতিযোগিতায় রফতানিমূল্যও প্রতিনিয়ত কমছে।

এসব কারণে রফতানিবাণিজ্যে ৮৪ শতাংশ অবদান রক্ষাকারী সম্ভাবনাময় তৈরী পোশাক শিল্প খাতে অস্থিরতা বিরাজ করছে। আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে ব্যর্থ হয়ে প্রতিনিয়ত বন্ধ হয়ে যাচ্ছে নতুন নতুন কারখানা। গত পাঁচ বছরে বন্ধ হয়েছে অন্তত ১৩০০ কারখানা। বাড়ছে শ্রমিক ছাঁটাই ও অসন্তোষ। স্বল্পসংখ্যক বড় কারখানার কথা বাদ দিলে বেশির ভাগ কারখানার জন্য কোনো সুসংবাদ নেই আগামী দিনের রফতানি আদেশেও।