দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা : সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার জন্য ব্যাংকগুলোকে নতুন করে আবারো সময়সীমা বেঁধে দিচ্ছে সরকার। বেঁধে দেয়া সময়সীমা হিসেবে আগামী বছরের ১ জানুয়ারিকে নির্ধারণ করা হতে পারে বলে জানা গেছে। বলা হবে, নির্ধারিত সময়ে মধ্যে ব্যাংকের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজেটে (এক অঙ্কের ঘরে) নামিয়ে আনলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের বিরুদ্ধে দ্রুত শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেয়া হবে। এই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে ব্যাংকগুলো দেয়া কিছু সুযোগ সুবিধা প্রত্যাহার করা হতে পারে।
শুধু ব্যাংক ঋণের সুদের হারই নয়, একই সাথে ব্যাংকগুলোকে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার জন্য কঠোর বার্তা দেয়া হবে। আর এসব বিষয়ে নিয়ে আলোচনার করার জন্য আগামী রোববার পরিকল্পনা কমিশনের ব্যাংকারদের সাথে জরুরি বৈঠকে বসছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এই বৈঠকে সব তফসিলভুক্ত ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের যোগদান করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, গত বছর ব্যাংক ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নিয়ে আসতে নির্দেশনা দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে সময় সুদের হার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ব্যাংকের মালিকরা বেশ কয়েকটি সুবিধাও নিয়েছেন। এর মধ্যে ব্যাংক পরিচালকদের মেয়াদ ও সংখ্যা দুটোই বাড়িয়ে নিয়েছেন। ব্যাংকের করপোরেট কর আগের চেয়ে আড়াই শতাংশ কমিয়ে দেয়া হয়েছে। বিএবির চাহিদা অনুযায়ী সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে রাখা, সিআরআর ১ শতাংশ হ্রাস, ঋণ আমানতের হার (এডিআর) সমন্বয়সীমার সময় বাড়ানো এবং রেপো রেট ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে ৬ শতাংশ করাসহ অন্যান্য আরো অনেক সুবিধা তাদের দেয়া হয়েছে। এর বিনিময়ে ব্যাংকগুলো প্রতিশ্রুতি দেয় তারা ব্যাংকের সুদের হার আমানতের ক্ষেত্রে ৬ শতাংশ এবং ঋণের ক্ষেত্রে ৯ শতাংশ নির্ধারণ করবে। এ জন্য তারা গত বছরের ১ জুলাইকে দিন হিসেবে নির্ধারণ করে। কিন্তু সরকারি ব্যাংক বাদে বেসরকারি কোনো ব্যাংক তখন এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেনি। এরপর চলতি বছরের ২৩ জুলাই ব্যাংক আমানতে ৬ ও ঋণে ৯ শতাংশ সুদহার বাস্তবায়নে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে বলা হয়।
সে দিন সব ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) ডেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক গভর্নরের পক্ষ থেকে এ নির্দেশনা দেয়া হয়। কিন্তু তার পরও বেশির ভাগ বেসরকারি ব্যাংক ঋণের সুদের হার এক অঙ্কে নামিয়ে আনেনি। সর্বশেষ পরিসংখ্যানে, দেখা দেশী-বিদেশী ব্যাংক মিলিয়ে ২৭টি ব্যাংক সুদের হার এক অঙ্কে নামিয়ে আনেনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেছেন, ৬ শতাংশ সুদ দিয়ে আমরা আমানত আনতে পারছি না। এ জন্য ঋণের সুদের হারও ৯ শতাংশ করা সম্ভব হচ্ছে না। তারল্য সঙ্কটের কারণে আমাদের বেশি সুদ দিয়ে আমানত সংগ্রহ করা হচ্ছে।
অন্য দিকে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আজ বৈঠকে ব্যাংকারদের প্রতি একটি কড়া মেসেজ দেয়া হবে। ব্যাংকারদের বলা হবে, তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, ব্যাংকের সুদের হার একটি নির্দিষ্ট সময়ে মধ্যে সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনবে। কিন্তু সেই সময় অনেক আগেই পেরিয়ে গেছে। অনেক ব্যাংক এ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করেনি। আমরা চাইনি এই সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে, এ জন্য তাদের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় দেয়া হতে পারে। বলা হবে ১ জানুয়ারি থেকে বাধ্যতামূলকভাবে ব্যাংকগুলো যেন সুদের হার এক অঙ্কে নামিয়ে আনে। এটি না করা হলে আমাদের বাধ্য হয়ে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে দেয়া সুযোগ সুবিধা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়া হতে পারে বলে তিনি ইঙ্গিত দেন।
এ দিকে নানা তৎপরতার পরও ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ কমানো যাচ্ছে না। উল্টো বেড়ে যাচ্ছে নতুন অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) প্রায় চার হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ বেড়েছে; যা মোট বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ১২ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ৯ লাখ ৬৯ হাজার ৮৮২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে এক লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা; যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ১১ দশমিক ৯৯ শতাংশ। তিন মাস আগে (জুন শেষে) মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল এক লাখ ১২ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা। সে হিসাবে তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপির অঙ্ক বেড়েছে তিন হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা।
গত জানুয়ারিতে দায়িত্ব গ্রহণের পর খেলাপি ঋণ বাড়বে না বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী। ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও জানিয়েছিলেন তিনি। আজ বৈঠকে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার জন্য একটি বিশেষ নির্দেশনা অর্থমন্ত্রী দেবেন বলে জানা গেছে। এ ক্ষেত্রে একটি নতুন ফর্মুলাও দেয়া হতে পারে।