দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: দুর্বলমানের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো একে অপরের সঙ্গে মার্জার বা একীভূতকরণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা তৈরি করছে। ওই নীতিমালার আলোকে দুর্বলমানের ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো একে অপরের সঙ্গে একীভূত হবে। কিছু সূচকের ওপর ভিত্তি করে আগে দুর্বলমানের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করা হবে। পরে তাদের দুর্বলতা কাটানোর জন্য কিছু সময় দেয়া হবে। এতে ব্যর্থ হলে মার্জার করা হবে।

এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আহমেদ জামালের নেতৃত্বে একটি এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে অপর একটি কমিটি কাজ করছে। তারা এ বিষয়ে ইতিমধ্যে একটি নীতিমালার খসড়া তৈরি করে অর্থ মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে। সেটি নিয়ে এখন কাজ হচ্ছে। নীতিমালাটি চূড়ান্ত হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সার্কুলার জারি করে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য তা বাধ্যতামূলক করে দেয়া হবে।

সাম্প্রতিক সময়ে ভারতেও ব্যাংক মার্জারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও ব্যাংক মার্জার হচ্ছে। বাংলাদেশেও এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এক দশক ধরে দেশের আর্থিক খাতে আলোচিত হচ্ছে সিংহভাগ ব্যাংকের দৈন্যতার বিষয়টি। ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণের চাপে পড়ছে দেশের ব্যাংকিং খাত। খেলাপি ঋণের কারণে পড়তে হচ্ছে প্রভিশন ও মূলধন ঘাটতিতে। ভালো পরিচালন মুনাফা করেও শেয়ারহোল্ডারদের প্রত্যাশিত মুনাফা দিতে পারছে না ব্যাংকগুলো। ব্যাংকের চেয়েও নাজুক অবস্থা ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের (এনবিএফআই)। এ পরিস্থিতিতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান একীভূতকরণের দাবি উঠছে বিভিন্ন মহল থেকে।

বিআইবিএমের সাবেক মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমদ চৌধুরী বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মালিক সরকার। এ ব্যাংকগুলোর একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত সরকার নিতে পারে। কিন্তু বেসরকারি ব্যাংকগুলো একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত নিতে হবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের পর্ষদকে। ব্যাংকগুলো নিজ থেকে এগিয়ে না এলে জোর করে একীভূত করে দেয়ার ফল ভালো নাও হতে পারে। সবল ব্যাংক দুর্বল ব্যাংকের দায়িত্ব নিতে চাইবে না। তার চেয়ে বড় সমস্যা ব্যাংকের এক্সিট পলিসি না থাকা। সরকারি-বেসরকারি সব ব্যাংককে লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে দেয়া দরকার। লক্ষ্যপূরণে ব্যর্থ ব্যাংকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা থাকলে পরিস্থিতির কিছুটা হলেও উন্নতি হবে।

বর্তমানে দেশে ৫৯টি তফসিলি ব্যাংক কার্যক্রমে আছে। নতুন নতুন ব্যাংকও এ খাতে যুক্ত হচ্ছে। দেশের অর্থনীতির আকারের তুলনায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এ সংখ্যাকে বেশি বলে মনে করছেন ব্যাংকার ও বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, সিংহভাগ ব্যাংকের সম্পদ ১৫ হাজার কোটি টাকার নিচে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্পদ হাজার কোটি টাকারও কম। এ অবস্থায় পরিচালন ব্যয় নির্বাহেই শেষ হয়ে যাচ্ছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মুনাফা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের ভারও বইতে হচ্ছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে এ খাতকে একীভূতকরণের পথেই হাঁটতে হবে।

ব্যাংকিং খাতে একীভূতকরণের কথা বলা আছে ব্যাংক কোম্পানি আইন-১৯৯১ তেও। আইনের ৪৯(১) ধারায় বলা হয়, কোনো ব্যাংকের অনুরোধক্রমে বাংলাদেশ ব্যাংক একীভূতকরণ প্রস্তাবে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা রাখতে পারে। একইভাবে আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন-১৯৯৩-এর বিধান অনুযায়ীও বাংলাদেশ ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের একীভূতকরণে সহায়তা করার ক্ষমতা রাখে।

উভয় আইনের বিধান বাস্তবায়নে দুর্বল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে একীভূতকরণের জন্য ২০০৭ সালে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আর্থিক খাতের একীভূতকরণ প্রক্রিয়া পর্যালোচনা করে নীতিমালটি প্রণয়ন করা হয়েছিল। গাইডলাইনস ফর মার্জার/অ্যামালগামেশন অব ব্যাংকস/ফিন্যান্সিয়াল ইন্সটিটিউশনস শীর্ষক এ নীতিমালায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর একীভূতকরণ প্রক্রিয়ার বিষয়ে বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে।

নীতিমালা অনুযায়ী, একটি ব্যাংক অন্য ব্যাংকের সঙ্গে, একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একীভূত হতে পারবে। যে কোনো ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে কিংবা বিশেষ ক্ষেত্রে আর্থিক প্রতিষ্ঠান কোনো ব্যাংককে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনসাপেক্ষে অধিগ্রহণ করতে পারবে। তবে যে কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত আসতে হবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের পর্ষদ থেকে। এক্ষেত্রে শেয়ারহোল্ডারদের অনুমোদনও থাকতে হবে।

একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের একটি ‘ডিউ-ডিলিজেন্স’ প্রতিবেদন তৈরি করতে হবে। প্রতিবেদনে প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্পদ ও দায়ের বিস্তারিত পরিসংখ্যান তুলে ধরা হবে। ডিউ-ডিলিজেন্সের প্রতিবেদনটি বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দিতে হবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দিতে হবে একীভূত হতে যাওয়া নতুন ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিকল্পনাও।

বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিবেদনগুলোর যথার্থতা পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্পদ ও দায়ের মূল্যমান নির্ধারণ করবে। বাংলাদেশ ব্যাংক একীভূতকরণের চূড়ান্ত অনুমোদন দিলে উচ্চ আদালতে পিটিশন করতে হবে। আদালতের নির্দেশেই চূড়ান্ত বিচারে যে কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের একীভূতকরণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে।

ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান একীভূতকরণ-বিষয়ক নীতিমালাটি প্রণয়ন করার সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন- মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়াসহ স্বল্পোন্নত ও উন্নত দেশগুলোর ব্যাংক একীভূতকরণ নীতিমালা পর্যালোচনা করেই দেশের জন্য নীতিমালাটি তৈরি করেছিলাম। তবে এখনও তার বাস্তবায়ন শুরু হয়নি। রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবেই ব্যাংক একীভূত হচ্ছে না।

অথচ দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সিংহভাগই দুর্বল হয়ে ধুঁকছে। অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের আমানত ফেরত দিতে পারছে না। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে জনগণের পকেটের অর্থ দিয়ে মূলধন জোগান দেয়া হচ্ছে। এ তালিকায় নতুন করে বেসরকারি ব্যাংকও যুক্ত হয়েছে।

২০০৯ সালে সরকারি খাতর দুটি বিশেষায়িত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা ও বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক একীভূত করে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড (বিডিবিএল) গঠিত হয়। এরপর দেশের কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান এ পথে হাঁটেনি। তবে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংককে একীভূত করার প্রস্তাব দিয়েছে বিশ্বব্যাংক।