মোবারক হোসেন, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: নানামুখী গুজব ছড়িয়ে পুঁজিবাজার অস্থিতিরতার নেপেথ্যে কারা এ প্রশ্ন এখন বিনিয়োগকারীদের মুখে মুখে। সরকারের নানা আন্তরিকতার ফলে বাজার স্থিতিশীল হচ্ছে না। বরং বাজার আজ ভাল তো কাল খারাপ। এ অবস্থার মধ্যে দিনের পর দিন অতিবাহিত হচ্ছে। ২০১৭ সালের শুরুতে অনেকটাই আশাবাদী ছিলেন পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীরা। কিন্তু বছর শেষে হতাশ বিরাজ করছে। সেই হতাশার বিরাজ আজও চলছে।

তবে সরকারের নানামুখী আন্তরিকতার ফলে পুঁজিবাজার স্থিতিশীল হচ্ছে না। পুঁজিবাজারে একটি সিন্ডিকেট চক্র বাজারকে অস্থিতিশীল করতে নানা গুজব ছড়াচ্ছে। এ অস্থিতিশীলতার নেপেথ্যে শীর্ষ সিকিউরিটিজের কয়েকজন উধ্বর্তন কর্তৃপক্ষ জড়িত।

বাজার বিশ্লেষনে দেখা যাচ্ছে, পুঁজিবাজারে কেমন যেন এক ভূতুড়ে পরিবেশ বিরাজ করছে। কিছুতেই ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না দেশের পুঁজিবাজার। গতি ফেরাতে নানা ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়ার পরও পুঁজিবাজার এক কঠিন সময় পার করছে। গত কয়েক মাসের পতনে সূচক নেমে গেছে সাড়ে ৪ হাজার পয়েন্টের ঘরে। আর লেনদেনেও দেখা দিয়েছে দৈন্যদশা। বাজারের এমন আচরণে শঙ্কিত বিনিয়োগকারীরা

। কেননা গত কয়েক মাসের পতনে প্রায় ৩০-৫০ শতাংশ পুঁজি হারিয়ে হাহাকার করছেন তারা। এমনকি লভ্যাংশ ও ইপিএসের মৌসুমের পরও সূচকের অবস্থান কয়েক বছরের সর্বনিম্নে চলে এসেছে। এমনকি বেশীরভাগ কোম্পানির শেয়ার দর এযাবৎ কালের সর্বনিম্নে অবস্থান করছে। বিনিয়োগকারীরা বলছেন, সূচকে এমন বড় পতন ঘটানোর পেছনে কারসাজি চক্র বা গ্যাম্বলারদরে হাত রয়েছে! সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ঠকানোর দুর্দান্ত কৌশল হিসেবে তারা এখন বাজার ফেলে দিচ্ছে। মূলত মার্কটে ফলে দিয়ে কম দাম শেয়ার কিনে নেয়াই তাদের আসল উদ্দেশ্য।

এজন্যই নানা ইস্যু কাজে লাগিয়ে গুজব ছড়িয়ে পুঁজিবাজারকে অস্থিরতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আর এ কৌশলের কাছে প্রতিনিয়ত মার খাচ্ছি আমরা। তবে এটা দেখার মত কেউ পুঁজিবাজারে আছে বলে মনে হয় না! মূলত নিয়ন্ত্রকরা এ সমস্ত কারণেই সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে মানুষ ব্যাংকে কম সুদে অর্থ ফেলে রাখলেও পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করার সাহস পান না। কারণ ব্যাংকে অর্থ রাখলে পুঁজির নিশ্চয়তা আছে। কিন্তু পুঁজিবাজারে সে নিশ্চয়তা নেই।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিয়ন্ত্রকদের নানাবিধ সংস্কারে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে যে উদ্দীপনা তৈরি হয়েছিল তা পূরণ না হওয়ায় হতাশা তৈরি হয়েছে। নতুন নতুন খবরেও কাজ না হওয়ায় বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ প্রতিনিয়ত কমছে। পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান আইসিবিও মাঝে মাঝে মন্দা বাজারে শেয়ার বিক্রি করে। মূলত প্রাতিষ্ঠানিকদের শুভ দৃষ্টি না থাকার সঙ্গে যোগ হয়েছে কারখান বন্ধসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের রেড জোনো থাকার খবর, যা টানা দরপতনকে উসকে দিয়েছে।

এছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিশ্রেণির বড় বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে সক্রিয় নেই। আইপিও আইন সংশোধনসহ নানা ইস্যুতে তারা বাজার পর্যবেক্ষণ করছেন। বিনিয়োগে নেই বিদেশিরাও। ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা সিদ্ধান্ত নিতে হিমশিম খাচ্ছেন। এরই নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে সার্বিক বাজারে। যা বিনিয়োগকারীদের হতাশার বহিঃপ্রকাশ বলেও মনে করছেন তারা।

এদিকে, বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবসে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) সূচকের পতনে শেষ হয় লেনদেন। গতকাল লেনদেনের শুরুতে উত্থান থাকলেও ৪৫ মিনিট পর সৃষ্ট বিক্রয় চাপে টানা নামতে থাকে সূচক। গতকাল লেনদেন শেষে সূচকের পাশাপাশি কমেছে বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ার দর। আর টাকার অংকেও লেনদেন আগের দিনের তুলনায় কিছুটা কমেছে। দিনশেষে ডিএসইর ব্রড ইনডেক্স আগের দিনের চেয়ে ৭৫ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ৪৫৯৬ পয়েন্টে। আর ডিএসই শরিয়াহ সূচক ১৪ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ১০৪১ পয়েন্টে এবং ডিএসই ৩০ সূচক ২২ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ১৫৮৩ পয়েন্টে।

দিনভর লেনদেন হওয়া ৩৫৩টি কোম্পানি ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মধ্যে দর বেড়েছে ৫৩টির, কমেছে ২৭৩টির এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ২৭টির। আর দিন শেষে লেনদেন হয়েছে ৩৪৯ কোটি ১ লাখ ৪৩ হাজার টাকা। এর আগের কার্যদিবস দিন শেষে ডিএসইর ব্রড ইনডেক্স ৩১ পয়েন্ট কমে অবস্থান করে ৪৬৭১ পয়েন্টে। আর ডিএসই শরিয়াহ সূচক ৫ পয়েন্ট কমে অবস্থান করে ১০৫৫ পয়েন্টে এবং ডিএসই ৩০ সূচক ১১ পয়েন্ট কমে অবস্থান করে ১৬০৫ পয়েন্টে। আর ওইদিন লেনদেন হয়েছিল ৪৩২ কোটি ৪১ লাখ ৯৪ হাজার টাকা। সে হিসেবে গতকাল ডিএসইতে লেনদেন কমেছে ৮৩ কোটি ৪০ লাখ ৫১ হাজার টাকা।

অন্যদিকে, দিনশেষে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) সাধারণ মূল্যসূচক ১৩৭ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ৮ হাজার ৪৮৫ পয়েন্টে। দিনভর লেনদেন হওয়া ২৩৯টি কোম্পানির ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মধ্যে দর বেড়েছে ৩৭টির, কমেছে ১৮৬টির এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ১৬টির। আর দিন শেষে লেনদেন হয়েছে ১৪ কোটি ২৫ লাখ ৫৭ হাজার টাকা।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুঁজিবাজারে সূচকের ওঠানামা স্বাভাবিক। এখানে কেউ লাভবান হন, কেউবা লোকসানে পড়েন। তবে ধৈর্য ধরলে এখানে পুঁজি হারানোর সম্ভাবনা কম। আর বাজারে লেনদেন করতে হবে সুস্থিরভাবে। বিনিয়োগকারীদের অস্থিরতায় বাজারও অস্থির আচরণ করে। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের বাজারের নিয়ন্ত্রক বলা যায়। কারণ তারা সবসময় বড় অংকের বিনিয়োগ করে। আর বাজারে সূচকের ওঠানামা অনেকটা প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়। কারণ তাদের বড় অংকের বিনিয়োগ সূচকের উত্থানে মূল ভূমিকা রাখে। তারা সবসময় সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করেই সুনির্দিষ্ট শেয়ারে দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ করে থাকে। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা বাজারের স্থায়ী অংশীদার।

বাজার ভালো হলেই তারা থাকবে আর মন্দাবাজারে পুঁজি তুলে নেবে এটা তাদের ধর্ম নয়। কৌশলে বাজার ফেলে দেয়াও তাদের কাজ নয়। তারা দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করবে। ক্যাপিটাল গেইনসহ ডিভিডেন্ডই হবে তাদের মূল লক্ষ্য। কিন্তু বর্তমান বাজারের গতি বিশ্লেষণে মনে হচ্ছে, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা হাত গুটিয়ে বসে রয়েছে। আর বড় বিনিয়োগ না থাকার কারণেই বাজার পড়ছে বলে মনে করছেন অনেকেই। কারণ সবারই একটা ধারণা ছিল যে, নানবিধ সংশোধনে বাজার ঘুরে দাঁড়াবে। কিন্তু তারপরও এমন দরপতন অপ্রত্যাশিত বলেও মনে করছেন ওই বিশ্লেষকরা।