দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা : দেশের উন্নয়নে বিভিন্ন মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন ও কর্মচারীদের বেতন-ভাতাসহ নানা খাতের ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে সরকার। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় রাজস্ব আয় কমে যাওয়ায় ঋণ করেই এই ব্যয় মেটাতে হচ্ছে সরকারকে। ফলে ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে সরকারের ঋণ। চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত দেশের ব্যাংক ব্যবস্থা, সঞ্চয়পত্র ও বিদেশি উৎস থেকে নেওয়া সরকারের ধারের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় সোয়া ৯ লাখ কোটি টাকা। আর গত সাড়ে তিন বছরে বিভিন্ন উৎস থেকে সরকারের ঋণ বেড়েছে প্রায় ৭০ শতাংশ। এর ফলে মাথাপিছু ঋণের বোঝা যেমন বাড়ছে, তেমনি ব্যাংকেও তারল্য সংকট বাড়ছে।
চলতি অর্থবছর বাজেটের আকার প্রায় সোয়া পাঁচ লাখ কোটি টাকা। এই বাজেট বাস্তবায়নে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডÑএনবিআরকে ৩ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা সংগ্রহ করতে হবে। কিন্তু এনবিআর লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারছে না। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ছিল ৮৫ হাজার ৩১৭ কোটি টাকা। এই সময়ে শুল্ক-কর আদায় হয়েছে ৬৫ হাজার ৯৬ কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে ঘাটতি রয়েছে ২০ হাজার ২২০ কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৫০ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি ছিল। এ ঘাটতি মোকাবিলায় সরকারকে বিভিন্ন উৎস থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে ঘাটতি (অনুদান বাদে) ধরা হয় ১ লাখ ৪৫ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা। ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক থেকে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা, সঞ্চয়পত্র থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা ও বিদেশি উৎস থেকে ৬৮ হাজার ১৬ কোটি টাকা নেওয়ার কথা জানিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। রাজস্ব আয়ে বড় ধরনের ঘাটতি থাকায় এক বছরে সরকার ব্যাংক খাত থেকে যে ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল, অর্থবছর শুরুর মাত্র পাঁচ মাসেই তার ৯০ শতাংশ নিয়ে ফেলেছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ২৬ নভেম্বর পর্যন্ত সরকার ব্যাংক থেকে ৪৩ হাজার কোটি টাকা ধার নিয়েছে, যা ব্যাংকিং খাতের তারল্য সংকট আরও বাড়িয়েছে।
এদিকে সরকারের ঋণ বেড়ে যাওয়ায় বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ কমে গেছে। অক্টোবরে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ নেমে এসেছে ১০ শতাংশে, যা গত ৯ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি উৎস থেকে সরকারের মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ৫ লাখ ৪৪ হাজার ৮৫১ কোটি টাকা। আর ২০১৮-১৯ হিসাব বছর শেষে এ ঋণের মোট পরিমাণ দাঁড়ায় ৮ লাখ ৭৩ হাজার ২৩৫ কোটি টাকা। চলতি বছরের ২৬ নভেম্বর পর্যন্ত সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে প্রায় ৪৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। আর অর্থবছরের প্রথম চার মাসে সঞ্চয়পত্র থেকে ৫ হাজার ৫১২ কোটি টাকা ধার করেছে। এ হিসেবে চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত সরকারের মোট ঋণ দাঁড়িয়েছে ৯ লাখ ২১ হাজার ৭৪৭ কোটি টাকা। দেশের জনসংখ্যা যদি ১৬ কোটি ধরা হয়, তাহলে বর্তমানে মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে ৫৭ হাজার ৬১১ কোটি টাকা, যা ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ছিল ৩৪ হাজার ৫৩ কোটি টাকা।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছর পর্যন্ত ব্যাংক খাত থেকে ট্রেজারি বিল ও বন্ডের মাধ্যমে সরকারের ঋণের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। আর চলতি অর্থবছরের পাঁচ মাসেই এ খাতের ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ২১ দশমিক ৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের নভেম্বর শেষে ব্যাংক খাত থেকে সরকারের ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৪২ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্রে সরকারের ধারের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৪০ হাজার ২৬৩ কোটি টাকা, যা চলতি বছরের অক্টোবর শেষে ২ লাখ ৯৪ হাজার ৭৮০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। একই সময়ে বিদেশি ঋণ ২ লাখ ৫০ হাজার ৯২৭ কোটি টাকা থেকে ৩ লাখ ৮৪ হাজার ৬০৪ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। এ সময়ে ৫৩ শতাংশের বেশি বেড়েছে বিদেশি ঋণ।
ব্যাংক থেকে সরকারের অব্যাহত ঋণ গ্রহণের ফলে সুদহারও বেড়ে যাচ্ছে। ২০১৮ সালের ১৫ জানুয়ারি ৩৬৪ দিনের ট্রেজারি বিলের সুদহার ছিল ৪.২৫ শতাংশ, যা বর্তমানে প্রায় ৮ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। আবার সরকারের ঋণ নেওয়ার এই প্রবণতায় ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকট আরও বেড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকার উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য ব্যাংকির খাতের বাইরে বিকল্প অর্থায়নের উৎস সন্ধান করছে। বন্ড ছেড়ে অর্থ সংগ্রহের পরিকল্পনা করছে। আগামী ১৮ ডিসেম্বর অর্থ উপদেষ্টা মশিউর রহমানের সভাপতিত্বে এ সংক্রান্ত সভা হবে।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে ঋণের সুদবাবদ সরকারকে ৫৭ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখতে হয়েছে, যা মোট বাজেটের প্রায় ১১ শতাংশ। সরকারের ঋণের পরিমাণ বাড়ায় বাজেটে চাপ আরও বাড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে কথা হয় বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুরের সঙ্গে। দেশ রূপান্তরকে তিনি বলেন, ধারাবাহিকভাবে ঋণ বেড়ে যাওয়ায় সরকারের স্বাধীনভাবে ব্যয় করার সক্ষমতা কমে যাবে। আবার মাথাপিছু ঋণের বোঝাও বাড়বে। সরকারের ঋণগ্রহণের ফলে ব্যাংক থেকে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকার যদি রাজস্ব সংগ্রহে ক্রমান্বয়ে ব্যর্থ হতে থাকে, তাহলে উন্নয়ন নিয়ে সরকারের যে উচ্চাভিলাষ কিংবা এমডিজি বাস্তবায়ন ব্যর্থ হয়ে যাবে। এজন্য সরকারকে রাজস্ব আয় বাড়াতে মনোযোগী হতে হবে। বিশে^র অন্যান্য দেশ যেখানে জাতীয় আয়ের ২০ শতাংশ রাজস্ব আয় করতে পারে, সেখানে আমরা কেন ৯ শতাংশে থাকব, সেটাও সরকারকে ভাবতে হবে।
এ বিষয়ে বিশ^ব্যাংকের ঢাকা অফিসের পরামর্শক ড. জাহিদ হোসেন বলেন, এখন পর্যন্ত সরকারের যে ঋণ তা জিডিপির তুলনায় হয়তো উচ্চ ঝুঁকিতে যায়নি। রাজস্ব আয়ের দুর্বলতার কারণেই ঘাটতি বেড়ে যাচ্ছে। ফলে সরকারের ঋণও বাড়ছে। এতে স্বল্পমেয়াদে যে ঝুঁকি দেখা দিতে পারে, সেটি হচ্ছে ব্যক্তি খাতের ঋণের প্রবাহ কমে যেতে পারে, যা আমরা এখনই দেখছি। আবার সরকার ব্যাপক মাত্রায় ঋণ নেওয়ায় সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনার যে প্রচেষ্টা তা ব্যাহত হবে।
এমন পরিস্থিতিতে যেসব খাতে ব্যয় গুরুত্বপূর্ণ নয়, সরকারকে তা কমিয়ে আনতে হবে বলে মনে করেন জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে এমন অনেক ব্যয় রয়েছে, যেগুলো এখন না করলেও চলে। সরকারকে খেয়াল রাখতে হবে, সরকারের ঋণ যাতে বড় বোঝা হয়ে না যায়। পাশাপাশি ঋণখেলাপি সমস্যা সমাধানে সরকারকে আর্থিক খাতে সংস্কারের কাজটা করতে হবে। বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা দুর্বলতার কারণে তারল্যে যে প্রভাব পড়েছে, তা নিয়েও ভাবতে হবে। তবে এ ঋণের অর্থে যেসব উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে, তা যদি নির্ধারিত সময়ে বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে হয়তো ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে।