দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা : পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর তারল্য সংকট, আস্থাহীনতা, খেলাপি ঋণ ও পরিচালন ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। খরচ বাড়লে বিনিয়োগ ও আয় কমেছে অস্বাভাবিকভাবে। চলতি বছরের ৯ মাসে কর-পরবর্তী নিট মুনাফায় ধস নেমেছে। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় কোম্পানিগুলোর মুনাফা চার ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছে। তবে এই সময়ে ঋণ বিতরণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
তালিকাভুক্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রকাশিত ও বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে এমন চিত্র পাওয়া গেছে। জানা গেছে, বর্তমানে দেশি-বিদেশি সব মিলিয়ে ৩৪টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। এর মধ্যে পিপলস লিজিংকে অবসায়নের (বন্ধ) সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এটিসহ মোট ২৩টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত রয়েছে। তথ্য বিশ্লেষণে পিপলসকে লিজিংকে বাদ রাখা হয়।
বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এনবিএফআইগুলো ঋণ বিতরণ করে ৫৪ হাজার ৪৯৩ কোটি ২০ লাখ টাকার, গত বছরের আলোচিত সময়ে যার পরিমাণ ছিল ৫২ হাজার ৫১৯ কোটি ৩০ লাখ টাকা। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় চলতি বছরে ঋণ বিতরণ বেড়েছে এক হাজার ৯৭৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা। এই সময়ে প্রতিষ্ঠানগুলোয় আমাতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫০ হাজার ১৩৯ কোটি ১০ লাখ টাকা, যা গতবারের তুলনায় এক হাজার ৪৬১ কোটি ৭০ লাখ টাকা কম। এর ফলে মূলধনও কমেছে এ খাতটির।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত বছরের আলোচিত সময়ের তুলনায় এবার ৭৬ শতাংশের বেশি নিট মুনাফা কমেছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর। গত বছরের ৯ মাসে করপরবর্তী মুনাফা ছিল ৫৭২ কোটি ৮০ লাখ টাকা। চলতি বছরের আলোচিত সময়ে হয়েছে ১৩৬ কোটি ৯০ লাখ টাকা, যা গত বছরের আলোচিত সময়ের চেয়ে ৪৩৫ কোটি ৭০ লাখ টাকা কম। এর ফলে পুরো খাতের শেয়ারপ্রতি আয় বা ইপিএসও কম হয়েছে গত বছরের তুলনায়।
আর্থিক খাতের এমন করুণ চিত্র সত্ত্বেও ১০টি প্রতিষ্ঠানের আয়ের প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক ছিল। এর মধ্যে আটটি প্রতিষ্ঠানের আয়ের প্রবৃদ্ধি ১০ থেকে ১৬২ শতাংশ পর্যন্ত হয়েছে।
ইতিবাচক ধারায় থাকা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে আইডিএলসি। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরিফ খান পুরো খাতের চিত্র মূল্যায়ন করে জানান, এই সংকটের কারণ হচ্ছে তারল্য সংকট। একটি প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার সংবাদে পুরো খাতের ওপর প্রভাব পড়েছে। পুঁজিবাজার থেকেও আয় কমেছে আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর। অন্যদিকে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগও কিছুটা দায়ী। ফলে অনেক প্রতিষ্ঠানই উচ্চ সুদে আমানত সংগ্রহ করেছে। এতে সুদ বাবদ খরচ ও পরিচালন ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি হওয়ায় মুনাফার পাশাপাশি কমেছে ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা।
আরিফ খান বলেন, যেসব প্রতিষ্ঠানের সুনাম ও তারল্য সংকট ছিল না, তারা কিন্তু এই সংকটেও ভালো করতে পেরেছে। আইডিএলসির তারল্যর সংকট হয়নি। এ জন্য ব্যবসাও ভালো করতে পেরেছে, সবই সম্ভব হয়েছে আমাদের প্রতিষ্ঠানটির সুনামের জন্য।
পরিস্থিতির উন্নয়নের সম্ভাবনা নিয়ে তিনি বলেন, সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমেছে। এখন তারল্য কিছুটা বৃদ্ধি পাবে। তখন ব্যয় কিছুটা কমে যাবে। প্রতিষ্ঠানগুলোর সুশাসন জোরদারে আরও সচেষ্ট হবে বলে মনে করি। এর প্রভাবে আগামীতে খাতটি ভালো করার সুযোগ রয়েছে।
জানা গেছে, চলতি বছরের ৯ মাসে গত বছরের আলোচিত সময়ের তুলনায় প্রতিষ্ঠানগুলোর সুদ আয় বৃদ্ধি পায়। কিন্তু সুদ ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। চলতি বছরের ৯ মাসে সুদ থেকে আয় হয় পাঁচ হাজার ৩৫৮ কোটি ৩০ লাখ টাকা, গত বছরের আলোচিত সময়ে যা ছিল চার হাজার ৯৩৫ কোটি ৮০ লাখ টাক। অন্যদিকে সুদ বাবদ ব্যয় হয় চলতি বছরে চার হাজার ৬৭১ কোটি টাকা, যা গত বছরের আলোচিত সময়ে ছিল চার হাজার ১৫২ কোটি টাকা।
গত বছরের আলোচিত সময়ে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ১৪ হাজার ২৫২ কোটি ৩০ লাখ টাকা। চলতি বছরে তা কমে দাঁড়ায় ১৩ হাজার ৯৭৫ কোটি ১০ লাখ টাকা। বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় এ খাত থেকে আয় কমেছে প্রায় ২৯ দশমিক ৬২ শতাংশ। গত বছরের আলোচিত সময়ে বিনিয়োগ থেকে আয় হয়েছিল ৭৯৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা। চলতি বছরে তা ২৩৫ কোটি টাকা কমে হয় ৫৫৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা।
গত বছরের তুলনায় এবার খাতটির মোট পরিচালন আয় কমেছে ৩৭১ কোটি ৩০ লাখ টাকা। মোট পরিচালন আয় কমলেও পরিচালন বৃদ্ধি পায় চলতি বছরে। গত বছরের আলোচিত সময়ের তুলনায় এবার পরিচালন ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে ৬৪ কোটি ১০ লাখ টাকা। খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি হওয়ায় এর বিপরীতে গত বছরের তুলনায় ৪০ কোটি টাকা বেশি প্রভিশন রাখতে হয়েছে এসব প্রতিষ্ঠানের।
অন্যদিকে গত সেপ্টেম্বর শেষে এক বছরের তুলনায় দেশের আর্থিক খাতের পরিচালন আয় কমেছে ১৮ শতাংশ হারে। অন্যদিকে ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে সাত শতাংশ হরে। উচ্চ সুদে আমানত সংগ্রহ করায় এ ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানিয়েছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।
কিছুটা তারল্য সংকটে থাকা বে লিজিং অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডও পরিস্থিতি সামলে উঠে মুনাফার প্রবৃদ্ধি বাড়িয়েছে আশাতীতভাবে। এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইফতেখার আলী খান শেয়ার বিজকে বলেন, বে লিজিংয়ের পোর্টফোলিও বাজারের তুলনায় মাঝারি মানের। আমাদের আমানতের পুরোটা ব্যাংকনির্ভর নয়, ব্যাংকবহির্ভূত খাতের আমানতই বেশি। তাই তারল্য সংকটের চাপে খুব একটা পড়তে হয়নি। কোনো গ্রাহকের পাওনা বুঝিয়ে দিতে সমস্যা হয়নি এখনও। এ জন্য মুনাফায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে আশাতীত।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ও অতালিকাভুক্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিতরণকৃত ঋণের আকার প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা। গত জুন শেষে এ খাতের খেলাপি ঋণের হার ১১ শতাংশ, যা গত ডিসেম্বর শেষে ছিল সাত দশমিক ৯ শতাংশ। সাধারণত বছরের শেষের দিকে আর্থিক খাতে খেলাপির হার কমে আসে।