মিজানুর রহমান ও মোবারক হোসেন, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা : পুঁজিবাজার অস্থিতিরতার নেপেথ্যে কারা এ প্রশ্ন এখন বিনিয়োগকারীদের মুখে মুখে। সরকারের নানা আন্তরিকতার ফলে বাজার স্থিতিশীল হচ্ছে না। বরং বাজার আজ ভাল তো কাল খারাপ। এ অবস্থার মধ্যে দিনের পর দিন অতিবাহিত হচ্ছে। ২০১৯ সালের শুরুতে অনেকটাই আশাবাদী ছিলেন পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীরা। জানুয়ারী মাসের শুরুতে বাজার ভাল থাকলেও সে আশায় গুড়াবালি। ফলে টানা দরপতনের পর মাঝে মধ্যে বাজার কিছুটা ঘুরে দাঁড়ালোও এর স্থায়িত্ব বেশি দিন হয়নি। ফের সেই হতাশার বিরাজ আজও চলছে। নিরবচ্ছিন্নভাবে পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে পারছে না। ফলে আশা-নিরাশার দোলাচলে কেটেছে ২০১৯ সালের বছরটি। তার পরও বিনিয়োগকারীরা আশায় বুক বেঁধেছেন।

বিনিয়োগকারীদের প্রশ্ন সরকারও পুঁজিবাজার শক্তিশালী করতে উদ্যোগী নিলেও কেন বাজার অস্থিতিশীল হচ্ছে। পুঁজিবাজারে একটি সিন্ডিকেট চক্র বাজারকে অস্থিতিশীল করতে কাজ করছে। এ অস্থিতিশীলতার নেপেথ্যে শীর্ষ ছয় সিকিউরিটিজের উধ্বর্তন কর্তৃপক্ষ জড়িত। গত এক মাসের দরপতনে শীর্ষ সিকিউরিটিজ হাউজে ক্রয়ের চেয়ে বিক্রয়ের চাপ কয়েকগুন বেশি ছিল। ফলে দরপতন ত্বরান্বিত হচ্ছে। তাই একটি স্থিতিশীল বাজার প্রতিষ্ঠা এখন সর্বস্তরের মানুষের কাম্য। যা বর্তমানে টক অব দ্য কান্ট্রিতে পরিণত হয়েছে। তাছাড়া পুঁজিবাজারে দরপতন থামছে না। ভালো খবরেও সাড়া দিচ্ছেন না বিনিয়োগকারীরা।

এদিকে অব্যাহত বড় দরপতনের কবলে পড়েছে দেশের পুঁজিবাজার। রোববারের ধারাবাহিকতায় সোমবারও দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) এবং অপর পুঁজিবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) সবকটি সূচকের বড় পতন হয়েছে। লাগাতার বড় পতনের ফলে প্রায় সাড়ে তিন বছর পূর্বের অবস্থানে ফিরে গেছে ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচক। সূচকের বড় পতনের সঙ্গে দেখা দিয়েছে লেনদেন খরাও। ফলে ডিএসইর লেনদেন আবারও ২০০ কোটি টাকার ঘরে নেমে এসেছে। এর মাধ্যমে সোমবার প্রায় দুই মাসের মধ্যে বাজারটিতে সর্বনিন্ম লেনদেন হয়েছে।

এদিকে টানা পুঁজিবাজার দরপতনের শেষ কোথায়, আর কত প্রণোদণা দরকার। এ কথা এখন ২৮ লাখ বিনিয়োগকারীদের মুখে মুখে। দেশের পুঁজিবাজার কোন প্রণোদনাই মাথা তুলে দাঁড়াতেই পারছে না। টানা দরপতনে বিনিয়োগকারীদের মুল পুঁজি দিনের পর দিন নি:স্ব হতে চলছে। এমন অবস্থা চলছে যে পুঁজিবাজার অবিভাবকহীন। বিনিয়োগকারীদের প্রশ্ন আর কতদিন এ ভাবে চলবে। এ ভাবে চলতে থাকলে বাজার বিমুখ হয়ে পড়বে বিনিয়োগকারীরা।

এদিকে একদিকে অস্থিতিশীল পুঁজিবাজার অন্যদিকে দরপতনে উস্কে দিয়েছে শীর্ষ ছয় ব্রোকারেজ হাউজ। লংকাবাংলা সিকিউরিটিজ, ইবিএল সিকিউরিটি, ইউসিবি ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড, এমটিবি সিকিউরিটিজ এবং ব্র্যাক ইপিএলস্টক ব্রোকারেজ হাউজসহ ছয়টি ব্রোকারেজ হাউজের অব্যাহত শেয়ার বিক্রির চাপে গত কয়েকদিনে শেয়ারবাজারে বড় ধরনের ধস হয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে দফায় দফায় বিক্রির চাপ আসায় গত রোববার লেনদেনের প্রথম ঘণ্টা পার না হতেই সূচকে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে থাকে। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে বাজারে পতনের প্রবণতা।

গত রোববারের ন্যায় সোমবারও শেয়ারবাজারের এই ধসে পড়ার পেছনে ছয়টি ব্রোকারেজ হাউজের বিক্রির চাপ বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে। এর মধ্যে গত রোববার সব থেকে বেশি বিক্রির চাপ এসেছে লংকাবাংলা সিকিউরিটিজ লিমিটেড থেকে। ব্রোকারেজ হাউজটি থেকে ১৯ কোটি ৮০ লাখ ৬৮ হাজার টাকার বিক্রি করা হয়েছে। বিপরীতে কেনা হয়েছে ১৫ কোটি ৫৪ লাখ ২৩ হাজার টাকা। অর্থাৎ লংকাবাংলা সিকিউরিটিজ থেকে ক্রয়ের চেয়ে বিক্রি বেশি করা হয়েছে ৪ কোটি ২৬ লাখ ৪৪ হাজার টাকা।

টাকার অঙ্কে ক্রয় থেকে বিক্রি বেশি হওয়ার দিক থেকে লংকাবাংলার পরই রয়েছে ইবিএল সিকিউরিটিজ। এই ব্রোকারেজ হাউজটি থেকে ক্রয়ের চেয়ে বিক্রি বেশি হয়েছে ৪ কোটি ১৮ লাখ ৮৮ হাজার টাকা। হাউজটি থেকে ১৩ কোটি ৯৬ লাখ ৩৬ হাজার টাকা বিক্রির বিপরীতে ক্রয় করা হয়েছে ৯ কোটি ৭৭ লাখ ৪৭ হাজার টাকা।

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত রোববার ইউসিবি ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড থেকেও এদিন অত্যধিক বিক্রির চাপ ছিল। প্রতিষ্ঠানটি থেকে ১৪ কোটি ৫৪ লাখ ১৪ হাজার টাকার শেয়ার ও ইউনিট বিক্রি করা হয়েছে। বিপরীতে কেনা হয়েছে ১১ কোটি ৯৬ লাখ ১৯ হাজার টাকা। অর্থাৎ ক্রয় থেকে বিক্রি বেশি হয়েছে ২ কোটি ৫৭ লাখ ৯৪ হাজার টাকা। ক্রয় থেকে বিক্রি বেশি হওয়া অন্য ব্রোকারেজ হাউজগুলোর মধ্যে এমটিবি সিকিউরিটিজ থেকে এদিন ৮ কোটি ৭৬ লাখ ৯৩ হাজার টাকার শেয়ার ও ইউনিট বিক্রি করা হয়েছে। বিপরীতে কেনা হয়েছে ৫ কোটি ৮৪ লাখ ৭২ হাজার টাকা। এ হিসাবে ক্রয় থেকে বিক্রি বেশি হয়েছে ২ কোটি ৯২ লাখ ২০ হাজার টাকা।

বিডিএস থেকে ৭ কোটি ৬৫ লাখ ৪৫ হাজার টাকার শেয়ার ও ইউনিট বিক্রির বিপরীতে ৫ কোটি ৫৬ লাখ ৭৭ হাজার টাকার কেনা হয়েছে। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটির কেনার থেকে বিক্রি বেশি ২ কোটি ৮ লাখ ৬৭ হাজার টাকা। ক্রয় থেকে বিক্রি বেশি করা আরেক প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক ইপিএল স্টক ব্রোকারেজ থেকে ৮ কেটি ৪৮ লাখ ৮১ হাজার টাকা বিক্রির বিপরীতে কেনা হয়েছে ৭ কোটি ৭৯ লাখ ৯৭ হাজার টাকা। এ প্রতিষ্ঠানটি থেকে বিক্রি বেশি হয়েছে ৬৮ লাখ ৮৪ হাজার টাকা।

ইবিএল সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ছায়েদুর রহমান বলেন, কাস্টমার (গ্রাহক) বিক্রি করলে আমি তো না করতে পারব না। আমার ডিলার হিসাব থেকে বিক্রি হয়েছে কিনা এটা দেখেন। তিনি বলেন, শেয়ারবাজারে দরপতনের আমি দৃশ্যমান কোনো কারণ দেখি না। বাজারে বিক্রির চাপ ছিল বলেও আমি মনেকরি না। লেনদেন হয়েছে সাড়ে তিনশ কোটি টাকা। এখানে বিক্রির চাপ কোথায় দেখলেন?

তিনি আরও বলেন, এই বাজারে বিক্রি করে কেন লোকসান করবে, আমি তার কোনো কারণ দেখি না। এই বাজারে কেউ নিশ্চয় প্রফিটেবল (লাভজনক) অবস্থায় নেই। আমার মনে হয় এটি বিনিয়োগকারীদের সাইকোলজিক্যাল (মনস্তাত্বিক) সমস্যা। সাড়ে তিনশ কোটি টাকার লেনদেনে সূচক ৭৫ পয়েন্ট পড়ে যাওয়া কোনোভাবেই যুক্তিসঙ্গত বলা যায় না।

একটি সূত্র জানায়, বিশেষ একটি গোষ্ঠী বিশেষ উদ্দেশ্যে শেয়ারবাজারের দরপতনকে উস্কে দিচ্ছে। ওই গোষ্ঠীটি বড় বড় ব্রোকারেজ হাউজে গিয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সামনে আরও বড় পতন হবে বলে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের শেয়ার ছেড়ে দিতে প্রলুব্দ করছেন। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এক ধরনের অজানা আতঙ্ক সৃষ্টি হচ্ছে।

সূত্রটি জানায়, এ গুজুবের সাথে কয়েকটি ব্রোকারেজ হাউজের প্রধান নির্বাহীরাও জড়িত। এছাড়া সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে নানা ষড়যন্ত্র করছে। এ বিষয় নিয়ন্ত্রক সংস্থার এখনই তদন্ত করা উচিত।

নাম প্রকাশে অনিশ্চিুক এক সিকিউরিটিজ হাউসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ব্যক্তি বিনিয়োগকারীদের বেশিরভাগ বড় বিনিয়োগকারীর পরামর্শে শেয়ার কেনাবেচা করেন। বড় বিনিয়োগকারীদের অনেকেটাই নিস্কিয়। এর কারণ আর্থিক খাতের বড় ধরনের টানাপড়েন। বড়দের থেকে দিকনির্দেশনা না থাকায় ছোট বিনিয়োগকারীরা অনেকে হাত গুটিয়ে আছেন। আবার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে চলতি দরপতনে অনেক বিনিয়োগকারী বড় লোকসানে পড়েছেন। এরা নতুন করে শেয়ার কেনাবেচা করতে পারছেন না। এ কারণে লেনদেন কমছে। বড় বিনিয়োগকারীদের নিস্কিয়তার ক্ষেত্রে ব্যাংক খাতে সংকট নিয়ে বিভিন্ন খবরকে দায়ী করছেন বাজার-সংশ্নিষ্টরা। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা এখন বড় বিনিয়োগে আসেনি। এমনটি জানিয়েছেন অপর এক মার্চেন্ট ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তা।

এ প্রসঙ্গে মশিউর সিকিউরিটিজ বিনিয়োগকারী আবদুল কালাম বলেন, আমরা যারা শেয়ার ব্যবসা ছাড়া অন্য কিছু করি না তাদের মন পড়ে থাকে পুঁজিবাজারে। সে কারণে প্রতিদিন হাউজে আসি। প্রতিদিনই ভাবি বাজার ঘুরে দাঁড়াবে। কিন্তু হচ্ছে তার উল্টো। প্রতিদিনই লাভের বদলে লোকসানের হিসাব কষতে হচ্ছে। এ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে পরিস্থিতি আরও করুণ হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এ বিষয় জানতে চাইলে সাবেক তত্ত¡াবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এবি মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে পরিস্থিতি বাজার পতনের কোনো কারণ দেখতে পাচ্ছি না। এ পতনের কোনো যুক্তিগত কারণ আছে বলেও মনে করি না।