দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা : খেলাপি ঋণ আর তারল্য সংকটে ভুগতে থাকা ব্যাংক খাতের সম্পদের পরিমাণ প্রতিনিয়ত বাড়ছে। চলতি বছরের জুলাই, আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বর- এ তিন মসে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর সম্পদের পরিমাণ সম্মিলিতভাবে বেড়েছে ১৫ হাজার কোটি টাকার ওপরে। আর জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর- এ নয় মাসে বেড়েছে পৌনে এক লাখ কোটি টাকা।অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সম্পদের পরিমাণ বাড়লেও সার্বিকভাবে ব্যাংক খাত সংকটের মধ্যে রয়েছে। ব্যাংকের এ সংকটের অন্যতম কারণ খেলাপি ঋণ। হু হু করে খেলাপি ঋণ বাড়ার কারণে দিন যত যাচ্ছে ব্যাংকের সংকট তত ভয়াবহ হয়ে উঠছে। থমকে পড়ছে বেসরকারি বিনিয়োগ।তাদের মতে, ব্যাংক খাতের পরিস্থিতি দেশের সার্বিক অর্থনীতির ওপর চাপ সৃষ্টি করবে। বিনিয়োগের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বাধাগ্রস্ত হবে কর্মসংস্থান। সেই সঙ্গে প্রবৃদ্ধির ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ার শঙ্কা রয়েছে।নিয়ম অনুযায়ী, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোকে প্রতি তিন মাস পরপর আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করতে হয়। এরই আলোকে তালিকাভুক্ত ৩০টি ব্যাংক চলতি বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে তাদের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।ব্যাংকগুলোর ওই আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে তালিকাভুক্ত ছয়টি ব্যাংকের সম্পদের পরিমাণ চলতি বছরের জুনের তুলনায় কমে গেছে। বিপরীতে ২৩টি ব্যাংকের সম্পদের পরিমাণ কিছুটা বেড়েছে। আর ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের তথ্য পাওয়া যায়নি।জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে সম্পদের পরিমাণ কমে যাওয়া ছয় ব্যাংকের মধ্যে রয়েছে- আইসিবি ইসলামী ব্যাংক, দি সিটি ব্যাংক, যমুনা ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক।ব্যাংকগুলোর দেয়া তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ২৯টি ব্যাংকের সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে নয় লাখ ৫৪ হাজার ৪৪৫ কোটি নয় লাখ ২৪ হাজার টাকা। যা গত জুন শেষে ছিল নয় লাখ ৩৮ হাজার ৪৭৫ কোটি ৭৯ হাজার টাকা। এ হিসাবে তিন মাসে সম্মিলিতভাবে ব্যাংকের সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে ১৫ হাজার ৯৭০ কোটি আট লাখ ৪৬ হাজার টাকা। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকগুলোর সম্পদের পরিমাণ ছিল আট লাখ ৭৯ হাজার ৭৪৬ কোটি ৩০ লাখ ২৩ হাজার টাকা। এ হিসাবে চলতি বছরের নয় মাসে ২৯টি ব্যাংকের সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে ৭৪ হাজার ৬৯৮ কোটি ৭৯ লাখ টাকা।সম্পদের দিক থেকে বরাবরের মতো সবার ওপরে রয়েছে ইসলামী ব্যাংক। ব্যাংকটির সম্পদের পরিমাণ এক লাখ নয় হাজার ৩১৮ কোটি ৭৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা। গত জুন শেষে ব্যাংকটির সম্পদের পরিমাণ ছিল এক লাখ পাঁচ হাজার ৯৩৬ কোটি ৬৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা। অর্থাৎ তিন মাসে ব্যাংকটির সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে তিন হাজার ৩৮২ কোটি ১৫ লাখ ৪৮ হাজার টাকা।তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে সম্পদের দিক থেকে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে রূপালী ব্যাংক। প্রতিষ্ঠানটির সম্পদের পরিমাণ ৪৭ হাজার ৪২৭ কোটি ৮৮ লাখ ২৯ হাজার টাকা। গত জুন শেষে এ সম্পদের পরিমাণ ছিল ৪৬ হাজার ৩৯৭ কোটি ৬৮ লাখ ৫১ হাজার টাকা। এ হিসাবে তিন মাসে ব্যাংকটির সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে এক হাজার ৩০ কোটি ১৯ লাখ ৭৮ হাজার টাকা।সম্পদের দিক থেকে তৃতীয় স্থানে রয়েছে পূবালী ব্যাংক। প্রতিষ্ঠানটির সম্পদের পরিমাণ ৪৫ হাজার ২৬১ কোটি ৫১ লাখ ৭৩ হাজার টাকা। গত জুন শেষে সম্পদের পরিমাণ ছিল ৪৪ হাজার ৩৭০ কোটি ৫৮ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। এ হিসাবে তিন মাসে ব্যাংকটির সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে ৮৯০ কোটি ৯৩ লাখ ২৯ হাজার টাকা। জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে সম্পদের পরিমাণ কমলেও এখন সম্পদের দিক থেকে শীর্ষ চারে রয়েছে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক। প্রতিষ্ঠানটির সম্পদের পরিমাণ ৪৩ হাজার আট কোটি ২৭ লাখ ৬৮ হাজার টাকা। গত জুন শেষে ব্যাংকটির সম্পদের পরিমাণ ছিল ৪৩ হাজার ৪৫১ কোটি ৩৩ লাখ ৯০ হাজার টাকা। এ হিসাবে তিন মাসে ব্যাংকটির সম্পদের পরিমাণ কমেছে ৪৪৩ কোটি ছয় লাখ ২২ হাজার টাকা।এদিকে, সম্পদের পরিমাণ বাড়লেও প্রতিনিয়ত ব্যাংক খাতে বাড়ছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কী পরিমাণ ঋণ খেলাপি রয়েছে সে তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে জুন শেষে অবলোপন বাদে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে প্রায় এক লাখ ১২ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা। অবলোপনসহ খেলাপি ঋণের পরিমাণ দেড় লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। আগের বছরের জুন পর্যন্ত অবলোপন বাদে খেলাপি ঋণ ছিল ৯০ হাজার ৩৭২ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা।এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ব্যাংক খাতের অবস্থা খারাপ। ব্যাংকের প্রধান সমস্যা খেলাপি ঋণ। খেলাপি ঋণের সমস্যার সমাধান করা না গেলে ব্যাংক খাতের সমস্যা সমাধান হবে না। ক্রমেই খেলাপি ঋণ বাড়ছে।তিনি বলেন, নিঃসন্দেহে ব্যাংক খাত সংকটের মধ্যে রয়েছে। ইতোমধ্যে আমাদের সামনে ব্যাংকের সংকট প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। এই পরিমাণ খেলাপি ঋণ নিয়ে একটি দেশের ব্যাংকিং সিস্টেম চলতে পারে না। ফলে দেখা যাচ্ছে, ব্যাংকের ওপর মানুষের আস্থা কমে গেছে। যার কারণে আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। ব্যাংকের এ অবস্থার কারণে সার্বিক অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না। কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব হবে না।বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রতিনিয়ত ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বাড়ছে। এতে ব্যাংকের মুনাফা ও সম্পদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।‘একদিকে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বাড়ছে, অন্যদিকে ব্যাংক নতুন করে ঋণ দিতে পারছে না। সব মিলিয়ে ব্যাংক সমস্যার মধ্যে রয়েছে। ব্যাংকের সমস্যার কারণে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে। এতে অর্থনীতির ওপর এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কারণ ব্যাংক সমস্যার মধ্যে থাকলে বিনিয়োগ ও উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হবে। উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হলে কর্মসংস্থান হবে না। কর্মসংস্থান না হলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাবে।