মোবারক হোসেন ও এফ জাহান, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা : পুঁজিবাজারে অব্যাহতভাবে প্রায় প্রতিদিনই সূচকের বড়ো পতন হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে চরম হতাশার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। এ হতাশা তাদেরকে আতঙ্কিত করছে এই ভেবে যে, কোথায় গিয়ে ঠেকবে পুঁজিবাজার। বাজারের এমন পরিস্থিতিতে শুধু বিনিয়োগকারীই নয় ডিএসইর (ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ) পরিচালকরাও হতাশ।

তাই বিপদগ্রস্ত এ বাজারের অবস্থা কী ভাবে ভালো করা যায় সে বিষয়ে ডিএসইর পরিচালনা পর্ষদ অর্থমন্ত্রী ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করবেন। তবে কবে হবে সে বৈঠক সে বিষয়ে এখনো জানানো হয়নি। অর্থমন্ত্রী যখন সময় দেবেন তখনই বৈঠক হবে এমনটা জানা গেছে।

এদিকে ৪১ মাসের মধ্যে সর্বনিন্ম অবস্থানে রয়েছে ডিএসই সূচক। ধারাবাহিক দরপতনে প্রতিদিনই সূচক সর্বনিন্ম অবস্থানে চলে যাচ্ছে। গতকাল রোববারও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সব ধরনের মূল্য সূচকের পতনে লেনদেন শেষ হয়েছে। ঐদিন ডিএসইতে লেনদেনও কমেছে। অপর বাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জেও একই চিত্রে লেনদেন শেষ হয়েছে।

বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, ডিএসই প্রধান বা ডিএসইএক্স সূচক ১৫ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ৪ হাজার ৪৯৮ পয়েন্ট, যা গত ৩ বছর ৫ মাস বা ৪১ মাসের মধ্যে সর্বনিন্ম। এর আগে ২০১৬ সালের ১০ জুলাই ডিএসই প্রধান সূচকের অবস্থান ছিল ৪ হাজার ৪৯৫ পয়েন্টে। অন্য সূচকগুলোর মধ্যে ডিএসইএস বা শরীয়াহ সূচক ১ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ১ হাজার ১৫ পয়েন্টে এবং ডিএস৩০ সূচক ৯ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৫৩৮ পয়েন্টে।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের সার্বিক অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের নিন্মমুখী ধারার কারণেই বিনিয়োগকারীদের মনে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। গত কয়েকদিন অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকের নিন্মগতির খবরও গণমাধ্যমগুলোতে আসছে। দেশের অর্থনীতির সূচকগুলো আগের হারে বাড়ছে না বলে গণমাধ্যমের বিভিন্ন প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, সরকার ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ নেওয়ার কারণে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে। গত অক্টোবর মাসে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি গত ৯ বছরের মধ্যে সর্বনিন্ম অবস্থানে গিয়ে ঠেকেছে।

চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের মাত্র পাঁচ মাসে বছরের লক্ষ্যমাত্রার ৯০ শতাংশ ব্যাংক ঋণ নিয়ে ফেলেছে সরকার। অর্থবছরের প্রথম দিন ১ জুলাই থেকে গত ২১ নভেম্বর পর্যন্ত সরকার ব্যাংক খাত থেকে ৪২ হাজার ৬০৭ কোটি ৩২ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছে। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পুরো সময়ে সরকার ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নিয়েছিল ২৬ হাজার ৪৪৬ কোটি টাকা। চলতি বাজেটে সরকারের ব্যাংক থেকে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।

এদিকে ব্যাংক ঋণের সুদহার কমছে না। আর বাড়ছে খেলাপি ঋণ। গত সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট ঋণের ১২ ভাগই খেলাপি হয়ে পড়েছে। খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা। এতে ব্যাংকের ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। আমদানি ও রপ্তানির ক্ষেত্রে লেনদেন ভারসাম্য আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২০ কোটি ৪০ লাখ ডলার নেতিবাচক হয়ে গেছে। গতবছর ১৫ কোটি ৮০ লাখ ডলার নেতিবাচক ছিল।

অন্যদিকে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় করতে পারছে না জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। যা আগের বছরের তুলনায় ৪৫ ভাগ বেশি। তবে অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২০ হাজার কোটি টাকা কম আয় করেছে। এসব নেতিবাচক সূচক দেশের অর্থনীতির ভালো দিক ইঙ্গিত করে না। তাই বিনিয়োগকারীদের অনেকেই হাত গুটিয়ে বসে আছেন। এমন কি অনেকেই তাদের বিও অ্যাকাউন্টও বন্ধ করে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে।

একাধিক বিনিয়োগকারীর সাথে আলাপকালে বলছেন, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ নিয়ে চরম হতাশার মধ্যে দিন কাটাতে হচ্ছে। তারা বলছেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে অর্থাৎ আওয়ামী লীগ নতুন করে সরকার গঠন করায় বিনিয়োগকারীরা যে আশার আলো দেখেছিলেন তা হতাশায় রূপ নিয়েছে।

কারণ, সরকারের ধারাবাহিকতা থাকা এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করার পর শেয়ারবাজার চাঙ্গা হবে, বিনিয়োগকারী লাভবান হবেন এমন চিন্তা করা হচ্ছিল। সে অনুযায়ী নির্বাচনের পর পর অনেকেই নতুন করে বিনিয়োগও করেছিলেন। তাতে চলতি বছরের প্রথম দিকে বাজারে কিছুটা চাঙ্গা ভাব দেখা যায়। তবে তা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণকে বলেন, ‘দেশের পুঁজিবাজারের প্রতি ভরসা পাচ্ছেন না বিনিয়োগকারীরা। বিনিয়োগকারীদের ভরসা দেওয়ার মতো কোনও উদ্যোগ দেখা যায়নি নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে। ডিএসই এর কোনও মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না।

ফলে খারাপ ও দুর্বল কোম্পানি বাজারে আসছে, অথচ ঠেকানো যাচ্ছে না। দুর্নীতি বছরের পর বছর ধরে চলছে। বছরের পর বছর লোকসান গুনছে ব্রোকারেজ হাউসগুলো। লোকসান গুনছেন বিনিয়োগকারীরা।’ তিনি বলেন, ‘যেসব নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানের দেখার কথা, তারা দেখছেন না। বাজারে সুশাসন বলতে কিছুই নেই। যে কারণে বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা আসছে না। ভরসা পাচ্ছেন না বিনিয়োগকারীরা।’

এ প্রসঙ্গে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সদস্য ব্রোকারেজ হাউজের মালিকদের সংগঠন ডিএসই ব্রোকারেজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সাবেক সভাপতি আহমেদ রশিদ লালী দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণকে বলেন, ‘বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার সংকট এখনও কাটেনি। তবে দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির একটা প্রভাব এই বাজারে পড়ছে হয়তো।’

তিনি বলেন, ‘ব্যাংকের সুদের হার বেশি হওয়ায় সবাই ব্যাংকেই টাকা রাখছে। শেয়ারবাজারের দিকে আসছে না। একই কারণে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগও হচ্ছে না।’ তিনি উল্লেখ করেন, এখন প্রত্যেকটি শেয়ারের মূল্যই আকর্ষণীয়। এখন শেয়ার কেনার সময়। বাজারের প্রতি আস্থা ফিরলে বা বিনিয়োগকারী শেয়ার কেনা শুরু করলে এই পতনের বাজারও ঘুরে দাঁড়াতে পারে।

পুঁজিবাজারে দরপতন প্রসঙ্গে তত্ত¡াবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘ব্যাংক ও আর্থিক খাতের অবস্থা ভালো না থাকায় পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকট দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে, অধিকাংশ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত। কিন্তু বর্তমানে অধিকাংশ ব্যাংক নানা সংকটে রয়েছে। এ সংকটের অন্যতম কারণ হলো খেলাপি ঋণ। খেলাপি ঋণের কারণে সরকারি-বেসরকারি অনেক ব্যাংক মূলধন সংকটের মুখে পড়েছে। এই অবস্থা থেকে বের হতে না পারলে পুঁজিবাজারের সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়।

অন্যদিকে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, ‘পুঁজিবাজারে বর্তমানে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো আস্থার সংকট। এই সংকটের কারণে বাজারে নতুন বিনিয়োগকারী তেমন আসছে না। আবার পুরনো বিনিয়োগকারীরাও লোকসানের কারণে শেয়ার লেনদেন করতে পারছে না। ফলে প্রতিদিনই সূচকের পাশাপাশি কমছে লেনদেন। আর শেয়ারের দাম কমে যাওয়ায় বাজার মূলধনও কমে যাচ্ছে।’

অর্থনীতিবিদ আবু আহমেদ বলেন, ‘সম্প্রতি ব্যাংকখাতে খেলাপি ঋণ আরও বেড়ে যাওয়ায় বেশ কয়েকটি ব্যাংকে তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে। এই অবস্থায় পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকের শেয়ারের দরপতন বেড়ে গেছে। যার প্রভাব পুরো পুঁজিবাজারে পড়ছে।’