দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা : শর্ত মেনে টানা তিন বছর পুঁজিবাজারে কোনো আইপিও আনতে না পারায় মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে বিএসইসি। তবে আইনের কোনো তোয়াক্কা করছে না ২১ মাচেন্ট ব্যাংক। লাইসেন্সের শর্ত মেনে টানা তিন বছর পুঁজিবাজারে কোনো প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) আনতে না পারার জন্য ৬১টি মার্চেন্ট ব্যাংকের মধ্যে ২১টির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এর অংশ হিসেবে প্রাথমিকভাবে তাদের কাছে ব্যর্থতার ব্যাখ্যা চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি।

বিএসইসি সূত্রে জানা গেছে, শেয়ার বাজারের দুঃসময়ে এসব মার্চেন্ট ব্যাংক কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। এক তৃতীয়াংশ মার্চেন্ট ব্যাংক লাইসেন্সের শর্তাবলি মেনে চলতে ব্যর্থ হয়েছে। কমিশনের (মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যান্ড পোর্টফোলিও ম্যানেজার) রুলস-১৯৯৬ অনুযায়ী, ২ বছরের মধ্যে তালিকাভুক্ত মার্চেন্ট ব্যাংককে কমপক্ষে একটি আইপিও ইস্যু জমা দিতে হয়। কিন্তু তারা কমিশনের লাইসেন্সের শর্ত পালনে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। গত তিন বছরে তারা একটি গণপ্রস্তাবও জমা দেয়নি বা কোনো সংস্থাকে মূলধন সংগ্রহ করতে সহায়তা করতে পারেনি।

বিএসইসি সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি ২১টি মার্চেন্ট ব্যাংককে এই বিষয়ে তাদের ব্যাখ্যা চেয়ে একটি চিঠি পাঠিয়েছে। মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো হলো- এশিয়ান টাইগার ক্যাপিটাল পার্টনার ইনভেস্টমেন্টস লিমিটেড; বেঙ্গল ইনভেস্টমেন্ট; বেটাওয়ান ইনভেস্টমেন্টস, কসমোপলিটন ফিন্যান্স, ইসি সিকিউরিটিজ, এক্সিম ইসলামী ইনভেস্টমেন্ট, এফএএস ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ক্যাপিটাল অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, গ্রামীণ ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট, গ্রিন ডেল্টা ক্যাপিটাল, হাল ক্যাপিটাল লি. সিগমা ক্যাপিটাল, আইএল ক্যাপিটাল, যমুনা ব্যাংক ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট, জনতা ক্যাপিটাল অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, মাইডাস ইনভেস্টমেন্ট, পিএলএফএস ইনভেস্টমেন্ট, রেস পোর্টফোলিও অ্যান্ড ইস্যু ম্যানেজমেন্ট, রিভারস্টোন ক্যাপিটাল, সোনালি ইনভেস্টমেন্ট, ট্রাস্ট ব্যাংক ইনভেস্টমেন্ট এবং উত্তরা ফিন্যান্স ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড।

বিএসইসি সূত্র জানায়, বেশ কয়েকটি মার্চেন্ট ব্যাংকার মনে করেন যে, ইস্যু মানেজারের কাজের চেয়ে আন্ডাররাইটিং এবং পোর্টফোলিও পরিচালনা করা তাদের জন্য অনেক সহজ। আইপিও আনার প্রক্রিয়াটি দীর্ঘ এবং বহু নিয়মের মধ্যে থাকতে হয়। এজন্য মার্চেন্ট ব্যাংকারা এটিকে এড়িয়ে চলে।

বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সাইফুর রহমান বলেছেন, বিগত কয়েক বছরে কিছু মাচেন্ট ব্যাংক আইপিও ইস্যু জমা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এজন্য কমিশন তাদের কাছে ব্যাখ্যা চেয়ে একটি চিঠি দিয়েছে। কমিশন ব্যাখ্যা পাওয়ার পরে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।

মার্চেন্ট ব্যাংকের কাজ কী: ইস্যু ম্যানেজ; পোর্টফোলিও ম্যানেজ, আন্ডার রাইটিং এবং বাজারে বিনিয়োগ বা বিনিয়োগকারীদের ঋণ সুবিধা দেয়া মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর প্রধান কাজ। তবে বাজারের দুর্যোগ মুহূর্তে সঠিক নির্দেশনার মাধ্যমে বিনিয়োগকারীসহ সার্বিক বাজারকে ইতিবাচক দিকে নিতে ভূমিকা রাখতে পারছে না মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো। অথচ বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তাদের দিকে বিনিয়োগকারীদের ভরসা অনেক। কিন্তু ধসের পর থেকে বাজারে ব্যাপক মন্দা চলতে থাকলেও তাতে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো একেবারেই নিশ্চুপ রয়েছে। এমনকি বিনিয়োগের মাধ্যমে বাজারকে সামাল দিতেও তারা কোনো প্রকার চেষ্টা করছে না।

এ ব্যাপারে বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, বাজার যখন ভালো ছিল তখন মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো ভালো সুবিধা নিয়েছে। অথচ বাজারে যখন অব্যাহত দরপতন চলছে তখন মার্চেন্ট ব্যাংকের কোনো ভূমিকা নেই। তিনি বলেন এসইসির উচিত হবে যে সব মার্চেন্ট ব্যাংক এ বাজারে নীরব ভূমিকা পালন করছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া এবং তাদের লাইসেন্স বাতিল করা। অপরদিকে এ বিষয়ে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর মতে, তারা বিনিয়োগে নেই এমন কথা বললে ভুল হবে। বরং বিনিয়োগ করতে করতে বিনিয়োগের ক্ষমতা শেষ হয়ে এসেছে।

ব্যর্থতার কারণ: কিছু মার্চেন্ট ব্যাংকার ইস্যু ম্যানেজমেন্টের কার্যক্রমে আগ্রহী নয়। এর পরিবর্তে তারা আন্ডার রাইটিং, পোর্টফোলিও ম্যানেজমেন্ট এবং কর্পোরেট কাউন্সিলিংয়ের মতো কাজ করতে আগ্রহী। বিএসইসি গত তিন বছরে পুঁজিবাজারের জন্য মাত্র ২৬টি আইপিও অনুমোদন করেছে যেখানে ৬২টি মার্চেন্ট ব্যাংক রয়েছে। যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। তবে বেশ কয়েকটি মার্চেন্ট ব্যাংক ইস্যু ম্যানেজমেন্টে খুব ভালো করেছে। তবে যারা ভালো করতে পারছে না তারা বলছেন, ইস্যু ম্যানেজমেন্টের কার্যক্রমের জন্য কোনো নীতিমালাও নেই ফলে তারা নিয়ন্ত্রক সংস্থার শর্ত পূরণ করতে পারছেন না।

মার্চেন্ট ব্যাংকারদের দৃষ্টিভঙ্গি: পিএলএফএস ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার মো. আবদুল মুক্তাদির বলেন, বিএসইসি কর্তৃক প্রেরিত চিঠি তারা এখনও পাননি। তিনি বলেন, ইস্যু ম্যানেজমেন্ট সম্পর্কিত এখনো কার্যকর কোনো নীতি গ্রহণ করা হয়নি। বিএসইসি যদি তাদের শর্ত মেনে চলার জন্য চাপ দেয় তবে বিষয়টি নিয়ে একটি অ্যাকশন পস্ন্যান করবেন তারা।

জনতা ক্যাপিটাল অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের চিফ এক্সিকিউটিভ দিনা আহসান বলেছেন, তারা ইতোমধ্যে বিএসইসির কাছ থেকে চিঠি পেয়েছেন। তবে তারা সম্প্রতি আইপিওর জন্য দুটি ইস্যু জমা দিয়েছেন। তারা ভালো কোম্পানির আইপিও আনতে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।

এমটিবি ক্যাপিটাল লিমিটেডের চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার খায়রুল বাশার আবু তাহের মোহাম্মদ বলেন, ‘অনেক মার্চেন্টের ব্যর্থতার মূল কারণ সঠিক নীতিমালা না থাকা।

এদিকে অভিযোগ রয়েছে, পুঁজিবাজার থেকে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের মাধ্যমে (আইপিও) নতুন কোম্পানিগুলো অর্থ তুলে নিচ্ছে। এগুলোর বেশিরভাগই বেশি প্রিমিয়াম নিয়ে অতি মূল্যায়িত হয়ে বাজারে আসছে। আর রেগুলেটররা হরদম এসব কোম্পানির অনুমোদন দিয়ে যাচ্ছে। ফলে বাজারে আসার পর প্রথম কয়েকমাস তিন থেকে চারগুণ বেশি দামে শেয়ার বিক্রি হলেও পরে তা ফেসভ্যালুতে আবার অনেকগুলো তারও নিচে নেমে আসছে। এতে করে একদিকে কোম্পানিগুলো বাজার থেকে অর্থ তুলে নিচ্ছে। অন্য দিকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ছোট বিনিয়োগকারীরা।

বাজার সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, নতুন কোম্পানিগুলো বাজারে আসার আগে তিন-চার বছর তেমন কোনো লভ্যাংশ না দিলেও বাজারে এসেই বোনাস শেয়ার ইস্যু করছে। আর তাদের উদ্যোক্তা ও পরিচালকরা সেই বোনাস শেয়ার বিক্রি করে বাজার থেকে শত শত কোটি টাকা তুলে নিচ্ছে। কিন্তু পুনরায় শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করছে না। ফলে বাজারে শেয়ার মূল্য পতন হচ্ছে। আর এভাবে অর্থ চলে যাচ্ছে এবং বাজারও ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না।