এফ জাহান ও শহিদুল ইসলাম, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা : পুঁজিবাজার গতিশীল করতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও সবই কার্যত বিফলে যাচ্ছে। বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে তারল্য সরবরাহ বৃদ্ধি ও আইনগত সহায়তা দেওয়া সত্ত্বেও বাজার গতিহীন। সময় যত গড়াচ্ছে পুঁজিবাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের অনাস্থা আরো প্রকট হচ্ছে। আস্থাহীনতা থেকে তাঁরা শেয়ার বিক্রি করে বাজার ছাড়ছেন। বর্তমান পুঁজিবাজারে চলছে বিনিয়োগকারীদের আর্তনাদ। এ আর্তনাদ কে শুনবে।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজারে শেয়ার বিক্রির চাপ বাড়ায় প্রতিদিনই কমছে শেয়ারের দাম। আর লোকসান হলেও ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরাও বাজারে নিষ্কিয় ভ’মিকা পালন করছেন। দেখে মনে হচ্ছে পুঁজিবাজারে যেন হরিলুট চলছে। বিশেষ করে অর্থমন্ত্রী ও বিএসই ভ’মিকা প্রশ্নবিদ্ধ।

নিয়ন্ত্রক সংস্থা সূত্র বলছে, স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে বিভিন্ন সময় বৈঠক করে তাঁদের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে আইন সংস্কার করা হয়েছে। তার পরও তাঁরা বাজারে সক্রিয় হওয়ার পরিবর্তে নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন। বড় বিনিয়োগকারীদের এমন অস্বাভাবিক আচরণের কারণ খতিয়ে দেখছে কমিশন।

সূত্র জানায়, পুঁজিবাজার থেকে মূলধন উত্তোলনে স্বচ্ছতা বাড়াতে পাবলিক ইস্যু রুলসে বড় পরিবর্তন এনেছে কমিশন। সাধারণ বিনিয়োগকারী বাড়ানোর উদ্যোগের পাশাপাশি বুকবিল্ডিং এবং অন্যান্য নীতিমালায়ও পরিবর্তন আনা হয়েছে। স্টেকহোল্ডারদের দাবি ছিল, পুঁজিবাজারে গতিশীলতা আনতে প্রাইভেট প্লেসমেন্ট বাধার সৃষ্টি করছে। এতে রমরমা বাণিজ্য হওয়ায় সেকেন্ডারি মার্কেট গতিশীল হচ্ছে না। প্রসপেক্টাস অনুমোদনের দিন থেকে প্লেসমেন্ট শেয়ারের লক-ইন ছিল এক বছর, যা বাড়িয়ে দুই বছর করা হয়েছে। মূলধন উত্তোলন করা কম্পানির আইপিওতে সাধারণ বিনিয়োগকারীর কোটা বাড়ানো হয়েছে।

পুঁজিবাজারে আইসিবির সক্ষমতা বাড়াতে দুই হাজার কোটি টাকার বন্ড ছাড়া হয়েছে, যা দিয়ে শেয়ার কিনছে প্রতিষ্ঠানটি। এ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের প্রণোদনার ৮৫০ কোটি টাকা আইসিবিকে দেওয়া হয়, যার একটি অংশ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরাও পেয়েছেন।

সংশ্লিষ্টদের দাবি, পুঁজিবাজার গতিশীলতায় বড় ভূমিকা রাখে ব্যাংকের বিনিয়োগ। তবে দীর্ঘদিন থেকে তারল্য সংকটে ব্যাংক ও তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজারে সক্রিয় হতে পারেনি। খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন রাখতে গিয়ে তারা আর্থিক সংকটে সহযোগী প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিতে পারছে না। আবার পুঁজিবাজার লাভজনক না হওয়ায় ব্যাংক এখানে বিনিয়োগ করতেও আগ্রহ দেখাচ্ছে না।

এ অবস্থায় ব্যাংক খাতের বিনিয়োগসীমায় ছাড় দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি বছরের মে মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক সার্কুলারে পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগসংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। সব শেষ পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ বাড়াতে তারল্য সুবিধা দেওয়ার নির্দেশনা জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংক ট্রেজারি বিল বা বিল রেপোর মাধ্যমে তারল্য সুবিধা নিয়ে নিজে বিনিয়োগের পাশাপাশি সহযোগী কম্পানিকে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে ঋণ দিতে পারবে। এদিকে

কম ঝুঁকিতে বিনিয়োগ পছন্দ যাদের, সেই ক্ষুদ্র পুঁজির লোকেরা কোথায় নিশ্চিন্তি খুঁজছেন এমন প্রশ্ন এখন ঘুরেফিরে আসছে। শেয়ারবাজারে যাওয়া মানেই যেন পুঁজি হাওয়া এই যখন অবস্থা, তখন বিনিয়োগকারীদের সামনে বিকল্প কী? আস্থাহীনতার রাহুগ্রাসে নিয়তই পতনমুখী শেয়ারবাজার। কেউ ইতিমধ্যে সর্বস্বান্ত হয়েছেন। কেউবা ওদিক টায় আর পা মাড়াচ্ছেন না। বারবার ধরাশায়ী হওয়ার পর বাজার থেকে বেরিয়ে আসার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টাও বিফলে যাচ্ছে অনেকের। প্রশ্ন, এই পতনের শেষ কোথায়? বাজারে না হয় পতনের ধারাই চলছে কিংবা চলবে, কিন্তু ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা কোথায় লগ্নি করে দুটি পয়সা আয় করবেন? ঊর্ধ্বমুখী নিত্যমূল্যের বাজারে জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাওয়া এই বিশাল গোষ্ঠীর কি তবে পরিত্রাণ নেই?

বলা হয়, পুঁজি সংগ্রহের বিকল্প উৎস শেয়ারবাজার। এর গভীরতা বাড়লে, বাজারে আস্থার সংকট কাটাতে পারলে এটিই হতে পারত প্রায় ৩২ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর রুটিরুজির অন্যতম উৎস। সেই উেস যখন অনাগ্রহ কিংবা বিনিয়োগকারী আকর্ষণে ব্যর্থ হচ্ছে, ঠিক সেই সময়ে কমছে ব্যাংকের সুদও। আমানতে এখন আর ব্যাংকগুলোর আকর্ষণীয় মুনাফার অফার নেই।

পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ড. আবু আহমেদ বলেন, ‘চার বছর ধরে পুঁজিবাজারের মূলধন কমছে। হতাশায় পড়ে বিনিয়োগকারীরা বিও হিসাব বন্ধ করে বাজার ছাড়ছেন। অর্থাৎ তাঁরা বাজারে কোনো আশা দেখছেন না। বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরানো সম্ভব না হলে বাজারের গতি ফিরবে না।’

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. বখতিয়ার হাসান বলেন, পুঁজিবাজার ভালো করতে বেশকিছু ভালো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তবে বাজারে এগুলোর ইতিবাচক প্রভাব দেখা যাচ্ছে না। এর প্রধান কারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থা ও তারল্য সংকট। আস্থা ও তারল্য সংকট কাটানো গেলে বাজার স্বাভাবিকভাবেই ঘুরে দাঁড়াবে। এক্ষেত্রে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর পারফরমেন্স খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের সক্রিয় হতে হবে।

ডিএসইর পরিচালক রকিবুর রহমান বর্তমান বাজার পরিস্থিতি সম্পর্কে বলেন, সবাইকে ধৈর্য ধরতে হবে। কেউ যেন হতাশ না হন। আমরা সবাই যদি নিজের জায়গা থেকে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার মধ্য থেকে কাজ করি তাহলে অবশ্যই বাজার ভালো হবে। কীভাবে বাজারের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানো যায়, সে বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বেশ পজেটিভ। তবে বাজার শক্তিশালী করতে হলে গুণগত পরিবর্তন আনতে হবে। বন্ড মার্কেট লেনদেনের আওতায় আনতে হবে। সেই সঙ্গে শক্তিশালী মিউচ্যুয়াল ফান্ড আনতে হবে।

ডিএসই ব্রোকারস অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) সভাপতি শাকিল রিজভী বলেন, পুঁজিবাজারে উত্থান-পতন হবে, এটাই স্বাভাবিক। আমার মতে, বর্তমান বাজার কেনার জন্য বেশ ভালো। অনেক ভালো কোম্পানির শেয়ারের দাম রিজেনেবল প্রাইসে রয়েছে। তবে কোম্পানির পারফরমেন্স বাজারের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে কোম্পানির প্রথম প্রান্তিক বা বার্ষিক পারফরমেন্স বিবেচনা করলে বেশির ভাগ কোম্পানির শেয়ার কেনার উপযোগী। আমার ধারণা, ডিসেম্বর মাসে হয়তো বাজার কিছুটা চাপের মধ্যে থাকবে। তবে জানুয়ারি থেকে ভালো হবে।