দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা : প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) বন্ধ থাকায় দেশের পুঁজিবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহে এক প্রকার ধস নেমেছে। বিদায়ী ২০১৯ সালে আইপিও ও রাইট শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে কোম্পানিগুলোর অর্থ সংগ্রহের পরিমাণ ১১ বছরের মধ্যে সর্বনিন্ম পৌঁছেছে। তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৯ সালে আইপিও ও রাইট শেয়ার ইস্যু করে পুঁজিবাজার থেকে ৬৪১ কোটি ৯৩ লাখ টাকা সংগ্রহ করা হয়েছে। ২০১৮ সালে এ দুই মাধ্যমে বাজার থেকে অর্থ সংগ্রহ করা হয় ৬৫৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এ হিসাবে বছর ব্যবধানে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহ কমেছে ১৩ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। কেবল ২০১৮ সালের তুলনায় নয়, ২০০৯ সাল বা বিগত ১১ বছরের মধ্যে আইপিও ও রাইট শেয়ারের মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে এত কম অর্থ সংগ্রহ আর হয়নি।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালে আইপিও ও রাইট শেয়ারের মাধ্যমে এক হাজার ৪৪১ কোটি ৩৯ লাখ, ২০১৬ সালে ৯৫০ কোটি ১২ লাখ, ২০১৫ সালে ৬৭৫ কোটি ৭২ লাখ, ২০১৪ সালে তিন হাজার ২৬৩ কোটি ৮৮ লাখ, ২০১৩ সালে ৯১০ কোটি ৮০ লাখ, ২০১২ সালে এক হাজার ৮৪২ কোটি ৯৭ লাখ, ২০১১ সালে তিন হাজার ২৩৩ কোটি ৬৫ লাখ, ২০১০ সালে তিন হাজার ৩৯০ কোটি ৩৩ লাখ এবং ২০০৯ সালে ৯১৭ কোটি ৮৫ লাখ টাকা সংগ্রহ করে বিভিন্ন কোম্পানি।

২০১৯ সালে আইপিও ও রাইট শেয়ার এ দুই পদ্ধতির সম্মিলিত অর্থ উত্তোলনের পরিমাণ কমলেও শুধু আইপিও হিসাবে নিলে ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে অর্থ উত্তোলনের পরিমাণ কিছুটা বেড়েছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে রিং শাইন টেক্সটাইল। কোম্পানিটি আইপিও’র মাধ্যমে ১৫০ কোটি টাকা উত্তোলন করেছে। ২০১৮ সালের তুলনায় আইপিও’র মাধ্যমে অর্থ উত্তোলনের পরিমাণ বাড়লেও ২০১৯ সালের এপ্রিল থেকে আইপিও দেয়া বন্ধ রয়েছে। অর্থাৎ বছরের মাত্র চার মাস আইপিও দেয়া হয়েছে। বাকি আটমাস আইপিও বন্ধ রয়েছে।

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) বর্তমান চেয়ারম্যান এম খায়রুল হোসেনের নেতৃত্বাধীন কমিশন থেকে অনুমোদন দেয়া প্রায় অর্ধ শতাধিক কোম্পানির শেয়ারের দাম ইস্যুমূল্য অথবা ফেসভ্যালুর নিচে নেমে গেছে। আইপিওতে আসা কোম্পানিগুলোর এমন করুণ অবস্থার কারণে সমালোচনার মুখে পড়ে বর্তমান কমিশন। বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ করা হয়, একের পর এক দুর্বল কোম্পানির আইপিও অনুমোদন দেয়া হচ্ছে। ফলে সার্বিক পুঁজিবাজার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তবে সবচেয়ে বেশি সমালোচনা হয় কপারটেক ইন্ডাস্ট্রিজের আইপিও অনুমোদন নিয়ে। বড় ধরনের সমালোচনার মুখে গত ৩০ এপ্রিল কমিশন সভা করে নতুন আইপিও না দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বিএসইসি।

ওই সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (পাবলিক ইস্যু) রুলস ২০১৫ সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত ৩০ এপ্রিল থেকে আইপিও সংক্রান্ত নতুন কোনো আবেদন গ্রহণ করা হবে না। অবশ্য ওই সিদ্ধান্তের আড়াই মাসের মধ্যে আইপিওতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কোটা বাড়িয়ে পাবলিক ইস্যু রুলস ২০১৫-এর সংশোধন আনে বিএসইসি। এরপর দীর্ঘ সময় কেটে গেলেও নতুন কোনো আইপিও আর অনুমোদন পায়নি। ফলে আইপিওতে আসা কোম্পানির সংখ্যা কমেছে। ২০১৯ সালে স্থির মূল্য (ফিক্সড প্রাইস) পদ্ধতিতে পাঁচটি কোম্পানি ২৪৫ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে।

আর বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে তিনটি কোম্পানি ৩০৭ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে। অর্থাৎ আইপিও’র দুই পদ্ধতিতে আটটি কোম্পানি ৫৫২ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে। আগের বছর ফিক্সড প্রাইস পদ্ধতিতে ১১টি কোম্পানি ২৬৬ কোটি টাকা সংগ্রহ করে। আর বুক বিল্ডিংয়ে দুটি কোম্পানি ২৮০ কোটি টাকা সংগ্রহ করে। এ হিসাবে দুই পদ্ধতিতে আইপিও’র মাধ্যমে ১৩টি কোম্পানি ৫৪৬ কোটি টাকা সংগ্রহ করে। অপরদিকে ২০১৯ সালে রাইট শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো ৮৯ কোটি ৯৩ লাখ টাকা সংগ্রহ করেছে। আগের বছর এর পরিমাণ ছিল ১০৯ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এ হিসাবে রাইট শেয়ারের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহের পরিমাণ কমেছে ১৯ কোটি ৪৭ লাখ টাকা।

এ বিষয়ে সাবেক তত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, পুঁজিবাজারে আইপিও বন্ধ করা সঠিক সিদ্ধান্ত নয়। বাজার ভালো করতে হলে ভালো ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য প্রয়োজনে প্রণোদনা দিয়ে হলেও ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্ত করতে হবে।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. বখতিয়ার হাসান বলেন, শিল্পায়নে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নে মূল উৎস হলো পুঁজিবাজার। কিন্তু আমাদের দেশে শিল্পে অর্থ জোগান দেয়ার প্রধান মাধ্যমে হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্যাংক। পুঁজিবাজার শিল্পায়নে দীর্ঘমেয়াদি অর্থের প্রধান উৎস হয়ে উঠতে না পারায় সার্বিক অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

তিনি বলেন, পুঁজিবাজারে ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্তের কোনো বিকল্প নেই। যে কোনো উপায়ে ভালো কোম্পানি পুঁজিবাজারে আনতে হবে। স¤প্রতি বাজারে যে মন্দাভাব দেখা দিয়েছে এর অন্যতম কারণ হলো- দুর্বল কোম্পানি তালিকাভুক্ত হওয়া। তাই দুর্বল কোম্পানির আইপিও বন্ধ করতে হবে। তবে কোনো অবস্থায় আইপিও বন্ধ করা ঠিক হবে না।

যা আছে সংশোধিত পাবলিক ইস্যুতে: পাবলিক ইস্যুতে সংশোধনী এনে বুক বিল্ডিংয়ে যোগ্য বিনিয়োগকারীর কোটা ৬০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫০ শতাংশ করা হয়। আর সাধারণ বিনিয়োগকারীর কোটা ৩০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪০ শতাংশ করা হয়। একইভাবে স্থির মূল্যে পাবলিক ইস্যুর ক্ষেত্রে যোগ্য বিনিয়োগকারীর কোটা ৪০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩০ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীর কোটা (এনআরবি ছাড়া) ৪০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫০ শতাংশ করা হয়। এতে শর্ত রাখা হয়, পূর্বের ইস্যু করা মূলধনের ৮০ শতাংশ ব্যবহার না করে পাবলিক ইস্যুর প্রস্তাব করা যাবে না। স্থির মূল্যের (ফিক্সড প্রাইস) পাবলিক ইস্যুর পরিমাণ কমপক্ষে ৩০ কোটি টাকা অথবা ইস্যুয়ারের পরিশোধিত মূলধনের ১০ শতাংশ বেশি হতে হবে।

তবে ইস্যু-পরবর্তী মূলধন কমপক্ষে ৫০ কোটি টাকা হতে হবে। বুক বিল্ডিংয়ের মাধ্যমে পাবলিক ইস্যুর ক্ষেত্রে এর পরিমাণ কমপক্ষে ৭০ কোটি টাকা হতে হবে। বুক বিল্ডিংয়ের মাধ্যমে পাবলিক ইস্যুর ক্ষেত্রে যোগ্য বিনিয়োগকারীর শেয়ারের কোটা বিডিংয়ের মাধ্যমে সম্পূর্ণরূপে বিক্রি না হলে সে ইস্যু বাতিল হয়ে যাবে। এতে আরও শর্ত রাখা হয় যে, স্টক এক্সচেঞ্জকে পাবলিক ইস্যুর তালিকাভুক্তির আবেদন পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে পাবলিক ইস্যু রুলস বা অন্যান্য সিকিউরিটিজ আইন অথবা অ্যাকাউন্টিং স্ট্যান্ডার্ডের ব্যত্যয় যদি থাকে, উলেস্নখপূর্বক তাদের মতামত কমিশনে প্রেরণ করতে হবে।