দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা : উচ্চ প্রবৃদ্ধির দেশে পুঁজিবাজার হাঁটছে উল্টো পথে। সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার কার্যকর পদক্ষেপের অভাবে সৃষ্টি হয়েছে বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতা। টানা দরপতনে পুঁজি হারিয়ে লাখ লাখ বিনিয়োগকারী ছেড়েছেন এই বাজার। লেনদেন কমায় বাজার মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানগুলো পড়েছে লোকসানে। নতুন কোম্পানির পুঁজি সংগ্রহের পথও সংকুচিত হয়ে গেছে। ফলে ১৯৯৬ ও ২০১০ সালের ধসে সৃষ্ট সংকটকালের পর গত ৭ বছরের মধ্যে এখন সবচেয়ে নাজুক দশা পুঁজিবাজারের।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজারের বর্তমান দুরবস্থার প্রধান কারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতা। আর এই অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে সুশাসন, প্রয়োজনীয় নজরদারি ও অপরাধীর যথাযথ শাস্তির অভাবে। সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিলে এমনটি হতো না বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। এক যুগ ধরে বারবার সময় নির্ধারণ করেও রাষ্ট্রায়ত্ত কোনো কোম্পানি তালিকাভুক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে ভালো কোম্পানি পুঁজিবাজারে আনতেও কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। অথচ বাজারে গতি আনতে এসব ছিল সবচেয়ে কার্যকর উপায়। তবে উল্টো মানহীন কোম্পানির আইপিও (প্রাথমিক গণপ্রস্তাব) এনে বাজারকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে।

বাংলাদেশে এ অবস্থা থাকলেও প্রতিবেশী দেশগুলোর পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ভারতের অর্থনীতিতে মন্দা সত্তে¡ও গত চার বছরে বোম্বে স্টক এক্সচেঞ্জের (বিএসই) সেনসেক্স সূচক ৭৫ শতাংশ বেড়েছে। দেনায় জর্জরিত শ্রীলঙ্কায়ও কলম্বো স্টক এক্সচেঞ্জের অল শেয়ার ইনডেক্সের বড় ধরনের পতন রোধ হয়েছে। দেড় বছর পতনের পর গত চার মাসে পাকিস্তানের করাচি স্টক এক্সচেঞ্জের কেএসই-১০০ সূচক ৪৫ শতাংশ বেড়েছে। শুধু দক্ষিণ এশিয়া নয়, গত কয়েক বছরে উন্নত দেশগুলোর প্রায় সব পুঁজিবাজারে সূচকের উন্নতি হয়েছে। পাঁচ বছরে যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাজারে এসঅ্যান্ডপি-৫০০ সূচক ৫০ শতাংশ ও নাসডাক-১০০ বেড়েছে ১০০ শতাংশ। তাহলে উচ্চ প্রবৃদ্ধির দেশ হয়েও বাংলাদেশের পুঁজিবাজার পেছনে হাঁটছে কেন এ প্রশ্ন বিশ্লেষকদের।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আবু আহমেদ বলেন, ‘আমি অত্যন্ত পীড়িত যে আমাদের সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যারা রয়েছেন, তারা বুঝতে অক্ষম যে ক্যাপিটাল মার্কেটের সমর্থন ছাড়া অর্থনীতি এগিয়ে নেওয়া যায় না। তারা সবাই ব্যাংকের দিকে চেয়ে আছেন। তাদের ধারণা ব্যাংক টাকা দেবে শিল্প-বাণিজ্যের উন্নতি হবে, দেশ এগিয়ে যাবে। এ সবই ভুল ধারণা। পুঁজিবাজারের সমর্থন ছাড়া চীন, ভারত কেউই অর্থনীতিতে উন্নতি করতে পারত না। ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্ত করতে আমরা কেন এত দেরি করছি? ভালো কোম্পানি পুঁজিবাজারে এলে হয় আমরা তাদের পুরস্কৃত করব, নয়তো শাস্তি দিতে হবে।

ভালো কোম্পানি ছাড়া পুঁজিবাজারে উন্নতি আসবে না। কিন্তু এক্ষেত্রে আমাদের অর্থমন্ত্রীর কোনো উৎসাহ আমরা দেখি না। অথচ এটি করলে তিনি প্রশংসিত হতেন। একইভাবে ভালো কোম্পানি না আনতে পারার ব্যর্থতা এসইসিরও রয়েছে।’ পুঁজিবাজার পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, ২০১০ সালের ডিসেম্বরের ধসের প্রভাব ছিল পরের দুই বছর পর্যন্ত। যদিও এই পতন ২০১০-এর ধস হিসেবে পরিচিত। ২০১১ সালের ডিসেম্বর শেষে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল্যসূচকটি ৩৬ দশমিক ৫ শতাংশ হারিয়ে ৫২৫৭ পয়েন্টে নেমে আসে। পরের বছর সূচকটি ১৯ দশমিক ৭ শতাংশ হারিয়ে ৪২১৯ পয়েন্টে নামে। সূচকের এই বড় পতনে বিনিয়োগকারীদের উল্লেখযোগ্য অংশই পুঁজির বড় অংশ হারিয়ে ফেলেন।

শেয়ার দরের সর্বনিম্ন অবস্থানের কারণে ওই সময় নতুন বিনিয়োগ আসে। বিদেশিদের পাশাপাশি স্থানীয় ব্যক্তিশ্রেণির বিনিয়োগকারীরাও এগিয়ে আসেন। ফলে ২০১৭ সাল পর্যন্ত কিছুটা স্থিতিশীলতা দেখা দেয়। সূচক বেড়ে দাঁড়ায় ৬২৪৪ পয়েন্টে। তবে ২০১৮ সাল থেকে ব্যাংক খাতের তারল্য-সংকট, ঋণখেলাপি পরিস্থিতি ও বিদেশিদের শেয়ার বিক্রির চাপে আবারও দরপতন দেখা দেয়। ফলে গত বছর ডিএসইর প্রধান সূচকটি ১৩ দশমিক ৭৫ পয়েন্ট কমে।

চলতি বছর ব্যাংক খাতের সংকট, পিপলস লিজিংয়ের অবসায়নে পুরো এনবিএফআই খাতে বিপন্ন পরিস্থিতি ও গ্রামীণফোনের সঙ্গে বিটিআরসির দ্ব›দ্ব বড় প্রভাব ফেলে বাজারে। এর মধ্যে বিদেশিদের টানা শেয়ার বিক্রি চাপে পড়ে বাজার। এতে গত মঙ্গলবার পর্যন্ত ডিএসইতে ৮০ শতাংশ শেয়ারের দর কমেছে। এতে চলতি বছরের শুরু থেকে গত পরশু পর্যন্ত ডিএসইর প্রধান সূচক ১৮ দশমিক ৫ শতাংশ কমে গিয়ে ৪৩৯০ পয়েন্টে নেমেছে। ফলে ১৯৯৬ ও ২০১০ সালের দুই দফা ধসে সৃষ্ট সংকটকালের পর গত সাত বছরে সবচেয়ে নাজুক দশায় পড়েছে পুঁজিবাজার। টানা দরপতনে বিনিয়োগকারীরা পুঁজি হারাচ্ছেন। অনেকেই সর্বস্ব হারিয়ে বাজার ত্যাগ করছেন।

সেন্ট্রাল ডিপজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিডিবিএল) হিসাব অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে ৭ লাখ ১৮ হাজার বিও বেনিফিশিয়ারি ওনার্স) হিসাব কমে গেছে। বর্তমানে যে বিও রয়েছে তার মধ্যে ৫৫ শতাংশে কোনো শেয়ার নেই। শুধু গত এক বছরেই ৩০ হাজারের বেশি সক্রিয় বিনিয়োগকারী পুঁজিবাজার ছেড়েছেন। বিনিয়োগকারী সংকটে লেনদেন নেমেছে ২০০ কোটি টাকার ঘরে।
২০১১ সাল থেকে এ পর্যন্ত ডিএসইতে ৯৬টি কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়েছে, যার বড় অংশই মানহীন। এর মধ্যে অধিকাংশ আইপিও এসেছে কয়েকটি মার্চেন্ট ব্যাংকের সমন্বয়ে গঠিত একটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে। এসব আইপিওর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বন্ধ হয়ে গেছে অথবা লোকসানে পড়েছে।

কোম্পানিগুলো শুরুতে যে আয় দেখায়, অর্থ সংগ্রহের পর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। গত আট বছরে যত আইপিওর অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, তার ৫৩ শতাংশের আয় কমে গেছে। অথচ যেসব ইস্যু ম্যানেজার দুর্বল আইপিও বাজারে তালিকাভুক্ত করেছে, তাদের কখনই শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়নি। বরং পরবর্তী সময়ে তাদের আনা আইপিওকেই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। আইপিওতে আসার আগে কোম্পানিগুলোর পরিশোধিত মূলধন অস্বাভাবিক হারে বাড়ানো হয়েছে। প্লেসমেন্টের একটি শক্তিশালী চক্র গড়ে উঠেছে। আবার আইপিওতে অর্থ সংগ্রহের পরপরই বোনাস ইস্যুর মাধ্যমে মূলধন বাড়ানো হয়েছে। ফলে কয়েক বছরের মধ্যেই সেকেন্ডারি বাজারে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির শেয়ার অভিহিত মূল্যের নিচে নেমে যাচ্ছে।

প্রায় সব দেশের পুঁজিবাজারে মিউচুয়াল ফান্ডের শক্তিশালী ভ‚মিকা দেখা যায়। যেসব বিনিয়োগকারী ঝুঁকি নিতে চান না, তারা মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করেন। কিন্তু এখানে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার (এসইসির) দুর্বলতা ও সম্পদ ব্যবস্থাপকদের লোভ, অদক্ষতা, স্বেচ্ছাচারিতার কারণে মিউচুয়াল ফান্ড খাত ধ্বংসের মুখে ফেলে দেওয়া হয়েছে। এখন দেশের পুঁজিবাজারে দৈনিক লেনদেনে খাতটির ভ‚মিকা এক শতাংশেরও কম, যেখানে বোম্বে স্টক এক্সচেঞ্জের ৩০ শতাংশের বেশি। আবার কোম্পানিগুলোর আয়ে কোনো স্বচ্ছতা না থাকার অভিযোগ রয়েছে। কোনো কোম্পানি আয় কমিয়ে দেখাচ্ছে, আবার কোনোটির উদ্যোক্তা-পরিচালকরা বেনামে শেয়ার ব্যবসায় যুক্ত থাকায় প্রান্তিক প্রতিবেদনে অতিরঞ্জিত আয় দেখানো হচ্ছে। শেয়ার দরে কারসাজির পর বছর শেষে সেই আয় আবার হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে। সর্বশেষ হিসাব বছরে ইনটেক অনলাইন নামের একটি কোম্পানি এমন ঘটনা ঘটালেও নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে কোনো প্রশ্ন তোলা হয়নি। আস্থাহীনতার এসবই বড় কারণ।

আবু আহমেদ বলেন, ‘পুঁজিবাজারে সুশাসন নিয়ে আসতে হবে। কিছু উদ্যোক্তা রয়েছেন, যারা ফাটকাবাজ ও প্রতারক। আইপিওতে তারা তাদের শেয়ারগুলো খুব ভালো দামে বিক্রি করে এখন তারা কোম্পানির ম্যানেজমেন্ট চালান। তাদের শেয়ারহোল্ডিং না থাকায় তারা মুনাফা দেখায় না। কারণ মুনাফা দেখালে শেয়ারহোল্ডারদের লভাংশ দিতে হবে। এসব কোম্পানির পুনঃনিরীক্ষার দায়িত্ব ছিল এসইসির। কিন্তু সেটা তারা করছে না। কোম্পানির পর্ষদ পরিবর্তনের ক্ষমতা থাকলেও এসইসি তা করছে না। আবার এফআরসি (ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল) গঠন করা হলেও তারা কাজ করছে না। গ্রামীণফোন ও বিটিআরসির বিরোধও পুঁজিবাজারে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। এর মাধ্যমে বিদেশিদের যে বার্তা দেওয়া হচ্ছে, তাতে তাদের বিনিয়োগেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।’

পুঁজিবাজারে স্বচ্ছতা, সুশাসন নিশ্চিত করা ও আস্থাহীনতা দূর করতে সরকারের উদ্যোগেরও অভাব রয়েছে। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকারের সিদ্ধান্ত পুঁজিবাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। তিতাসের মতো তালিকাভুক্ত কোম্পানির মূল আয় থেকে শেয়ারহোল্ডারদের বঞ্চিত করা হয়েছে। স¤প্রতি সব সরকারি কোম্পানির পুঞ্জীভ‚ত মুনাফা বা রিজার্ভ সরকারি কোষাগারে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ফলে পুঁজিবাজারে সরকারি কোম্পানির আয় ব্যাপক হারে কমে যাবে, যার প্রভাব এরই মধ্যেই পুঁজিবাজারে পড়তে শুরু করেছে।

গত সাত বছরেরও বেশি সময়ে এসইসিকে প্রয়োজনীয় জনবল দেওয়া হয়নি। এতে নজরদারি ও সুশাসন নিশ্চিত করতে পারছে না সংস্থাটি। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে স্বচ্ছতা আনতে এফআরসি গঠন করা হলেও প্রয়োজনীয় জনবল দেওয়া হয়নি। ফলে তারাও কাজ করতে পারছে না। স্টক এক্সচেঞ্জের ব্যবস্থাপনা বিভাগ আলাদা করা হলেও তারা স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। বরং অদক্ষ শীর্ষ কর্মকর্তাদের একটি চক্রের কারণে মেধাবীরা স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন। আট বছর আগে তালিকাভুক্ত কোম্পানিতে উদ্যোক্তা পরিচালকদের ন্যূনতম শেয়ার ধারণের বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হলেও তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে এসইসি। ২০১১ সাল থেকে পরিবর্তিত কমিশন বিভিন্ন সংস্কারের উদ্যোগ নিলেও তার প্রভাব বাজারে পড়েনি।

পুঁজিবাজার পরিস্থিতি নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে ডিএসইর পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বলেন, ‘এই বাজারে বিনিয়োগকারীর আস্থা সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। প্রথম কাজ হচ্ছে, বিনিয়োগকারীর আস্থা ফিরিয়ে আনা। তাদেরকে আশ্বস্ত করতে হবে, যে শেয়ারগুলো বাজারে আসছে, তা কিনে তারা ঠকবেন না। যে দামে বাজারে আসছে, তার নিচে অন্তত নামবে না। একটি কোম্পানির শেয়ারদর যখন ২-৩ টাকা হয়, তখন বুঝতে হবে প্রতিষ্ঠানটির কখনই কিছু ছিল না। যারা এসব বাজে শেয়ার বাজারে এনেছে, তাদের যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।’