দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা : শুরুটা দুর্দান্ত হলেও ২০১৯ সালের শেষটা মোটেও ভালো যায়নি পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের। বছরের প্রথম মাসটা বাদ দিলে বাকি সময়টা পতনের মধ্যে হাবুডুবু খেয়েছে পুঁজিবাজার। ফলে বছর জুড়েই বিনিয়োগকারীদের পুঁজি হারানোর আর্তনাদ করতে হয়েছে। বিনিয়োগকারীদের আর্তনাদ আর আহাজারির মধ্যে তলানিতে পতিত পুঁজিবাজার টেনে তুলতে নীতিনির্ধারকরা বেশ দৌড়ঝাঁপ করেছেন। দেয়া হয়েছে একের পর এক ছাড়। কিন্তু কোনো কিছুই টেনে তুলতে পারেনি পুঁজিবাজার। দিন যত গড়িয়েছে বাজার ততই তলানিতে ঠেকেছে।

অব্যাহত দরপতন আর তারল্য সংকটে বিনিয়োগকারীদের আস্থাও তলানিতে পৌঁছেছে। অনেক বিনিয়োগকারী পুঁজিবাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। এমন দুর্দিনে বাজার পতিত হলেও ২০২০ সালের পুঁজিবাজারের আলোর দেখা মিলবে বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, পুঁজিবাজার ভালো করতে স¤প্রতি বেশকিছু ভালো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এছাড়া অনেক ভালো কোম্পানির শেয়ারের দাম এখন অবমূল্যায়িত পর্যায়ে রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে পুঁজিবাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়াটাই স্বাভাবিক। ডিসেম্বর শেষে জানুয়ারিতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ বাড়তে পারে। তাদের বিনিয়োগ বাড়ালে অবশ্যই পুঁজিবাজার ভালো হবে মনে করছেন তারা।

পুঁজিবাজারের সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. বখতিয়ার হাসান দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণকে বলেন, পুঁজিবাজার ভালো করতে বেশকিছু ভালো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তবে বাজারে এগুলোর ইতিবাচক প্রভাব দেখা যাচ্ছে না। এর প্রধান কারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থা ও তারল্য সংকট। আস্থা ও তারল্য সংকট কাটানো গেলে বাজার স্বাভাবিকভাবেই ঘুরে দাঁড়াবে। আশা করি ২০২০ সালের পুঁজিবাজারে চমক থাকছে। এজন্য বিনিয়োগকারীদের ধৈর্য্যরে সাথে মোকাবেলা করতে হবে।

ডিএসইর পরিচালক রকিবুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, পুঁজিবাজার নিয়ে আমরা সবাই যদি নিজের জায়গা থেকে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার মধ্য থেকে কাজ করি তাহলে অবশ্যই পুঁজিবাজার ভালো হবে। কীভাবে বাজারের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানো যায়, সে বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বেশ পজেটিভ। তবে বাজার শক্তিশালী করতে হলে গুণগত পরিবর্তন আনতে হবে। বন্ড মার্কেট লেনদেনের আওতায় আনতে হবে। সেই সঙ্গে শক্তিশালী মিউচ্যুয়াল ফান্ড আনতে হবে।

ডিএসই ব্রোকারস অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) সভাপতি শাকিল রিজভী বলেন, ২০১৯ সালের পুঁজিবাজারের চিত্র ভয়াবহ ছিল। অধিকাংশ কার্যদিবস দরপতনের মধ্যে দিয়ে কাটছে। আশা করি ২০২০ সালের পুঁজিবাজার হবে স্থিতিশীল বাজার। কারণ বর্তমান বাজার কেনার জন্য উপযোগী সময়। অনেক ভালো কোম্পানির শেয়ারের দাম রিজেনেবল প্রাইসে রয়েছে। তবে কোম্পানির পারফরমেন্স বাজারের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে কোম্পানির প্রথম প্রান্তিক বা বার্ষিক পারফরমেন্স বিবেচনা করলে বেশির ভাগ কোম্পানির শেয়ার কেনার উপযোগী। আমার ধারণা, ডিসেম্বর মাসে হয়তো বাজার কিছুটা চাপের মধ্যে থাকবে। তবে জানুয়ারি থেকে ভালো হবে।

অর্থাৎ সা¤প্রতিক নেয়া কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপের কারণেই ২০১৯ সালের বিপরীত চিত্র দেখা যেতে পারে ২০২০ সালের পুঁজিবাজারে। যেমন: ১. মার্চেন্ট ব্যাংক এবং তাদের এমডিদেরকেও শেয়ার ব্যবসা করার অনুমতি দিয়েছে বিএসইসি যা বাজারের জন্য ইতিবাচক।

২. পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আইসিবির মত আর একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান হবে ২০ সালে। যা পুঁজিবাজারে মার্কেট মেকারের ভুমিকায় কাজ করবে।

৩. সঞ্চয় পত্র বিক্রি করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন শর্ত আরোপ করায় সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে ধ্বস নেমেছে যা পুঁজিবাজারের জন্য ইতিবাচক (চলতি অর্থ বছরের প্রথম তিন মাসেই (জুলাই- সেপ্টেম্বর ২০১৯) সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি কমেছে ৮ হাজার ৪১৪ কোটি টাকা যা গত ১০ বছরের মধ্যে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে এই নি¤œমুখী প্রবণতা এবারই প্রথম।

৪. শেনঝেন ও সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জের সমন্বয়ে চীনের উদ্যোগে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে সিডিএসইটি নামে নতুন ইনডেক্স চালু হবে আগামী ৩০ ডিসেম্বর সোমবার। আগামী ১ জানুয়ারি থেকে ডিএসই ওয়েবসাইটের হোমপেজে ইনডেক্সটি দেখা যাবে। বর্তমানে সূচকটিতে ৪০টি কোম্পানি রয়েছে। এর ফলে বাজারে চীনের বিনিয়োগ আসবে যা বাজারের জন্য খুবই ইতিবাচক।

৫. ২০২০ সাল থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংক গুলোর সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনা হবে যা পরোক্ষ ভাবে বাজারের জন্য ইতিবাচক হবে , কারণ ব্যাংক গুলো যখন কম সুদে ঋণ দিবে তখন তারাও চাইবে কম সুদে ( ৪-৬ শতাংশ) আমানত সংগ্রহ করতে, তখন অনেকেই এতো কম সুদে ব্যাংকে আমানত না রেখে পুজিবাজারে বিনিয়োগে আগ্রহী হবে।

৬. দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া ডিবিএ ( ডিএসই ব্রোকার্স এসোসিয়েশন ) এবং বিএমবিএ ( বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংক এসোসিয়েশন ) বাজার উন্নয়নের লক্ষ্যে ১২ সদস্যের একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করেছে যা বাজারের জন্য ইতিবাচক।

৭. শেয়ারবাজাকে বিদ্যমান সংকট থেকে বের করতে ৫ সদস্যের উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন কমিটি গঠন করেছে অর্থমন্ত্রনালয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয়, এনবিআর, আইসিবি, ডিএসইসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে বাজারকে স্থিতিশীল করতে এই কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটি সরকারকে তিন মাস পরপর পুঁজিবাজার উন্নয়নকল্পে সুপারিশ প্রদান করবে। এই কমিটি তার কাজ শুরু করলে পুঁজিবাজারে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে।

৮. ব্যাংক গুলোর প্রভিশনিং ১০০ শতাংশের যায়গায় ৫০ শতাংশ করা হয়েছে ফলে ব্যাংক গুলোতে তারল্য প্রবাহ বাড়বে এবং ব্যাংক গুলোর এডি রেশিও বাড়ানো হয়েছে ফলে বেসরকারী খাতে ঋণের প্রবাহ কিছুটা বাড়বে যা পরোক্ষ ভাবে পুঁজিবাজারের জন্য অবশ্যই ইতিবাচক হবে।

৯. প্রধান মন্ত্রীর নির্দেশে আগামী ০২/০১/২০২০ সালে মাননীয় অর্থমন্ত্রী ডিএসই এর সাথে বাজার নিয়ে এক জরুরী বৈঠকে বসবে সেখান থেকে বাজার উন্নয়নে আরো কিছু ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আসবে।

১০. এছাড়াও চলতি ডিসেম্বর মাসে অনেক হাউজ লোন এডজাস্ট করার জন্য বাধ্য হয়ে লসে শেয়ার সেল করে লোন এডজাস্ট করেছে। ২০২০ সালে তারা সিঙ্গেল ডিজিটে কম সুদে আরো অনেক বেশী লোন পাবে এবং সেই টাকা দিয়ে তারা আবার শেয়ার বাই করবে, ফলে বাজারে একটি বাই প্রেশার থাকবে যার কারনেও বাজার ইতিবাচক ধারায় ফিরবে।

১১. বিনিয়োগকারীদের আস্থা না থাকা নিয়ন্ত্রক সংস্থার শীর্ষ পদেরও মেয়ার শেষ হবে ২০২০ সালে। ফলে পরিবর্তন অনিবার্য। যা বিনিয়োগকারীদের মনোবল বাড়াতে ভূমিকা রাখবে। সব মিলায়ে তলানীতে থাকা পুঁজিবাজারের আকাশে কালো মেঘ কেটে নতুন বছরে (২০২০ সালে) দেখা যেতে পারে আলোর ঝলকানি। আর এসব ইতিবাচক পদক্ষেপে ২০২০ সালে পুঁজিবাজার কিছুটা ইতিবাচক ধারায় ফিরবে, এমনটাই প্রত্যাশ সবার।