দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা : ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) আসন্ন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়রপ্রার্থী হওয়ার লড়াইয়ে হেরে গেছেন বর্তমান মেয়র সাঈদ খোকন। দক্ষিণে নৌকার নতুন মাঝি ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস। ইতোমধ্যে সাংসদের পদ থেকে ইস্তফাও দিয়েছেন এ আইনজীবী। কেন নতুন মাঝির হাতে হাল তুলে দিয়েছে ক্ষমতাসীন দলটি? কেন মাইনাস হলেন বর্তমান মাঝি?- সঙ্গত কারণেই এসব প্রশ্ন এখন সামনে চলে এসেছে।

রাজনীতিবিষয়ক বিশ্লেষকরা মনে করেন, গত সাড়ে চার বছর মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে সাঈদ খোকন তার ঝুড়িতে কোনো সুফল তুলে নিতে পারেননি; বরং তাতে যুক্ত হয়েছে তিক্ত অনেক ব্যর্থতা। বিস্তর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি নির্বাচনকালে। সেই তুলনায় বাস্তবায়ন হয়েছে খুবই কম।

এ ছাড়া রাজধানীজুড়ে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ার পর দায়িত্বশীল পদে থেকেও বেফাঁস ও অগ্রহণযোগ্য মন্তব্য করা এবং ডেঙ্গু প্রতিরোধে ব্যর্থতা; নিয়োগবাণিজ্য ও টেন্ডারপ্রাপ্তিতে কমিশন, নাগরিক সুবিধা প্রদানের পরিবর্তে ভোগান্তি সৃষ্টি, দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে দূরত্ব, ক্যাসিনোকাণ্ডে সম্পৃক্ত যুবলীগ নেতাদের নৈকট্য, দলের ভেতরে কোন্দল সৃষ্টিসহ অনেক কারণেই সমালোচনার তীরে বিদ্ধ হয়েছেন তিনি। আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডও ঢাকা দক্ষিণে দলের মেয়রপ্রার্থী পরিবর্তনের পক্ষে ছিল সরব। এরই আলোকে আলো পড়েছে শেখ ফজলে নূর তাপসের ওপর; যোগ-বিয়োগের অঙ্কে মাইনাস হয়ে গেছেন সাঈদ খোকন।

পাঁচ সমস্যা সমাধানে অগ্রাধিকার ও ১০টি অঙ্গীকার নিয়ে ২০১৫ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে ডিএসসিসি নির্বাচনে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন সাঈদ খোকন। অঙ্গীকারগুলো ছিল- ডিজিটাল মহানগরী, শিক্ষার সুযোগ সবার জন্য অবারিত করা, বস্তি উন্নয়ন ও দলিত হরিজন সম্প্রদায়ের মানবিক মর্যাদা ও সুযোগের সমতা, আবাসন সমস্যা সমাধানে জরুরি পদক্ষেপ, ঐতিহ্য সংরক্ষণ, অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধ, ক্রীড়া ও চিত্তবিনোদন, কামরাঙ্গীরচরের তিনটি ওয়ার্ড, ধর্মপালন ও নগর প্রশাসন প্রতিষ্ঠা।

ইশতেহারে প্রাধান্য দেওয়া মহানগরীর পাঁচটি প্রধান সমস্যা হলো- যানজট নিরসন, দূষণমুক্ত, নাব্য ও নিরাপদ বুড়িগঙ্গা, পানি, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধান, পরিচ্ছন্ন, দূষণমুক্ত ও স্বাস্থ্যকর মহানগরী, দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং নাগরিকদের নিরাপদ জীবন নিশ্চিত করা।

নাগরিকদের নিয়ে কাজ করেন এমন বিভিন্ন সংগঠনের শীর্ষ দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বলছেন, নির্বাচনের আগে সাঈদ খোকন অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ঢাকাকে বদলে যাওয়া নগরী গড়ার সংকল্পের কথা বলেছিলেন। তবে মেয়াদপূর্তির পর দেখা যায়, সে বিষয়ে অগ্রগতি অনেক কম। উল্টো সিটি মেয়রের আওতাধীন বিভিন্ন কাজেও কমে এসেছে গতি। বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে দীর্ঘসূত্রতার সৃষ্টি হয়েছে। অনেক প্রকল্পে বছর বছর মেয়াদ বেড়েছে। বেড়েছে প্রকল্প ব্যয়ও। সাঈদ খোকন নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণার সময় জানিয়েছিলেন- অবাস্তব, কল্পনাবিলাসী ও আকাশকুসুম কোনো ইশতেহার ঘোষণা করেননি। এটি বাস্তবায়ন করা অবশ্যই সম্ভব। এ অঙ্গীকার জীবনের বিনিময়ে হলেও তিনি বাস্তবায়ন করবেন।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্র বলছে, সাঈদ খোকন মেয়র হিসেবে পুরো মেয়াদ দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেয়েও ব্যর্থ হয়েছেন। কিন্তু এ সময় ডেঙ্গু পরিস্থিতির অবনতি ও বেফাঁস কিছু মন্তব্যের কারণে অনেকবার নেতিবাচক খবরের শিরোনাম হয়েছেন তিনি। দলীয় রাজনীতিতেও কোন্দলে জড়িয়ে পড়েন, যেটি ক্ষমতাসীন দলের ইমেজকে নষ্ট করেছে। এ ছাড়া মেয়র হিসেবে খোকন এমন অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, যা একা মেয়রের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে যেসব কাজ মেয়র চাইলে করতে পারতেন, তিনি সেসব কাজও সম্পন্ন করতে পারেননি।

গত ২৫ জুলাই রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে এক অনুষ্ঠানে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যাকে ‘গুজব’ বলে অবহিত করেন মেয়র খোকন। তিনি বলেন, মশা নিয়ে রাজনীতি কাম্য নয়। সাড়ে তিন লাখ আক্রান্তের যে তথ্য এসেছে, সেটি কাল্পনিক তথ্য। ছেলেধরা আর সাড়ে তিন লাখ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত একই সূত্রে গাঁথা। মেয়রের এমন মন্তব্যের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ দলের ভেতরে সমালোচনার ঝড় ওঠে। বিপুলসংখ্যক মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলেও এর সমাধানে তড়িৎ পদক্ষেপ নিতে পারেননি তিনি। প্রায় একশর অধিক মানুষ মারাও যায় ডেঙ্গুতে। অভিযোগ ওঠে নিম্নমানের মশার ওষুধ ছিটানোর। এসব মশার ওষুধ ক্রয়েও অনিয়মের অভিযোগ ওঠে।

এর আগে ২০১৭ সালের ১৬ নভেম্বর আজিমপুরের পার্ল হারবাল কমিউনিটি সেন্টারের পাশে কর্মীসমাবেশ ডাকে আওয়ামী লীগ। তার পাশেই ঢাকা দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন পাল্টা কর্মসূচি দেন। পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি দেওয়ার মধ্যেই সমাবেশস্থলের সামনে সিটি করপোরেশনের ট্রাকভর্তি করে ময়লা রেখে যায়। ওই ঘটনার জন্য মেয়র সাঈদ খোকনকেই দোষারোপ করা হয়। এ সময় মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন তিনি। এ নিয়েও দলীয়ভাবে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন সাঈদ খোকন।

গত পাঁচ বছরে রাজধানীতে যানজট বেড়েছে শুধু, কমেনি। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, দক্ষিণ সিটি করপোরেশন যানজট নিরসনে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপও নেননি। অপরিচ্ছন্নতা, দূষণ ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিলেও তার কোনো বাস্তবায়ন হয়নি। চলতি বছর একাধিকবার বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহরের তালিকার শীর্ষে উঠে আসে ঢাকা।

তারা আরও বলছেন, রাজধানীর ফুটপাত দখলমুক্ত করার প্রুতিশ্রুতি থাকলেও সেই প্রক্রিয়াও আর সামনে এগোয়নি। উল্টো হকার উচ্ছেদ করতে গেলে প্রতিবাদের মুখে পড়েন তিনি। এ সময় মেয়রের সহযোগী ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাব্বির আহমেদ অস্ত্র হাতে আক্রমণ চালান হকারদের ওপর। এ ছবি ভাইরাল হয়। এতে দল হিসেবে ইমেজ সংকটে পড়ে আওয়ামী লীগ।

দক্ষিণ সিটি করপোরেশন হকারদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে নগরীর পাঁচটি স্থানে ‘হলিডে মার্কেট’ চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর মধ্যে দুটি মার্কেট চালু হলেও এখন তাও বন্ধ। অন্যদিকে হকারদের উচ্ছেদ করে তাদের পুনর্বাসনের জন্য বেশ কয়েকটি প্রকল্প চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তবে সে উদ্যোগও আর আলোর মুখ দেখেনি।

২০১৬ সালে ‘ঢাকা ইন্টিগ্রেটেড আরবান ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড স্মার্ট সিটি ম্যানেজমেন্ট প্রজেক্ট’ নামে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ও বিএমডিএফের আর্থিক সহায়তায় বুড়িগঙ্গা নদীর দুই তীর সংরক্ষণ এবং সৌন্দর্যবর্ধনে উদ্যোগ নিয়েছিল ডিএসসিসি। তবে সেই উদ্যোগও আর বাস্তবায়ন হয়নি।

২০১৫ সালের সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পর নগরের গুরুত্বপূর্ণ ৫০টি গণপরিসরে ‘বিনামূল্যে ইন্টারনেট বা ফ্রি ওয়াইফাই জোন’ করার ঘোষণা দেন সাঈদ খোকন। ২০১৬ সালের ১১ মে লালবাগ কেল্লার ভেতর একটি ওয়াইফাই জোন উদ্বোধন করলেও পরে আর এ প্রক্রিয়া এগোয়নি। উল্টো উদ্বোধন করা জোনটিও বন্ধ হয়ে যায়।

অগ্রাধিকার প্রকল্পে বস্তি উন্নয়নের কথা বলা হলেও বস্তি উন্নয়নে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি গত পাঁচ বছরে। এদিকে ২০১৭ সালের জুনে ‘জলসবুজে ঢাকা’ নামে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে ডিএসসিসির আওতাধীন ৩১টি পার্ক ও মাঠ উন্নয়নে কাজ শুরু করে ডিএসসিসি। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল।

তবে সূত্র জানায়, মাত্র তিনটা পার্ক ও মাঠের সংস্কারকাজ শেষে উদ্বোধন করা হয়েছে। বাকি মাঠ ও পার্কের সংস্কারকাজ এখনো শেষ হয়নি। এমনকি কয়েকটি পার্ক ও মাঠ বেড়া দিয়ে বন্ধ করে রাখা হলেও কাজই শুরু করতে পারেনি। কয়েকটি পার্ক ও মাঠের উন্নয়নের কাজে দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে প্রকল্প ব্যয় ও মেয়াদ। অগ্নিকাণ্ড রোধে অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা বলেছিলেন সাঈদ খোকন। কিন্তু চলতি বছরে চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ৭১ জন প্রাণ হারানোর পরও অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। এখনো পুরান ঢাকায় দাহ্য ও ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিকের কারখানা ও গুদামের ছড়াছড়ি।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের শিক্ষক ও নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক আকতার মাহমুদ বলেন, সাঈদ খোকন যথাযথ নেতৃত্ব দিতে পারেননি। অতিরিক্ত প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বলে অনেক কিছুই হয়নি। এমন অনেক প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছিলেন, যা বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়ায় প্রকৃতপক্ষে তার একার পক্ষে বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। তবু তিনি নেতৃত্ব দিয়ে কাজটি হয়তো এগিয়ে নিতে পারতেন। তাতেও ব্যর্থ হয়েছেন। ঢাকা উত্তরের মেয়র প্রয়াত আনিসুল হক যেমন অনেক উদ্যোগ যৌথ হওয়ার পরও নেতৃত্বগুণে নিজেই সেগুলো সফল করতে পেরেছিলেন।

এদিকে সাঈদ খোকনকে আওয়ামী লীগ মনোনয়ন না দেওয়ায় ফুলবাড়িয়ার মার্কেট ব্যবসায়ীরা আনন্দ মিছিলের পাশাপাশি মিষ্টিও বিতরণ করেছেন। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ও দলীয় হাইকমান্ডকে তাদের গৃহীত সিদ্ধান্তের জন্য অভিনন্দন জানান ব্যবসায়ীরা।

প্রসঙ্গত, ঢাকা সিটির মেয়র পদে দলের মনোনয়ন বিষয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, আমরা বিচার বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করছি। নেত্রী (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) নিজের সোর্স থেকেও খোঁজ নিয়েছেন, গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট নেওয়া হয়েছে। যারা প্রার্থী হওয়ার জন্য আবেদন করেছিলেন, তাদের ব্যাকগ্রাউন্ড, গ্রহণযোগ্যতা, জনপ্রিয়তা যাচাই করে উইনেবল ও ইলেকট্যাবল বিবেচনা করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মনোনয়ন বোর্ড সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।