আরিফুর রহমান ও শহিদুল ইসলাম, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা:  পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত অধিকাংশ ব্যাংকের বছর শেষে বৃদ্ধি পেয়েছে পরিচালন মুনাফা। যদিও এটি প্রকৃত মুনাফা নয়। বিপুল অঙ্কের খেলাপি ঋণের বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন সংরক্ষণ এবং আয়কর প্রদানসহ বিভিন্ন খরচ বাদ দিলে নিট মুনাফা অনেক কমে যাবে। ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফায় শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে বলে মনে করেন ব্যাংকিং খাত সংশ্লিষ্টরা।

তাদের মতে, অধিকাংশ ব্যাংকই পরিচালন মুনাফা ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে স্থগিত সুদ হিসাবকে আয় হিসাবে দেখানো এবং খেলাপি ঋণকে নিয়মিত ঋণ হিসাবে দেখিয়ে এ কাজ করেছে বলে মনে করেন তারা।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, পরিচালন মুনাফায় প্রকৃত তথ্য আসে না। এখানে কিছুটা শুভঙ্করের ফাঁকি থাকে। ব্যাংকের প্রকৃত মুনাফা হল নিট মুনাফা। তবে বিদায়ী বছরে ব্যাংকের পরিচালন মুনাফার উল্লম্ফন হয়েছে। প্রায় প্রতিটি ব্যাংকেরই আগের বছরের চেয়ে মুনাফা বেড়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফার হিসাবে শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে। পরিচালকদের চাপে নির্ধারিত ল্যমাত্রা অর্জনে ব্যাংকারদের কর্মদতা দেখাতে ও পদোন্নতি নিশ্চিত করতে ব্যাংকাররা মুনাফা বাড়িয়ে দেখাচ্ছেন। এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে অনেক ব্যাংকে মুনাফার হিসাবে ফাঁকির ঘটনা ধরা পড়ে। পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের বাড়তি মুনাফা বাদ দিতে বাধ্য করেছে। ফলে অনেক ব্যাংকের মুনাফা কমেছে।

যেভাবে মুনাফায় কারসাজি : ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফার একটি বড় অংশই চলে যাচ্ছে দুর্নীতির মাধ্যমে সৃষ্ট খেলাপি ঋণের দায় মেটাতে। জালিয়াতির মাধ্যমে যেসব ঋণ দেয়া হচ্ছে, সেগুলো আদায় হচ্ছে না। ফলে এগুলো খেলাপিতে পরিণত হয়ে ব্যাংকের প্রভিশন সংরণের পরিমাণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। এতেই য়ে যাচ্ছে মুনাফা।

এর বাইরেও ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণকে নিয়মিত দেখিয়ে, খেলাপি ঋণের বিপরীতে সুদ আয় দেখিয়ে, আমানতের সুদের বিপরীতে সংরতি প্রভিশন ও ঋণের বিপরীতে সম্ভাব্য সুদকে আয় হিসাবে দেখিয়ে মুনাফার চেহারা বাড়াচ্ছে। এ ছাড়া বেআইনিভাবে গ্রাহকদের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের চার্জ আদায় করে মুনাফার অঙ্ক বাড়াচ্ছে তারা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে তদন্তে ধরা পড়ার পর এগুলো ফেরত দেয়ার নজিরও রয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত বছরের (২০১৮) জুন থেকে সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার ঘোষণা আসে। কয়েকটি ব্যাংক এটি কার্যকরেরও ঘোষণা দেয়। আর সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনলে ব্যাংকের বেশি লাভ করার সুযোগ থাকে না। তার পরেও প্রায় সব ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা বেড়েছে। ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মুনাফা করেছে বেসরকারি খাতের ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। ২০১৯ সাল শেষে ২ হাজার ৯৭৫ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা হয়েছে ব্যাংকটির। তবে আগের বছরে ব্যাংটির পরিচালন মুনাফা ছিল ২ হাজার ৭৭০ কোটি টাকা।

সূত্র জানায়, আয় থেকে ব্যয় বাদ দিয়ে যে মুনাফা থাকে, সেটিই কোনো ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা। পরিচালন মুনাফা থেকে খেলাপি ঋণ ও অন্যান্য সম্পদের বিপরীতে প্রভিশন (নিরাপত্তা সঞ্চিতি) এবং সরকারকে কর দিতে হয়। প্রভিশন ও কর-পরবর্তী এ মুনাফাই হল একটি ব্যাংকের প্রকৃত বা নিট মুনাফা। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিচালন মুনাফার ওপর ভিত্তি করে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের কোনো সিদ্ধান্ত না নেওয়াই ভালো। কারণ পরিচালন মুনাফা থেকে নিট মুনাফা বা প্রকৃত মুনাফার ধারণা পাওয়া কঠিন। পরিচালন মুনাফা থেকে খেলাপি ও মন্দ ঋণের বিপরীতে সঞ্চিতি রাখা এবং আয় কর পরিশোধের পর প্রকৃত মুনাফা বা নিট মুনাফার পরিমাণ জানা সম্ভব।