দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: বিগত কয়েক বছরে অর্থনীতিতে যে গতির সঞ্চার হয়েছিল, ২০১৯ সালে এসে যেন সে গতি অনেকটাই থমকে যায়। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স ছাড়া অর্থনীতির প্রায় সব সূচকই এখন নেতিবাচক। রফতানি বাণিজ্যে ধস নেমেছে, রাজস্ব আদায় কমছে, মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী, আমদানি কমছে, তারপরও চাপে আছে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা বিনিয়োগে। প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নিয়ে ডুবতে বসেছে ব্যাংক খাত। পুঁজিবাজারও পতনের ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না।

টানা চার মাস ধরে রফতানি আয় কমায় ২০১৯ সালে বড় ধাক্কা খেয়েছে অর্থনীতির অন্যতম প্রধান এই সূচক। আগামী দিনগুলোতেও ‘এই নেতিবাচক’ ধারা অব্যাহত থাকবে এমন আশঙ্কার কথা প্রকাশ করে সরকারের সহায়তা চেয়েছে রফতানি বাণিজ্যের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্প মালিকরা। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যে দেখা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে ১ হাজার ৫৭৭ কোটি ৭০ ডলারের পণ্য রফতানি করেছে বাংলাদেশ।

গত বছরের একই সময়ে রফতানির অঙ্ক ছিল ১ হাজার ৭০৭ কোটি ৩৭ লাখ ডলার। এবার এই পাঁচ মাসে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ হাজার ৮০৫ কোটি ডলার। এ হিসাবে চলতি বছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে রফতানি আয় কমেছে ৭ দশমিক ৬ শতাংশ। আর লক্ষ্যের চেয়ে কমেছে ১২ দশমিক ৫৯ শতাংশ। সর্বশেষ নভেম্বর মাসে রফতানি আয় কমেছে প্রায় ১১ শতাংশ। এই মাসে লক্ষ্যের চেয়ে আয় কমেছে ১৮ শতাংশ।

বেশ কয়েক মাস ধরেই আমদানিতে ধীরগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এর অর্থ হলো, দেশের মানুষের ভোগ ব্যয় কমেছে এবং নতুন শিল্প স্থাপনে বিনিয়োগ কমেছে। গত অর্থবছর আমদানি ব্যয় আগের বছরের চেয়ে ১ দশমিক ৭৮ শতাংশ বেড়েছিল। কিন্তু চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে আমদানি ব্যয় ৩ দশমিক ১৭ শতাংশ কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, এই চার মাসে শিল্প স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় মূলধনী যন্ত্রপাতি (ক্যাপিটাল মেশিনারি) আমদানি কমেছে প্রায় ১০ শতাংশ। জ্বালনি তেল আমদানি কমেছে ১৫ শতাংশ। আর শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমেছে প্রায় ২০ শতাংশ।

রাজস্ব খাতে মন্দা : চলতি অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে ৬৫ হাজার ৯৬ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হয়েছে, যা লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা কম। গত অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে আদায় হয়েছিল ৬২ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের এই চার মাসে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪ দশমিক ৫ শতাংশ বেশি রাজস্ব আদায় হলেও লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অনেক পিছিয়ে আছে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব খাতে আয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। এই অঙ্ক বিদায়ি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের ১৯ শতাংশের বেশি। আর মূল বাজেটের চেয়ে প্রায় ৪০ শতাংশ বেশি।

ব্যাংক খাত : ২০১৯ সালে ব্যাংক খাত চরম অস্বস্তিতে কেটেছে। ভয়াবহ তারল্য সঙ্কট, সরকারের মাত্রাতিরিক্ত ব্যাংক ঋণ ও এক অঙ্কে সুদ হারসহ নানা বিষয়ে হ য ব র ল অবস্থা ছিল ব্যাংকিং খাতে। অন্যদিকে নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ঋণ প্রদানে সীমাহীন দুর্নীতিতে ভয়াবহ তারল্য সঙ্কট এবং পিপলস লিজিং অবসায়নও ছিল আলোচনার তুঙ্গে। এত কিছুর পরেও নতুন করে ব্যাংকের অনুমোদনে ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্টদের মধ্যে ছিল সমালোচনার ঝড়।

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি বেসরকারি কয়েকটি ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতিও আলোচনায় আসে। বছর জুড়ে ধারাবাহিকভাবে বাড়া খেলাপি ঋণ এখন ব্যাংকগুলোর বিষফোঁড়া। অর্থমন্ত্রীর ‘খেলাপি ঋণ এক টাকাও বাড়বে না’ এমন হুঁশিয়ারির পরও খেলাপি ঋণে উল্টো যাত্রা ছিল। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ৯৩ হাজার ৯৯১ কোটি টাকা। এ হিসাবে গত ৯ মাসে দেশে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২২ হাজার ৯ কোটি টাকা। বর্তমানে ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে, যা এ যাবৎকালের রেকর্ড।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, গত বছর অর্থনীতির খাতগুলোর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ গেছে ব্যাংকিং খাত এবং রাজস্ব খাত। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ সবচেয়ে বেশি ভুগিয়েছে ব্যাংকিং খাতকে। খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে সরকার তেমন কোনো পদক্ষেপই নেয়নি। উল্টো ঋণ খেলাপিদের নানা রকম সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছে।

পিপলস লিজিং : অনিয়ম, দুর্নীতি, লুটপাট আর অব্যবস্থাপনার আখড়া হিসেবে পরিচিত পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসকে প্রথমবারের মতো অবসায়নের সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি বছরের ১৪ জুলাই পিপলস লিজিং অবসায়নের জন্য আদালতে মামলা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ ছাড়া অনিয়মের দায়ে বহিষ্কার করা হয় প্রতিষ্ঠানের ৯ পরিচালককে। বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে ৫৭০ কোটি টাকা বের করে নেন প্রতিষ্ঠানটির পরিচালকরা।

বেসরকারি বিনিয়োগে ভাটা : নানা উদ্যোগের পরও আশানুরূপ বাড়ছে না বেসরকারি ঋণ। গত কয়েক মাস ধরে ঋণ প্রবৃদ্ধির হার ধারাবাহিক কমছে। চলতি অর্থবছরের অক্টোবরে ঋণ প্রবৃদ্ধি ১০ দশমিক ০৪ শতাংশ হয়েছে। সেপ্টেম্বর ছিল ১০ দশমিক ৬৬ শতাংশে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খেলাপি ঋণ লাগামহীনভাবে বাড়ছে। এ কারণে ব্যাংকগুলোতে বাড়তি নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) রাখতে হচ্ছে। অন্যদিকে আশানুরূপ আমানত পাচ্ছে না ব্যাংকগুলো। ফলে ব্যাংকগুলোর কাছে এখন পর্যাপ্ত নগদ অর্থ নেই। বেসরকারি বিনিয়োগ কমে যাওয়ার এটি একটি অন্যতম কারণ।

তিন ব্যাংকের অনুমোদন : এ বছরের শুরুতে আরও তিনটি বেসরকারি ব্যাংকের অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকগুলো হচ্ছেÑ বেঙ্গল কমার্শিয়াল, পিপলস ও সিটিজেন ব্যাংক। কিন্তু প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে না পারায় বারবার হোঁচট খাচ্ছে নতুন ব্যাংকের চ‚ড়ান্ত অনুমোদন। বাংলাদেশ ব্যাংকের মৌন সম্মতি পাওয়ার পর ইতোমধ্যে পেরিয়ে গেছে ১০ মাস। এত দিনেও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিতে পারেনি ব্যাংকগুলো। আটকে আছে নীতিগত সিদ্ধান্তে।

অস্থির ডলারের বাজার : চলতি বছরের শুরু থেকে অস্থির ডলারের বাজার। সঙ্কটের কারণে হু হু করে বেড়েছে ডলারের দাম। অন্যদিকে দুর্বল হয়েছে টাকার মান। বছরের প্রথম আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলারের দর নির্ধারণ ছিল ৮৩ টাকা ৯০ পয়সা। অর্থাৎ পণ্য আমদানিতে প্রতি ডলারে ব্যয় করতে হয় ৮৩ টাকা ৯০ পয়সা। চলতি বছরে দফায় দফায় দাম বেড়ে ডলার ৮৪ টাকা ৯০ পয়সা দাঁড়িয়েছে। তবে সাধারণ মানুষ, যারা ভ্রমণ করতে বিদেশে যাচ্ছেন তাদের ৮৭-৮৮ টাকা দরে কিনতে হচ্ছে ডলার।

ক্যাসিনো অভিযানে জব্দ ব্যাংক হিসাব : ক্লাবের নামে অসামাজিক কার্যকলাপ, ক্যাসিনো, সন্ত্রাস, ঘুষ, টেন্ডারবাজির ঘটনায় অর্জিত অর্থ ও সম্পদের উৎস জানতে চতুর্মুখী তদন্ত চলছে। নজর রাখা হয়েছে আলোচিত ব্যক্তিদের ব্যাংক হিসাব, ব্যাংকের লকারে থাকা সম্পদ, তাদের প্রতিষ্ঠান ও নামে-বেনামে থাকা সম্পদ ও আয়কর নথির ওপর। এরই মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে রাজস্ব ফাঁকি ও অর্থ পাচারের বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। একই ইস্যুতে মাঠে আছে দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক)। কোটি কোটি টাকা পাচারের তথ্য সংগ্রহে কাজ করছে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা। আর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এ তিন সংস্থার চাহিদামাফিক তথ্য সরবরাহ করা হচ্ছে।

পুরো বছরের ঋণ পাঁচ মাসেই : এদিকে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার পরিমাণ বেড়েই চলেছে। চলতি অর্থবছরের পুরো সময়ে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ধরা হয়েছিল। কিন্তু তার প্রায় পুরোটা নেওয়া হয়ে গেছে পাঁচ মাসেই। ১ জুলাই থেকে ৯ ডিসেম্বরের মধ্যে সরকার ব্যাংক থেকে ধার নিয়েছে ৪৭ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা।

সব মিলিয়ে ব্যাংক খাত থেকে সরকারের নেওয়া মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৫ হাজার ২৩৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ১ লাখ ১১ হাজার ৪১২ কোটি টাকা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ৪৩ হাজার ৮২২ কোটি টাকা নেওয়া হয়েছে।