দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদে বিতর্কিত ব্যক্তি সানাউল হককে এমডি করতে মরিয়া এবার ডিএসই।  ডিএসই এক পরিচালকের প্রভাবে পরবর্তী ধাপে আইসিবির সাবেক এমডি সানাউল হককে ডিএসই এমডি পদে বসাতে নানা মিশন নিয়ে তিনি মাঠে নামছেন। আইসিবির সাবেক ওই এমডিকে ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তলব করার ঘটনাও আছে। তার দায়িত্বরত অবস্থায় ঋণ জালিয়াতির ঘটনা ঘটে।

ঋণের নামে ২৩৮ কোটি টাকা লুটসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের(দুদক) তালিকায় থাকা সেই কাজী ছানাউল হকই হচ্ছেন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ব্যবস্থাপনা পরিচালক(এমডি)। তিনি ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)’র সিকিউরিটিজ ট্রেডিং কোম্পানির মার্জিন একাউন্টের বিপরীতে ঋণের নামে ২৩৮ কোটি টাকা লোপাট করেন।

সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিকে বাদ দিয়ে তাকে নিয়োগ দিতে এরই মধ্যে সাক্ষাৎকারও গ্রহণ করেছে ডিএসইর এনআরসি কমিটি। তার সঙ্গে আরেক জনের নাম ডিএসইর পর্ষদে পাঠাবে। সেখান থেকে প্রস্তাব পাশ করে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে(বিএসইসি) চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য পাঠাবে। তার জন্য স্বয়ং ডিএসইর এনআরসি কমিটিতে থাকা একজন পরিচালক তদবির চালাচ্ছেন।

শেয়ার ব্যবসায় জড়িত যেসব লোক ঋণ পাওয়ার যোগ্য নন তাদের ঋণ দেয়া, যাকে ২৫ লাখ টাকা ঋণ দেয়ার কথা তাকে কয়েক কোটি টাকা করে ঋণ দেয়ার ঘটনা ঘটে। এসবের মাধ্যমে সরকারের ১৩৭ কোটি টাকা ক্ষতি হয় বলে অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে।

উল্লেখ্য, অনিয়মের অভিযোগ থাকা ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কাজী সানাউল হককে এমডি করতে ডিএসই’র একজন শেয়ারহোল্ডার পরিচালক মরিয়া প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ওই শেয়ারহোল্ডার পরিচালক ডিএসই’র এমডি নিয়োগ-সংক্রান্ত ‘নমিনেশন অ্যান্ড রিমিউনারেশন কমিটিতে’ (এনআরসি) রয়েছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ডিএসই’র নতুন এমডির জন্য মঙ্গলবার ছয়জনকে সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকা হয় । এদের মধ্যে ছিলেন আইসিবির সাবেক এমডি কাজী সানাউল হক, যমুনা ব্যাংকের সাবেক এমডি শফিকুল আলম, ন্যাশনাল ব্যাংক ও ডিএসই’র সাবেক এমডি শরিফুল ইসলাম, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের ডিএমডি রেজাউর রহমান, জনতা ব্যাংকের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) শরীয়ত উল্লাহ এবং গ্লাক্সোস্মিথক্লাইনের সাবেক সচিব ও সিএফও সারোয়ার খান।

এদের মধ্যে ডিএসই’র সাবেক এমডি শরিফুল ইসলাম এবং জনতা ব্যাংকের নিরীক্ষক পরামর্শক শরীয়ত উল্লাহ সাক্ষাৎকার দিতে আসেননি। বাকি চারজনের সাক্ষাৎকার নিয়ে ডিএসই’র নমিনেশন অ্যান্ড রিমিউনারেশন কমিটি কাজী সানাউল হক এবং যমুনা ব্যাংকের সাবেক এমডি শফিকুল আলমকে সংক্ষিপ্ত তালিকায় রেখেছেন। আগামী বৃহস্পতিবার (৯ জানুয়ারি) ডিএসই’র বোর্ড সভায় তাদের দুজনের নাম প্রস্তাব করা হবে এবং বোর্ড সভার মাধ্যমে একজনকে চূড়ান্ত করা হবে।

ডিএসই’র সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, সংক্ষিপ্ত তালিকায় দুজনকে রাখা হলেও কাজী সানাউল হককেই এমডি করতে চায় ডিএসইর প্রভাবশীল একটি পক্ষ। অথচ আইসিবির এমডি থাকাবস্থায় কাজী সানাউল হকের বিরুদ্ধে ঋণ জালিয়াতির অভিযোগ রয়েছে।

এ বিষয়ে ডিএসই’র একাধিক সদস্য বলেন, কাজী সানাউল হকের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। তার বিষয়ে দুদক তদন্ত করছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হোক বা না হোক তিনি বিতর্কিত। এমন ব্যক্তিকে ডিএসই’র এমডি করার চেষ্টা চলছে বলে শুনেছি। এটা পুঁজিবাজারের জন্য ভালো ফল বয়ে আনবে না।

তারা বলেন, বর্তমানে পুঁজিবাজার একটি ক্রিটিক্যাল সময় পার করছে। এ মুহূর্তে ডিএসই’র এমডি হিসেবে একজন স্বচ্ছ ভাবমূর্তির মানুষ দরকার। কারও ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের জন্য ডিএসই’র এমডি বাছাই করা ঠিক হবে না।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে ডিএসই’র নমিনেশন অ্যান্ড রিমিউনারেশন কমিটির চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি সিদ্দিকুর রহমান মিয়া বলেন, এমডি পদের জন্য আমরা ছয়জনকে সাক্ষাৎকারে ডেকেছিলাম। এদের মধ্যে চারজন সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। তাদের থেকে দু’জন আমরা বাছাই করেছি। এ দু’জনের নাম আগামী বৃহস্পতিবারের পরিচালনা পর্ষদ সভায় তোলা হবে। সেখানেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। কোন দু’জনকে রাখা হয়েছে? এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, এটি কনফিডেনশিয়াল। তাই এখন তাদের নাম প্রকাশ করা যাচ্ছে না। বোর্ড সভার পর সিদ্ধান্ত জানানো হবে।

কাজী সানাউল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি সাক্ষাৎকার দিয়েছি। সিদ্ধান্ত নেবে ডিএসই। তাদের কী সিদ্ধান্ত তা তো আমি জানি না। যদি আমি ডিএসই’র এমডি হই, তারপর আমার পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলা যাবে।’

আইসিবির ঋণ জালিয়াতির অভিযোগের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আইসিবির ঋণ জালিয়াতির যে অভিযোগ উঠেছিল তা সঠিক নয়। বিষয়টি রি-ইনকোয়ারি (পুনঃতদন্ত) করে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয়েছিল সবাইকে আদালত থেকে খালাস দেয়া হয়েছে।

ছানাউল হকের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ: ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত আইসিবির এমডি হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। সে সময় কাজী ছানাউল হক আইসিবি সিকিউরিটিজ ট্রেডিং কোম্পানির সিইও। দায়িত্ব পালনের সময় ৫১৪ মার্জিন একাউন্ট থেকে বিভিন্নভাবে ২৩৮ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনা ঘটে। আইসিবি সিকিউরিটিজ ট্রেডিং কোম্পানি লিমিটেডে (আইএসটিসিএল) ২৩৭ কোটি ৮৩ লাখ টাকার লুটে জড়িত হিসেবে তৎকালীন সিইও কাজী ছানাউল হক, উপ-প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা টিপু সুলতান ফারাজীসহ ছয়জনকে চিহ্নিত করা হয়।

দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়, আইএসটিসিএল এর প্রধান কার্যালয়ের ১৯১টি পিটি হিসাবে ২০০৮ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ২৩৭ কোটি ৮২ লাখ ৭০ হাজার টাকার মার্জিন ঋণ দেওয়া হয়। মূলত ২০০৯, ২০১০ ও ২০১১ সালের প্রথম দিকেই মার্জিন ঋণ সীমার ব্যাপক অনিয়ম ঘটিয়ে সিকিউরিটিজ কেনা হয়। ১০৩২ নম্বর পিটি হিসাবে ডেবিট স্থিতি থাকা অবস্থায় কাজী ছানাউল হকের মেয়াদকালে ২০০৮ সালের ১৯ অক্টোবরে ১৭ লাখ ৪৮ হাজার ৮৯১ টাকার ক্রেডিট স্থিতির ওপর ১৮ লাখ টাকা এবং ২০ অক্টোবর ৫১ হাজার টাকা ডেবিট স্থিতির ওপর পুনরায় ৭ লাখ টাকা তহবিল উত্তোলন দেওয়া হয়েছে। যা বিধিবহির্ভূত এবং গুরুতর অনিয়ম।

৪৪৮১ নম্বর পিটি হিসাবে প্রায় সাড়ে ৪৪ লাখ টাকা ডেবিট স্থিতি থাকা অবস্থায় ছানাউল এবং উপ-প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা টিপু সুলতান ফারাজীর মেয়াদে ২০১০ সালের ৪ অক্টোবর সিকিউরিটিজ অন্য প্রতিষ্ঠানের লিংক বিওতে স্থানান্তর করা হয়েছে, যা শতভাগ নিয়ম লঙ্ঘন। এমন ঘটনায় আইসিবি ব্যাংক তদন্ত কমিটি গঠন করে। তদন্ত কমিটি অর্থ লুটপাটের সত্যতা পায়। তদন্ত কমিটি তদন্তে পাওয়া অনিয়ম ও দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে একটি প্রতিবেদন আইসিবিতে জমা দেয়। পরে তা অর্থ মন্ত্রণালয়েও জমা দেওয়া হয়।