দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে সপ্তাহজুড়ে সূচকের বড় দরপতনের মধ্যে দিয়ে লেনদেন শেষ হয়েছে। পতনের তাণ্ডবে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ২৬২ পয়েন্ট এবং চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সার্বিক সূচক ৭৭৬ পয়েন্ট কমেছে। আর ব্যাপক পতনে ডিএসইর বাজার মূলধন এক সপ্তাহে ১৭ হাজার ১৬১ কোটি ১ লাখ ৫৪ হাজার টাকা বা ৫.০৩ শতাংশ কমেছে। তবে দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে সংকট ও সরকারি নীতিনির্ধারণী কিছু সিদ্ধান্তের প্রভাবে নতুন বছরেও বড় দরপতনে পড়েছে পুঁজিবাজার।

ব্যাংক, টেলিযোগাযোগ, ফার্মাসিউটিক্যালসসহ প্রায় সব খাতের বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ারের দরপতনে চলতি সপ্তাহের পাঁচ কার্যদিবসে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল্যসূচক হারিয়েছে প্রায় ৬ শতাংশ। দর কমেছে ৮৭ শতাংশ সিকিউরিটিজের। আগের দুই বছরের ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের দরপতনে বিনিয়োগকারীদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। অনেকেই নিঃস্ব হয়ে বাজার ত্যাগ করছেন।

২০১৮ সালে ডিএসইর প্রধান সূচকটি হারায় ১৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ। পরের বছর পতনের তীব্রতা কিছুটা বেড়ে গিয়ে মূল্যসূচকের পতন হয় ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ। আর নতুন বছরে ব্যাংক খাতের খেলাপি পরিস্থিতির অবনতি ও ক্রেডিট কার্ড ছাড়া সব খাতের ঋণের সুদহার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ বাস্তবায়নে সরকারি উদ্যোগের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। মাত্র পাঁচ কার্যদিবসের পতনে ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক কমে গেছে ৫ দশমিক ৯ শতাংশ।

পুঁজিবাজারে বড় আকারের বিদেশি বিনিয়োগ রয়েছে, এমন একটি প্রতিষ্ঠান নিউজ লেটারে জানিয়েছে, ২০১৯ সালে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি, রপ্তানি আয় কমে যাওয়া, গ্রামীণফোনের সঙ্গে বিটিআরসির দ্বন্দ্ব ও কিছু ফ্রন্টিয়ার ফান্ডের অবসায়নের কারণে বিদেশিদের শেয়ার বিক্রির চাপ পুঁজিবাজারের পতনে প্রধান ভূমিকা রাখে। চলতি বছর এসব কারণের সঙ্গে যোগ হয়েছে ব্যাংক খাতের নয়ছয় সুদহার নির্ধারণ। ক্রেডিট কার্ড ছাড়া অন্যসব ঋণের সুদ ৯ শতাংশ ও আমানতে সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ নির্ধারণ করে সরকার তা আগামী এপ্রিল থেকে বাস্তবায়নের ঘোষণা দিয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এটি বাস্তবায়ন করা খুবই কঠিন হবে। কারণ খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকের বিনিয়োগ ব্যয় বেড়ে গেছে। আবার ঝুঁকিপূর্ণ এসএমই ঋণও ৯ শতাংশ সুদহারে দেওয়া সম্ভব নয় বলে ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে। নয়ছয় সুদহার বাস্তবায়নে সরকার যদি বাধ্য করে তাহলে ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ কমিয়ে দিতে পারে।

এতে করে ব্যাংক খাতের আয় আরও কমে যেতে পারে। আর ব্যাংক যেহেতু পুঁজিবাজারের সবচেয়ে প্রভাবশালী খাত, তাই খাতটির প্রভাবে পুঁজিবাজারে আরও অস্থিরতা তৈরি করতে পারে, যা ইতিমধ্যেই দেখা যাচ্ছে। কয়েক বছর আগে কেনিয়াতেও নয়ছয় সুদহার বেঁধে দেওয়া হয়েছিল, যা পরে ব্যর্থ হয়েছে।

এদিকে সরকারি নীতিনির্ধারণী কিছু সিদ্ধান্তের প্রভাবও পুঁজিবাজারে পতনে ভূমিকা রাখছে। সরকারের রেভিনিউ আয়ের প্রায় ২০ শতাংশ আসে গ্রামীণফোন ও বিএটি বাংলাদেশ থেকে। কিন্তু পাওনা নিয়ে বিটিআরসির সঙ্গে গ্রামীণফোনের দ্বন্দ্ব চলছে। কোম্পানিটি তার সেবার মান বাড়াতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বিনিয়োগ না করায় ইতিমধ্যেই সমস্যা তৈরি হয়েছে। আবার বাজেটে সিগারেটের দাম বৃদ্ধির কারণে বিএটি বাংলাদেশের আয় কমে গেছে। প্রতিষ্ঠানটি সিগারেটের বাজারের প্রায় ৭০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে।

কিন্তু বাজেটে কর বৃদ্ধির কারণে বিএটি তার লো-সেগমেন্টের সিগারেটের বাজার হারাচ্ছে। এদিকে রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলোর রিজার্ভে থাকা অর্থ সরকারি কোষাগারে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এটি কার্যকর হলে তালিকাভুক্ত রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলোর আয় ব্যাপক হারে কমে যাবে। কারণ এসব কোম্পানির মুনাফার বড় অংশই আসে রিজার্ভের অর্থ ব্যাংকে রাখা আমানতের সুদ আয় থেকে। পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সরকারি নীতিতে যদি সংস্কার না আসে তাহলে পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা আসার সুযোগ নেই বললেই চলে।

বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি সপ্তাহের পাঁচ কার্যদিবসই দরপতন হয়েছে। এ সময় ডিএসইতে লেনদেন হওয়া ৩৫৭টি সিকিউরিটিজের মধ্যে দর বেড়েছে মাত্র ৩৪টির। বিপরীতে দর হারিয়েছে ৩১০টি ও অপরিবর্তিত ছিল ১৩টির। ৮৭ শতাংশ শেয়ারের দরপতনে ডিএসইএক্স হারিয়েছে ২৬২ পয়েন্ট। এতে সূচকটি নেমে এসেছে ৪১৯৭ পয়েন্টে। ২০১২ সালের ডিসেম্বর শেষে ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচকটি ছিল ৪২১৯ পয়েন্টে। চলতি সপ্তাহে ডিএসইর সেরা কোম্পানি নিয়ে তৈরি ডিএস৩০ সূচক ৬ দশমিক ৬ শতাংশ ও শরিয়াহ সূচক ৬ দশমিক ৩ শতাংশ কমেছে।

পর্যালোচনায় দেখা যায়, চলতি সপ্তাহে সিমেন্ট ছাড়া অন্যসব খাত বাজার মূলধন হারিয়েছে। সরকারের পাওনা আদায়কে কেন্দ্র করে বিটিআরসির সঙ্গে বিবাদের জেরে চলতি সপ্তাহে গ্রামীণফোনের দর কমেছে ১১ দশমিক ৩ শতাংশ। পাট খাত হারিয়েছে ১২ দশমিক ৬ শতাংশ। সূচকে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তারকারী ব্যাংক খাত হারিয়েছে সাড়ে ৫ শতাংশ বাজার মূলধন।

ফার্মাসিউটিক্যালস খাত হারিয়েছে প্রায় সাড়ে ৭ শতাংশ দর। এছাড়া এনবিএফআই, জ¦ালানি, বীমা, বস্ত্র, প্রকৌশল ও বিবিধ খাত উল্লেখযোগ্য পরিমাণে দর হারিয়েছে। বিপরীতে লাফার্জহোলসিমের দরবৃদ্ধিতে পুরো সিমেন্ট খাতের বাজার মূলধন ২ দশমিক ৩ শতাংশ বেড়েছে। বড় পতনে চলতি সপ্তাহে ডিএসই বাজার মূলধন হারিয়েছে ১৭ হাজার ১৬০ কোটি টাকা।